পর্ব: ১২
আবুল কাসেম ফজলুল হক তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, সে সময় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার জীবনী লিখতে চেয়েছিলেন। তারপর কী ঘটেছিল শুনুন অধ্যাপক রাজ্জাকের বয়ানে— ‘‘আমি একবার মিস্টার এ কে ফজলুল হকরে যাইয়া কইলাম, আমি আপনের জীবনীটা লেখবার চাই। আপনে যদি দয়া কইর্যা পারমিশনটা দেন, কাজ শুরু করবার পারি। হক সাহেব তখন ইস্ট পাকিস্তানের গভর্নর। আমার প্রস্তাব শুইন্যা খেকাইয়া উইঠ্যা কইলেন, ‘আমার জীবনী লেখতে চাও, নিশ্চয়ই তোমার একটা মতলব আছে।’ আমি কইলাম, ‘মতলব ত একটা অবশ্যই আছে।’ হক সাহেব কইলেন, ‘আগে হেইডা কও।’ আমি কইলাম, ‘আপনে যখন গাঁও গেরামে যান, মাইনষের লগে এমন ব্যবহার করেন, তারা মনে করে জনম ভইর্যা আপনে গাঁও গেরামে কাটাইয়া তাগো সুখ-দুঃখের অংশ লইতাছেন। তারপরে গাঁও গেরাম থেইক্যা ঢাকা শহরে আইস্যা আহসান মঞ্জিলের ছাদে উইঠ্যা নওয়াব হাবিবুল্লাহর লগে যখন ঘুড্ডি উড়ান, লোকজন দেইখ্যা আপনেরে নওয়াববাড়ির ফরজন্দ মনে করে। তারপরে আবার যখন কলিকাতায় যাইয়া শ্যামাপ্রসাদের লগে গলা মিলাইয়া শ্যামাপ্রসাদরে ভাই কইল্যা ডাক দেন, কলিকাতার মানুষ চিন্তা করে আপনে শ্যামাপ্রসাদের আরেকটা ভাই। বাংলার বাইরে লখনৌ কিংবা এলাহাবাদে গিয়া মুসলিম নাইট নবাবগো লগে যখন বয়েন, দেখলে মনে অইব আপনে তাগো একজন। এই এতগুলা ভূমিকায় আপনে এত সুন্দর সাকসেসফুল অভিনয় করতে পারেন, এইডা ত একটা মস্ত ক্ষমতা। এই ক্ষমতা স্যার অলিভার লরেন্সেরও নাই। এই অভিনয়ক্ষমতার একটা এনকোয়ারি আমি করবার চাই। আর নইলে আপনের আসল গুণপনা কোথায় হেইডা ত আমাগো অজানা নাই।’ হক সাহেব হুঙ্কার ছাইড়্যা জিগাইতে লাগল, ‘তুমি আমার সম্পর্কে কী জান?’ আমি কইলাম, ‘আপনে সুন্দর সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য মিছা কথা কইবার পারেন।’ আমার জবাব শুইন্যা হক সাহেব হ হ কইর্যা হাইস্যা উঠলেন।’’ (যদ্যপি আমার গুরু: আহমদ ছফা)
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবধারিত। বিশেষ করে নির্বাচন এলে বিষয়টি আরও প্রকাশ্যে চলে আসে। সবচেয়ে বড় দলের প্রার্থী যেমন ভাবেন ভোটে তিনিই জিতবেন, তেমনই সবচেয়ে ছোট দলের প্রার্থী এমনকি যিনি কখনও ভোটারদের মুখোমুখি হননি, তিনি মনে করেন বিজয় তার ঘরেই আসবে। এই আশাটুকু না থাকলে হয়তো নির্বাচনের প্রয়োজনই হতো না। তবে ভোটে জেতার জন্য প্রার্থীদের নানান কৌশল ও প্রতিশ্রুতি থাকে। নির্বাচনে জেতার পর সেসব প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন করবেন সেটা পরের বিষয়। ভোটারদের মন জয় করতে প্রার্থীরা অনেক সময় অনেক মিথ্যার আশ্রয়ও নেন। যেহেতু তা লিখিত নয়, কেবল মুখের কথা বলে জনসাধারণও এসব কথাকে কম গুরুত্ব দেন। আগের দিনের রাজনীতিকদের নির্বাচনি এসব কৌশল ছিল এখনকার তুলনায় অনেকটাই সাদামাটা ও নীরিহ প্রকৃতির। এখন যেমন নির্বাচনের আগেই পথের কাঁটা দূর করতে প্রতিদ্বন্দ্বিকে হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দেওয়া এমনকি হত্যা করা হয়,সেকালের রাজনীতিকে এসব ছিল না বললেই চলে। এখানে ১৯৩৫ সালের নির্বাচনে প্রজা পার্টির প্রার্থী ফজলুল হকের একটি নির্বাচনি প্রচারণার ঘটনা উল্লেখ করছি:
১৯৩৫ সালের সাধারণ নির্বচানে পটুয়াখালী থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন প্রজা পার্টির এ কে ফজলুল হক। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইউনাইটেড পার্টির খাজা নাজিমুদ্দীন। ওই এলাকায় ছিল স্যার নাজিমুদ্দীনের জমিদারী, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন তার বিজয় নিশ্চিত। ফজলুল হক গেলেন নির্বাচনি প্রচারণায়। কলকাতা থেকে তার সফর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদী পত্রিকার জাদরেল সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের। কী ঘটেছিল সেদিন? শোনা যাক মোদাব্বের বয়ানে— ‘‘স্যার নাজিমুদ্দীন মনে করেছিলেন যে, তার প্রজারা তাকে ছাড়া আর কাউকে ভোট দিতে পারে না। কিন্তু হক সাহেবের প্রচার কৌশলের কাছে তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। হক সাহেবের প্রচারণার ধারা সম্পর্কে এখানে কিছু নমুনা দিচ্ছি।
হক সাহেব বজলুর কথায় যেন গলে গেলেন। তিনি তাকে অনেক দোয়া করে বললেন, ‘বেঁচে থাকো বাবা। খোদা তোমার তরক্কি করুন। তোমার বাপের রুহ যেন শান্তিতে থাকে।’
পটুয়াখালীর কাছে একটা ছোট দ্বীপের মতো এক গ্রামে হক সাহেবের লঞ্চ ভিড়লো। খবর এসেছিল যে, এই গ্রামের মাতব্বর নাজিমুদ্দীনের গোঁড়া সমর্থক। তারা হক সাহেবকে এই গ্রামের মাটিতে নামতে দেবে না। হক সাহেবও নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, ‘দেখো, এই গ্রামের সব ভোট আমি পাবো।’ তিনি এজেন্ট মারফত মাতব্বরের নাম ও তার পিতার নাম জেনে নিলেন। তারপর গ্রামের ঘাটে লঞ্চ ভিড়িয়ে একটা লুঙ্গি ও ছেঁড়া পিরহান পরে এবং গলায় জুজদানের মধ্যে একটি ডায়েরি নিয়ে তীরে নামলেন। ডায়েরিটা ঠিক কোরআন শরীফের মতো দেখাচ্ছিল। তিনি ধীর পদক্ষেপে মাতব্বরের বাড়ির সামনে এসে মাতব্বরের বাপের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন— ‘ফজলু মিয়া বাড়ি আছো? ও ফজলু মিয়া।’
বাড়ি ভেতর থেকে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে বললেন, ‘উনি তো নেই। দু’বছর হলো ইন্তেকাল করেছেন।’
হক সাহেব যেন শোকে মুষড়ে পড়লেন। তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রুমালে চোখ মুছে বললেন, ‘উনি ইন্তেকাল করেছেন জানাননি কেন? ফজলু মিয়া আমার কত জানের দোস্ত ছিলেন, তা আপনারা জানবেন কী করে? তা উনার ছেলে বজলু কোথায়?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘সে বাজারে গেছে। এখনই আসবে। তা বাবা আপনাকে চিনতে পারলাম না।’
‘তা চিনবেন কী করে? যে চিনতো সে নেই। বজলুও আমাকে চিনবে না। তা বজলু ফিরে এলে বলবেন যে, কলকাতা থেকে ফজলুল হক এসেছিল। যাক ফজলু ভাইয়ের কবরটা কোথায় একটু দেখিয়ে দিন।’
একটা ছোট ছেলে কবরটা দেখিয়ে দিলে হক সাহেব কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে শত শত রোক মোনাজাতে শামিল হলো।
মোনাজাত শেষ করে হক সাহেব লঞ্চে ফিরে চললেন। এই সময় বজলু ছুটতে ছুটতে এসে হক সাহেবকে কদমবুচি করে বললো, ‘আমি ফজলু মিয়ার ছেরে বজলু। মায়ের মুখে আপনার আসার কথা শুনে ছুটে এলাম। আপনি হুজুর আমার বাড়িতে কিছু মুখে না দিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না।’
হক সাহেব অনেক ওজর-আপত্তি করলেন, কিন্তু বজলু ণাছোবান্দা। শেষ পর্যন্ত রফা হলো যে, বজলু কিছু মুড়ি, গুড় ও নারকেল লঞ্চে নিয়ে আসবে। হক সাহেব মুড়ি চিবাতে চিবাতে বললেন, ‘ তোমার বাপ বেঁচে থাকলে আমার কী আর এই বুড়ো বয়সে এখানে আসতে হতো! কিন্তু সে নেই। আমারও সাহায্য করার কেউ নেই।’
বজলু বললো, ‘আপনার জন্য জান দিতে রাজি। বলুন, কী করতে হবে।’
হক সাহেব বুঝলেন, বরফ গলেছে। তিনি পাকা খেলোয়াড়। বললেন, ‘আচ্ছা ভোট হয়ে যাক, তারপর বলবো, তোমরা নাজিমুদ্দীনের জমিদারির প্রজা, কাজেই এখন আমার পক্ষে কাজ করলে তোমরা বিপদে পড়বে। আমার দোস্তের ছেলে বিপদে পড়ুক এ আমি চাই না।’ বজলু তখন বেপরোয়া। সে বললো, ‘ হুজুর আপনার মতো গরিবের মা-বাপকে আমরা যদি ভোট না দেই, তাহলে আমাদের দুঃখ-কষ্ট আর কে দেখবে? আমার চোখ খুলেছে হুজুর। এ অঞ্চলে একটা ভোটও নাজিমুদ্দীন সাহেব পাবেন না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।’
হক সাহেব বজলুর কথায় যেন গলে গেলেন। তিনি তাকে অনেক দোয়া করে বললেন, ‘বেঁচে থাকো বাবা। খোদা তোমার তরক্কি করুন। তোমার বাপের রুহ যেন শান্তিতে থাকে।’
লঞ্চ ছাড়লো। হক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাণ্ডটা কী রকম হলো?’
উনি হো হো করে হেসে বললেন, ‘রাজনীতিতে সততার স্থান নেই, আর সততা দেখাতে গেলে লোটাকম্বল নিয়ে বনে চলে যেতে হবে।’
যা হোক, এরকম দু’চারটি সভার পর হক সাহেব প্রকৃতপক্ষে পটুয়াখালী জয় করলেন এবং নির্বাচনে তিনি নাজিমুদ্দীনকে হারিয়ে দেন। পরে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী মিলে নাজিমুদ্দীনকে উপনির্বাচনে জিতিয়ে এনেছিলেন।’’ (ইতিহাস কথা কয়: মোহাম্মদ মোদাব্বের, পৃষ্ঠা. ১৫০-১৫২)
ফজলুল হক সম্পর্কে কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ‘‘চিরাচরিত নিয়মের ছক ছেড়ে হক সাহেব প্রথম বাঙালি নেতা হিসেবে চিহ্নিত হলেন। যাকে বাংলার মুসলমান জনসাধারণ তাদের আপন লোক বলে ভাবতে পেরেছিলেন। হক সাহেব কলকাতায় বাস করলেও কলকাতার সমাজের ছাপ গায়ে মাখাননি। বাংলার মুসলমান জনসাধারণ যে পোশাক চেনে, যে ভাষা জানে তাই ছিল হক সাহেবের পোশাক ও ভাষা। বাংলায় বক্তৃতা করার সময় তিনি জনগণের বিশেষ করে বরিশালের ভাষা ব্যবহার করতেন। এমনকি তাদের উচ্চারণ ভঙ্গিও। যেমন—প্রজা পার্টিকে বলতেন ‘পেরজা পার্টে’, ‘প্রত্যেক’ শব্দটি উচ্চারণ করতে ‘পেরতেক’।
ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, ময়মনসিংহের নবাব আলী চৌধুরী, কুমল্লার নবাব শামসুল হুদা, টাঙ্গাইলের স্যার আবদুল করিম গজনবী, মেদিনীপুরের আবদুল রহিম, মুর্শিদাবাদের নবাব ওয়াসেফ আলী মির্জা প্রমুখ মুসলমান অভিজাত নেতারা ছিলেন ব্রিটিশ রাজের এক একটি স্তম্ভ বিশেষ। এরা সবাই ছিলেন ভারতীয় মুসলমান। বাঙালি বলে পরিচয় দিতে এরা ছিলেন খুবই কুণ্ঠিত।
বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের নব জাগরণের যুগ যেন হক সাহেবের আগমনের অপেক্ষাতেই ছিল। ১৯১৩ সাল থেকে হলো শুভ যাত্রা। এ বছর ঢাকা মুসলিম নির্বাচন কেন্দ্র থেকে ফজলুল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘বেঙ্গল কাউন্সিলের’ সদস্য নির্বাচত হলেন।
ফজলুল হক ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। ১৮৮৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিত, রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় ‘ডাবল অনার্স’সহ দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এমএ পরীক্ষার ফল বেরুনোর পর আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি অবশ্যই মনক্ষুণ্ন হন। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ইংরেজি ভাষার ওপরে তিনি কী করে বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন তা চিন্তা করলে এখনও আশ্চর্য হতে হয়। কী সংসদে, কী সওয়াল জওয়াবে, কী রাজনৈতিক বিবৃতি বা ভাষণে তিনি যে ইংরেজি ব্যবহার করতেন তা এক এক সময় সাহিত্য হয়ে উঠতো। ১৯৪২ সালে হক সাহেব গান্ধীজীকে এবং জিন্নাহ সাহেবকে দু’খানা চিঠি লিখেছিলেন। প্রথমটি নাগপুর হাইকোর্টে একটি রায়ের প্রতি গান্ধীজীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং অপরটি মুসলিম থেকে তার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে জিন্নাহ সাহেবকে। উপরোক্ত খোলা চিঠি দু’খানার ওপরে কলকাতা স্টেটম্যান কাগজ এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলেছিল, চেষ্টারটন ও কুপারের পত্র সাহিত্যের পাশে এই চিঠি দু’খানাও ইংরেজ সাহিত্যে স্থান পাবে। সে যুগের স্টেটম্যান পত্রিকার মান যেকোনও প্রথম শ্রেণীর ব্রিটিশ সংবাদপত্রের সমকক্ষ ছিল। সুতরাং, ওই পত্রিকার মন্তব্যের একটা মূল্যও ছিল।
এক্ষেত্রে কোনো ন্যায়নীতির বালঅই নেই। আবার এর বিপরীতে কেউ কেউ বলে থাকেন রাজনীতিতে কোনো অন্যায্য বা অনৈতিক বলে কিছু থাকতে পারে না। তারা হয়তো রাজনীতিকে নীতির রাজা রূপে অবলোকন করতে চান। যদিও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এসেছিল তার অপূর্ব সাফল্য। রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যদিয়ে তাকে ধাপে ধাপে ওপরে আরোহণ করতে হয়নি। তার নেতৃত্বে বাংলার মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত উপকৃত হয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার ক্ষতি হয়েছিল প্রচুর। কলকাতা হাইকোর্টে উকিল হিসেবে তার যে খ্যাতি পাওনা ছিল তা তিনি পাননি। তাকে কেবল ছুটতে হয়েছিল বাংলাদেশের মফস্বল শহরে ‘ফৌজদারি’ মামলা চালাবার জন্য। মফস্বল শহর থেকে ডাক আসলে তিনি না করতে পারতেন না— ফলে একজন বিখ্যাত ফৌজদারি উকিলের সম্মান নিয়েই ওকালতি জীবন থেকে তাকে অবসর গ্রহণ করতে হয়েছিল। রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য মফস্বলে জেলা কোর্টের মামলা পরিচালনা করতে হতো। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মামলাতেই তিনি মুখ ফুটে পারিশ্রমিক চাইতে পারতেন না। ওইসব মক্কেল বা উকিল সাহেবরা অথবা টাউটরা তাকে খুশি করার জন্য সভা-সমিতির ব্যবস্থা করতেন। তাছাড়া তিনি জেলার উকিলদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার সুযোগ পেতেন— যা তার জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল। এর ওপরে ছিল চাটুকার-টাউটদের দৌরাত্ম্য। হক সাহেব অনেক সময় তার জুনিয়র উকিলদের বলতেন, তার পারিশ্রমিক সম্পর্কে মক্কেলদের স্মরণ করিয়ে দিতে। জুনিয়র উকিল মক্কেলদের সেকথা বলতেই চাটুকাররা বলে উঠতেন, ‘হক সাহেব গরিবের বাপ-মা, তিনি তাদের মতো গরিবের নিকট থেকে পারিশ্রমিক নেন না, তিনি কেবল আসা-যাওয়ার খরচটাই নিয়ে থাকেন।
টাউটরা মক্কেলদের নিকট থেকে হক সাহেবের নাম করে টাকা আদায় করতো, কিন্তু সে টাকা হক সাহেব পেতেন না। মক্কেলকে অবশ্যই তারা বলতো যে, তারা কলকাতা যাওযা-আসা, হক সাহেবের টিকিট কেনার পর বাকি টাকা হক সাহেবের বাড়িতে দিয়ে এসেছে। আর হক সাহেবকে আকাশে তুলতো এই বলে যে, ‘হক সাহেব গরিবের বাপ-মা’। একথা কেউ বুঝতে চাইতো না যে, হক সাহেবের সংসার চলবে কী করে। এই পরিস্থিতিতে হক সাহেব সংসার চালাতেন কাবুলিওয়ালাদের কাছ থেকে ধার করে।
১৯৩১ সালের আগে বাংলাদেশের মুসলমান উকিলদের পক্ষে নিজেদের পারিশ্রমিকের দ্বারা ভদ্রভাবে সংসার পরিচালনা করা কঠিন ছিল। ওই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই হক সাহেবের আর্থিক কষ্ট কোনো দিন ঘুচেনি। তার ওপরে ঘরের গৃহিণী ছিলেন অভিজাত বংশের মেয়ে— তাই খরচের বহরটা ছিল লাগাম ছাড়া। ফলে পারিবারিক জীবনে হক সাহেব সুখী ছিলেন না।’’ (স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর: কামরুদ্দীন আহমদ)
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশে হক সাহেবকে গৃহবন্দি করা হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ওই সময়কার একটি বিবরণ দিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘‘কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হলেও হক সাহেব কারো সঙ্গে দেখা করতেন না। কেএম দাস লেনের বাড়িতেই থাকতেন। এমন সময় লন্ডনের ‘টাইম’ পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদদাতা লুই হেরেন এলেন ঢাকায়, যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের আভিযোগগুলো কতটা সত্য তা যাচাই করে দেখার জন্য। ঢাকায় তাকে সহযোগিতা করার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপরে। সমস্য হলো শেরে বাংলাকে নিয়ে। তিনি কিছুতেই লুইর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হচ্ছিলেন না। টেলিফোনে শুধু বলছিলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহীর সাক্ষাৎকার নিয়ে কাজ নেই।’ তামি তাঁকে বললাম, ‘তিনি দেশ-বিদেশে সর্বত্রই প্রবাদবাক্যের মতো, সেজন্যেই বিলেত থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এই বিশিষ্ট সাংবাদিক এসেছেন শুধ প্রবাদের মানুষটাকে এক নজর দেখবেন বলে। তাঁকে এভাবে হতাশ করা কি বঙ্গশার্দুলের উচিত হবে? তাতে কাজে হলো।’ ফজলুল হক সাহেব বললেন, ‘বেশ, তিনি দেখা দেবেন, তবে সাক্ষাৎকার কিছুতেই নয়।’ বয়স সম্পর্কে হক সাহেবের দুর্বলতার কথাটি বললাম লুইকে। কে এম দাস লেনের বাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই উল্লেখ করলাম যে, তিনি আমার পিতৃতুল্য ব্যক্তি। শেরে বাংলা প্রতিবাদ করে বললেন যে, তিনি বরং আমার পিতামহের বয়েসীই হবেন। আমাদের এই কৃত্রিম বিতর্কের সুযোগ নিয়ে লুই বলে দিলেন, আগে থাকতেই যদি তিনি না জানতেন যে, শেরে বাংলার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে (আসলে তখন প্রায় পঁচাত্তর) তাহলে তিনি তাকে পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি বলেই মনে করতেন। লুই হেরেনের মন্তব্যটি অমোঘ অস্ত্রের মতো কাজ করলো। ফজলুল হক সাহেব আমাদের কফির আমন্ত্রণ করলেন এবং তারপর মধ্যাহ্ন ভোজের। বলা বাহুল্য, আমরা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম এবং লুই তার সাক্ষাৎকার পেয়েছিলেন। বিনা নোটিশের সেই নিমন্ত্রণে যে রাজভোগের আয়োজন ছিল তাতে লুইর তাক লেগে গিয়েছিল। তিনি আরো বিস্মিত হলেন শেরে বাংলার ভোজনের পরিমাণ দেখে। বিরাট দু’টি ভাজা কই মাছ, কয়েক টুকরো রুই মাছের পেটি, যথেষ্ট পরিমাণ খাসির মাংস ইত্যাদির পরেও প্রচুর দই, ফজলি আম ও সন্দেশ। ফজলুল হক সত্যিই খেতে পারতেন এবং খেতে ভালো বাসতেন।’’ (প্রীতি নিন সকলে: সিরাজুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫১-৫৩)
ব্যক্তিত্ব হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সোহরাওয়ার্দীর চেয়ে ফজলুল হক ছিলেন সম্পূর্ণই আলাদা। নাজিমুদ্দিন নিজেকে কাশ্মিরি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। আর সোহরাওয়ার্দীর শেকড় ছিল কলকাতা ও করাচি। আপরদিকে ফজলুল হক ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি জাতীয়তাবাদী।
রাজনীতিবিদদের বিষয়ে ১৯৩৪ সালের ১৭ এপ্রিল প্রখ্যাত ফরাসী লেখক ও চিন্তাবিদ রম্যাঁ-রলাঁ একটি চিঠিতে তাঁর এক অনুরাগীকে লিখেছেন, ‘যাঁদের নাম নেতা তাঁদের নামই সুযোগ সুবিধা, যাঁদের নাম সুযোগ সুবিধা তাঁদের নামই চোখে বাঁধা রঙিন ঠুলি…। এই বিচারে রাজনীতি তো নিতান্তই সংস্কৃতি বিরহিত বা সংস্কৃতি বর্জিত। এক্ষেত্রে কোনো ন্যায়নীতির বালঅই নেই। আবার এর বিপরীতে কেউ কেউ বলে থাকেন রাজনীতিতে কোনো অন্যায্য বা অনৈতিক বলে কিছু থাকতে পারে না। তারা হয়তো রাজনীতিকে নীতির রাজা রূপে অবলোকন করতে চান। যদিও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে।’ (রাজনীতিরি একাল সেকাল: জগমোহন বর্মণ, ২০১২)
চলবে…