(পর্ব-১৩)
বেশিরভাগ নন-ফিকশন বইয়েরই ভূমিকা থাকে, উপন্যাসে থাকে হাতেগোনা। যেকোনো বইয়ের ভূমিকা হচ্ছে ওই বইয়ের অতি সংক্ষিপ্ত রূপ বা আলোচনা। অনেকে বইয়ের ভূমিকা এড়িয়ে গিয়ে সরাসরি মূল কাহিনি পড়া শুরু করেন। আমি যেকোনো বই হাতে পেলেই শুরুতে ভূমিকা খুঁজি, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বইয়ের ভূমিকা সবসময় যে লেখক লিখে থাকেন তেমন নয়, বরং আলোচিত বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বা কোনো নামকরা ব্যক্তি ভূমিকা লেখেন। অনেক সময় বইয়ের ভূমিকায় যে তথ্য থাকে, তা পুরো কাহিনির আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই কারণেই ভূমিকা সবারই পড়া উচিত বলে মনে করি।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই ‘নন্দিত নরকে’র ভূমিকা লিখেছিলেন ড. আহমদ শরীফ। তাতে তিনি উল্লেখ করেন ‘মাসিক মুখপত্রের’ প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম ‘নন্দিত নরকে’ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কারণ ওই নামের মধ্যেই যেন একটি নতুন জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক তো বটেই, তার নামটিও ছিল আমার সম্পূর্ণ অপিরিচিত। তবু পড়তে শুরু করলাম ওই নামের মোহেই। পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।…হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবন শিল্পী হবেন—এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করবো।’
পরে ‘নন্দিত নরক’ বই আকারে প্রকাশের প্রক্রিয়া কাহিনি অনেকেরই জানা, সেটি আর বিস্তারিত পুনরুল্লেখ না করে শুধু এটুকু বলবো যে, বইটি প্রকাশে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন আহমদ ছফা। তবে আহমদ শরীফের এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা বিফলে যায়নি। পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদ একের পর এক উপন্যাস রচনা করে তিনি যেমন পাঠক সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তেমনই তিনি হয়ে ওঠেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী লেখক। বেঁচে থাকতে যেমন পাঠকমহলে বিশেষ করে, তরুণ-তরুণীদের মাঝে তার ছিল একক রাজত্ব, মৃত্যুর পর এখনো তাদের কাছে তিনি সমান জনপ্রিয়। অতীতে এদেশের কোনো লেখকের ভাগ্যেই এই সম্মান জোটেনি।
ড. নীহাররঞ্জন রায়ের তিন খণ্ডের ‘বাঙালি ইতিহাস’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই বইয়ের আদি পর্বের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ রচনা করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনিও তার বইটির নাম রেখেছেন ‘বাঙালির ইতিহাস’। বইটির ভূমিকা বেশ সুপাঠ্য। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘জেল থেকে বেরিয়ে এক প্রকাশনা সংস্থায় সবে পেয়েছি পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকরি। দুম করে বিয়ে করে বসলাম। তার তিন দিনের মাথায় ছাঁটাই। রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ অনুবাদের ঠিকে নিয়ে দুজনে (সুভাষ ও তার স্ত্রী) চলে গেলাম বজবজের এক গাঁয়ে। সকালে চটকলে গেটমিটিং সেরে বাসে করে চলে যাই ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সন্ধ্যেবেলায় ইউনিয়ন অফিস। লণ্ঠনের আলোয় রাত্তিরে অনুবাদ করি।
এর ঠিক আগে ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় স্নেহবশে তার বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব) বইটি ছোটদের উপযোগী করে পুনর্লিখনের অনুমতি দেন। কাজটা যে সহজ নয়, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিষয় ছিল দর্শন। ইতিহাস নয়। নিজেকে তৈরি করার জন্য নীহাররঞ্জনের নির্দেশিত বইগুলো সারাদিন লাইব্রেরিতে বসে মন দিয়ে মাসের পর মাস পড়তে হয়েছিল। পরে লেখা শেষ করে, নীহাররঞ্জন বিদেশ থেকে ফিরে এলে, সাহস করে তাকে দেখাই। পাণ্ডুলিপি পড়ে তিনি ছাপাবার ছাড়পত্র দেন। কাজ হাতে নিয়েছিলাম পেটের দায়ে। শেষ হলে দেখি মনের দরজা-জানালাগুলো যেন খুলে গিয়েছে।’
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং’ গ্রন্থের ভূমিকায় সুজিকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘বাঁধাধরা লেখপড়ায় মন বসাতে পারতেন না বালক রবি। পড়াশুনোর চাপ যত বেশি হতো, তিনি ততখানি দিতেন আলগা। নানান স্কুল বদলে বদলে দেখা হলো, টিকতে পারলেন না কোথাও। স্কুলে যখন কুলোলো না, তখন বিভিন্ন বিষয়ে গৃহশিক্ষকদের নিযুক্ত করে রবির ওপর পড়াশোনার আঁটাআঁটি বাড়ানো হলো। নামি শিক্ষক তারা। ওই গৃহশিক্ষকদের মধ্যে এমনকি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু, যাকে সকলে আদর্শ শিক্ষকব্রতীরূপে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বালক রবিকে পড়ানোর ব্যাপারে ইনিও বিফল। সুতরাং, রবি সম্বন্ধে আত্মীয়-স্বজনেরা এরকম হালই ছেড়ে দিলেন।’
তবে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অমনোযোগী হলেও বালক রবির ছিল বাইরের বই ও পত্রপত্রিকা পড়ার অদমনীয় নেশা। সে সম্পর্কে সুজিকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘একেবারে ছেলেবেলায় দু’টি বাংলা সাময়িকপত্র বারবার পড়ে তিনি (রবি) গভীর আনন্দ পেতেন। পত্রিকা দু’টির নাম ‘বিবিধার্থ-সংগ্রহ’ ও ‘অবোধবন্ধু’। দুটি পত্রিকারই বাঁধানো খণ্ড ছিল দাদাদের আলমারিতে। তিনি লুকিয়ে এনে পড়তেন।’
আইসিএস পাস করে অন্নদাশঙ্কর রায় অ্যাসিস্টান্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রথম যোগ দিলেন, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। চাকরির প্রথম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি তার ‘যুক্তবঙ্গের স্মৃতি’ গ্রন্থের শুরুতে ‘সূত্রপাত’ নামে। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘‘দিন কয়েক যেতে না যেতেই বাংলার লাট স্ট্যানলি জ্যাকসন আসেন মুর্শিদাবাদ সফরে। কালেকটর তার কাছারির একখানা হলঘরে লাটসাহেবের দরবার বসান। দেয়ালগুলোকে চুনকাম করে নতুন রঙে রাঙানোর সময় আমাকে মনে পড়ে। কালেকটরের চাপরাশি এসে বলে, ‘সাহেব সেলাম দিয়েছেন।’ মানে ডেকেছেন। দরবারে গিয়ে আমার মত জানাই। দরবার হয়ে যাবার পর কালেকটর একদিন পাকড়াও করে বলেন, ‘দরবারের দিন আপনি সাধারণ পোশাক পরেছিলেন কেন? মর্নিং ড্রেস নেই? তবে অবিলম্বে কলকাতা গিয়ে মর্নিং ড্রেস বানাতে দিন। যতদিন চাই ততদিন ছুটি পাবেন। আইসিএস শুনলে দর্জিরা ধারে পোশাক দেবে, পরে আস্তে আন্তে শোধ করলে চলবে। মর্নিং ড্রেস হচ্ছে আইসিএসদের ইউনিফর্ম।’ কী বিপদ! এখনও আমি প্রথম মাসের বেতন পাইনি। মাইনে পেলেও তা থেকে একটা মোটা অংশ কেটে নেবে বিলেত থেকে ফেরবার সময় যে অ্যাডভান্স নিয়েছিলুম সেটা শোধ দিতে, আরেকটা মোটা অংশ বাদ যাবে জার্মানিতে ভাইয়ের শিক্ষা ব্যয় মেটাতে। বাবুর্চি বেয়ারা জমাদার না থাকলে ছোট সাহেব হওয়া যায় না। বড়সাহেব, জজসাহেব ছোটসাহেব এই তিনজনই আইসিএস। এদের মতো সম্মান আর কারো নয়। আমরা বন্ধু অ্যাসিস্টান্ট ম্যাজিস্ট্রেট করুণাকুমার হাজরা তো শুনিয়েই দিয়েছিলেন, আইসিএস হতে হলে গোড়া থেকেই হতে হয়। যেমন জাত ব্রাহ্মণ।’’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসটির কলেজ সংস্করণে ভূমিকা লিখেছেন শওকত আলী। সেখানে তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন—‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’—দস্তয়েভয়স্কির এই বক্তব্য সমন্বিত উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ বহুকাল ধরে বিশ্বের মানুষকে মানবতাবাদী ও মানব প্রেমিক হওয়ার প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। আবার আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘মানুষকে ধ্বংস করা যায়, কিন্তু কখনোই পরাজিত করা যায় না’— এইরকম একটি উপলব্ধি মানুষকে সাহসী এবং সংগ্রামী করে তুলতে পারে। আমরা জানি, সাহস এবং সংগ্রামবিহীন জীবন আর যা-ই হোক প্রকৃত মানুষের নয়।
নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিছুকাল কিউবায় বাস করেছিলেন। তিনি যে ছোট্ট রেস্টুরেন্টে একটি উঁচু টুলের ওপরে বসে ‘রাম’ পান করতেন, সেই রেস্টুরেন্টটি দেখে এসেছেন রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো। তিনি বলেন, ‘‘হেমিংওয়ে আমার প্রিয় লেখক। তিনি কিউবাতে বসেই লিখেছিলেন ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’। তার বাড়িটি এখন মিউজিয়াম। সেখানে হেমিংওয়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্তর এবং শিকার করা অনেক জন্তুর চামড়া সাজানো রয়েছে।’’
নিজেদের সমর্পণ করি বীরপূজায়। তারপর বীর একদিন হয়ে যান খলনায়ক। তখন তাকে ছেড়ে আরেক বীরকে ধরি। এভাবেই এগিয়ে যায় সমাজ, আমাদের ইতিহাস
নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাংলা ভাষায় প্রথম বই ‘বাঙালি জীবনে রমণী’। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। বইয়ের শুরুতেই ‘পাঠক-পাঠিকার প্রতি নিবেদন’ শিরোনামে লেখক বলেছেন, ‘এ পর্যন্ত আমি বাংলা বই লিখি নাই, এই আমার প্রথম বই। পঞ্চশ বছর বয়সে ইংরেজিতে প্রথম বই লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম, সত্তর বছর বয়সে বাংলা লিখিলাম। ইংরেজির বেলাতেই দেরি হইয়া গিয়াছে মনে করিয়াছিলাম, সুতরাং বাংলার ক্ষেত্রে আরও কত যে দেরি হইয়া গিয়াছে তাহা মনে করিতেও ভীতি হইতেছে।’
এর বিশ বছর পর ১৯৮৮ সালে বের হয় তার দ্বিতীয় বাংলা বই, নাম ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। প্রথম বইটি লিখেছেন দিল্লিতে থাকাকালে আর দ্বিতীয় অক্সফোর্ডে বসে। এবার ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’-এ তিনি লিখলেন, ‘‘আমার প্রথম বাংলা বই ‘বাঙালি জীবনে রমণী’ সত্তর বছরে পড়িবার পর লিখিয়াছিলাম। দ্বিতীয়টি নব্বই বছরে পড়িবার পর আরম্ভ করিয়া একানব্বই পূরণ হইবার প্রাক্কালে শেষ করিলাম। যাহারা এই বই পড়িতে মনস্থ করিবেন, তাহারা বয়সের কথা শুনিয়া নিশ্চয়ই মনে করিবেন— জরাগ্রস্থ বৃদ্ধের আবোল-তাবোল শুনিতে হইবে। তবে নিজের দিক হইতে এইটুকু জানাইব যে, নিজের অবশিষ্ট জীবনী শক্তি দিয়াই বইখানা লিখিয়াছি। এই বইতে যাহা আছে তাহা সত্যকার ঘটনা, সত্যকার চিন্তা ও কর্ম এবং সত্যকার ইচ্ছ-আকাঙ্ক্ষার বর্ণনা।… আজ বাঙালি জীবনে যে জিনিসটা প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ সেটা এই— মৃত্যুযন্ত্রনারও অনুভূতি নাই, আছে হয় পাষাণ হইয়া মুখ বুজিয়া সহ্য করা, অথবা সংজ্ঞাহীন হইয়া প্রাণ মাত্র রাখা। আরেকটা ব্যাপারও আছে— জাতির মৃত্যুশয্যার চারিদিকে ধনগর্বে উল্লসিত বাঙালি প্রেত ও প্রেতিনীর নৃত্য।’
এরপর বাংলা ভাষায় নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আরো একটি বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে, নাম ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’। এই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,‘‘নিজের জীবনের পরিচয় দিতে গিয়া সেই জীবনকে ‘দেবোত্তর সম্পত্তি’ বলিলাম কেন? আজিকার দিনে সকল বাঙালি ভদ্রলোকই চাকুরিজীবী, নয় ব্যবসায়ী হইয়া গিয়াছে। ভূ-সম্পত্তিগত বহু শব্দের অর্থ তাহাদের জানা নাই। ভূ-সম্পত্তির উল্লেখ করিলেই তাহারা টিয়া পাখির মতো একটা শব্দ উচ্চারণ করিতে থাকে, সেই শব্দটা ‘ফিউড্যালিজম’। তাহাদের কাছে ‘ফিউড্যালিজম’ শব্দটা ‘বুর্জোয়া’ শব্দের মতোই সখের গালিতে পরিণত হইয়াছে। আমাদের অল্প বয়সে কিন্তু এই অজ্ঞতা ছিল না।’’
‘‘তখন ভূসম্পত্তিই ছিল বাঙালির ‘ভদ্র’ বলিয়া গণ্য হইবার একমাত্র উপায়। ওকালতি, ডাক্তারি ইত্যাদি পেশা অবলম্বন করিয়া বা ব্যবসা করিয়া অতি ধনবান হইলেও ‘ভদ্রলোক’ বলিয়া মান্য হইবার জন্য বাঙালিকে ‘জমিদার’ অথবা অন্য ধরনের ভূ-স্বামী হইতে হইত। ইহার একটি দৃষ্টান্ত দেই। জোড়াসাঁকোর রামমণি ঠাকুর ব্যবসা করিয়া ধনী হইয়াছিলেন। তাহার পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্যবসা বজায় রাখিলেন বটো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাবনা ও নদীয়া অঞ্চলে বহু সম্পত্তিও কিনলেন। তাহার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ব্যবসা একেবারে ছাড়িয়া দিলেন।’’
‘‘বাঙালিদের মধ্যে ও বাংলা ভাষায় ‘জমিদার’ শব্দের একটা বিশিষ্ট অর্থ আছে। সকল ভূসম্পত্তি সম্পন্ন পরিবারেরই ‘জমিদার’ আখ্যা হইত না। ‘জমিদার’ বলিতে বাংলা ভাষায় বোঝা যাইত সেই সব ভূসম্পত্তির অধিকারী যাহারা ‘চিরস্থায়ী ব্যবস্থা’ অনুযায়ী সাক্ষাৎভাবে গভর্নমেন্টের পত্তনীদার ছিল এবং এজন্য সদরজমা কালেক্টরিতে জমা দিতো। ইহারা সাধারণত রায়চৌধুরী পদবী গ্রহণ করিত। অন্য ভূস্বামীরা এই জমিদারদের পত্তনীদার হইত, তাহারা খাজনা দিত জমিদারের কাছে।’’
‘‘রায়চৌধুরী, রায়, বা চৌধুরী উপাধিধারীরা হিন্দু বর্ণাশ্রমধর্মের যে-কোনো জাতির হইতে পারিত, এমন কি অস্পৃশ্য জাতির, মুসলমানও হইত। একদিন ইহার জন্য আমি একজন গোঁড়া ব্রাহ্মণের দ্বারা ভর্ৎসিত হইয়াছিলাম। সে ১৯১৭ সনের কথা। আমি ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরিতে গিয়া পড়াশুনা করিতাম। সেখানে সত্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয়ও যাইতেন— ইনিই ‘জালিয়াৎ ক্লাইভ’ পুস্তকের লেখক। একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার নাম কি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘নীরদচন্দ্র চৌধুরী।’ তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘চৌধুরী! বামুন না চাঁড়াল বুঝবো কি করে?’ আমি জাতিভেদে বিশ্বাসী ছিলাম না, মনে মনে বলিলাম, ‘চাঁড়ালই ধরে নিন।’ কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয়ের মতো দুর্দান্ত ব্যক্তিকে তাহা ধ্বনিত করিয়া বলিবার ভরসা পাইলাম না। আমি অবশ্য জাতিতে কায়স্থ।’’
বলা বাহুল্য, পঞ্চাশ বছর বয়সে নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন জীবনের প্রথম গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায়, সেটি ছিল তার আত্মজীবনী, নাম ‘অটো বায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’।
প্রসঙ্গত, একাত্তরে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি ভারতের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অর্থ ভারতের একটি শত্রু বৃদ্ধি করা। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, দেশের নিকটবর্তী ছোট দেশগুলো পার্শ্ববর্তী বড় দেশকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদের সামান্যতম ভুল-ত্রুটির ব্যাপারেও অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়। এতদিন ভারতকে সন্দেহের চোখে দেখেছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এদের সঙ্গে বাংলাদেশও যোগ দেবে।’
‘ইতিহাসের যাত্রী’ গ্রন্থের ভূমিকায় মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য— ‘‘আমাদের ইতিহাস ব্যক্তিনির্ভর। ঘটনার পরম্পরা নয়, ব্যক্তিকে নিয়েই আমাদের আগ্রহ আর আকুতি। এজন্য আমরা একের পর এক তৈরি করি ‘কাল্ট’। নিজেদের সমর্পণ করি বীরপূজায়। তারপর বীর একদিন হয়ে যান খলনায়ক। তখন তাকে ছেড়ে আরেক বীরকে ধরি। এভাবেই এগিয়ে যায় সমাজ, আমাদের ইতিহাস।’’
চলবে…
বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-১২॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম