॥পর্ব-সাত॥
যে অঞ্চলের মানুষেরা অতিথিপরায়ণ এবং গোষ্ঠীবদ্ধতায় বিশ্বাসী, মিলে মিশে থাকতে পছন্দ করে, সেখানকার একটা পরিবার শিল্পাঞ্চলে এসে হারিয়ে গেলো! আত্মীয়-স্বজন কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ যোগাযোগ না রেখে একেবারে আত্মগোপনের পর্যায়ে চলে গেছে এটা আবিরদের গ্রামের মানুষেরা হয়তো ভাবে। নানা রকম মন্তব্য করে, ধারণা করে। এসব কথা ওদের কারো কানে আসে না।
আবিরের মা জায়দা বিবি গ্রামে ছিলেন মুখরারমণী। শিল্পাঞ্চলে এসে তিনি একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছেন। কৃষি জমি ও ভিটামাটির পরে স্বামী হারানো, বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসা, মিল-কারখানায় আটঘণ্টা পুরুষ মানুষদের সঙ্গে কাজ করা, নাইট ডিউটি করা, মাসে দশদিন রাত জেগে থাকা, ঘরের সময় কমে যাওয়ার মতো নানা কারণেই তিনি বদলে গেছেন। এটা অবোধ সন্তানেরা কেউ টের পায় না। কিন্তু আবির বোঝে। সে মাকে আর ঝগড়া করতে দেখে না, ইদানিং তাকে হাসতেও দেখা যায় না।
কিছুদিন আগে আবিরের মামা একদিন কেমন করে যেন বাসা চিনে চলে আসেন। একজোড়া কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন। বোনকে না পেয়ে কিছুক্ষণ ভাগ্নে-ভাগ্নিদের সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। জায়দা তখন ডিউটিতে ছিলেন। মোকসেদা আর মোরশেদা মামাকে পেয়ে খুশিই হয়েছিল। কতদিন ধরে আত্মীয়-স্বজনদের দেখা নেই, কেউ বেড়াতে আসে না, এরমধ্যে হঠাৎ মামাকে পেয়ে ওদের খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু মামা খুশি হন নাই। যখন শুনেছেন তার বোন এখন সুতার মিলে কাজে লেগেছে, তখন তিনি বেজার হয়ে গেছেন। মিল-কারখানায় যারা যেসব নারী কাজ করে তাদের চরিত্র ঠিক থাকে না বলে তার ধারণা। তাই তিনি অবাক হয়েছেন। কোনো মন্তব্যও করেন নাই। শুধু বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছেন, তোর মা এখন মেইলে কাম লইছে!
আবির বুঝাতে চো করেছে, এখানে সব কিছু কিনতে হয়। কে এখানে লাকড়ি দেবে, ক্ষেতের খেড়, নাড়া, দাউড়া, আলুর লতা দেবে? ঘরভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। ছোট একটা রুম কতটাকা ভাড়া। সবাইকে কত ক করে থাকতে হয়।
সেদিন ডিউটি থেকে ফিরে জায়দা আবিরের মামার কথা শুনে কিছু বলেন নাই। শুধু জিজ্ঞাসা করেছেন, তোর মামারে কিছু খাইতে দেস নাই?
দিছি তো, মামায় খায় নাই। মোকসেদা জানায়।
এর পরে মা আর কোনো কথা বলেন নাই। রাতে শোয়ার সময় মোকসেদা তার মায়ের চোখে পানি দেখেছে। আবির তখন ডিউটিতে চলে গিয়েছিল।
পরদিন জায়দা বলেন, আসগর, তোর আব্বারে রাইতে স্বপ্নে দেখলাম। কী জানি কইল, বুঝতে পারলাম না।
এসময় চরাঞ্চল রক্তাক্ত জনপদ বলে ঘোষিত হয়। বিবিসির নিউজে এভাবেই বলা হয়। রাজিৈনতক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চর কেওয়ার ইউনিয়নের নানা গ্রামে মারামারি, বাড়িলুট, অগ্নিসংযোগ, ক্ষেতের ফসল কেটে নেওয়ার মতো ঘটনাগুলো আবার বেড়ে ওঠে। মুন্সীর হাট দিয়ে কোনো দিকে যাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। চর মশুরা, গুহেরকান্দি, টরকি, গজারকান্দিতে প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটে। এ এলাকায় একদল প্রবল ক্ষমতা নিয়ে অধিষ্ঠিত হয় অন্য দল মারামারি করে টিকে থাকার চো করে। পূর্ব ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চো করে। না পারলে বাড়ি-ঘর, ফসলের জমি এবং জমির ফসল রেখে পালিয়ে যায়। অন্য দল বাড়িঘর লুট করে যা পায় নিয়ে যায়। জমির আলু, ধান ইত্যাদি তুলে নিয়ে যায়। ক্ষেতে রেখেই বেচে দেয়। না পারলে কেরাসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ন করে।
আবার হয়তো পাঁচ বছর পরে অন্য গ্রুপটা জাতীয় নির্বাচনের পালাবদলের পরে আপন বলে বলীয়ান হয়ে শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা জাহির করে। শত্রুপক্ষকে এলাকাছাড়া করে পূর্ব ঘটনার প্রতিশোধ নেয়।
সেবার চরকেওয়ারের দুই গ্রুপে ভীষণভাবে খুনাখুনি লেগে গিয়েছিলো। চর অঞ্চলের অনেক নারী ও শিশু মুন্সীগঞ্জ শহরে এবং পঞ্চসারের এইসব এলাকায় আত্মীয়দের বাড়ি এসে আশ্রয় নেয়। শুধু চরকেওয়ার ইউনিয়নের লোকজন না, চরকেওয়ারের ওপর দিয়ে অন্য সব চরাঞ্চলে যাতায়াত করতে হয়। আধারা, শিলই, বাংলাবাজার এমনকি মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের লোকজন এখান দিয়েই যাতায়াত করে। সবাই চরকেওয়ারের লোকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। তখন এত রাস্তাঘাট ছিল না। মুন্সীর হাট থেকে নৌপথে ট্রলার দিয়ে দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতে হতো। মারামারি লাগলে মুন্সীরহাট থেকে ট্রলার চলা বন্ধ হয়ে যেতো প্রায়ই। কারণ অনেক সময় হিং¯্র কোনো দল সন্দেহজনক কাউকে ট্রলারে দেখলে অস্ত্র হাতে অন্য ট্রলার নিয়ে এসে যাত্রীবাহী ট্রলার থেকে নামিয়ে কোপাতো। মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
আবিরকে মুক্তারপুর বাজারে অনেক পরিচিতজন জিজ্ঞাসা করেছে, কিরে তোগো চরের কতা দেহি বিবিসি কইতাছে। তোরা নাকি রক্ত দিয়া গোসল করোস?
আবির মাথা তুলে বলে, ওটা চরকেওয়ারের ঘটনা, আমাগো ওখানে এইসব নাই। আমরা আধারা ইউনিয়নের।
আবিরদের এক ইঞ্চিও জমি নাই কোথাও। তারপরেও সে আধারা ইউনিয়নের পক্ষে কথা বলে। ‘আমাগো ওখান’ বলে দাবি করে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষের মধ্যে একদিন আবিরদের গ্রামের দুইজন লোক আসেন, ওরা বলে কাশেম কাকা আর জামাল কাকা। দূর সম্পর্কে আবিরদের কাকা তারা হনও। চিতুলিয়া থেকে ট্রলারে খাসের হাট, সেখান থেকে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে মোল্লাকান্দির মহেশপুর এসে সেখান থেকে ছোট লঞ্চে উঠে কাটাখালি এসে সেখান থেকে মুন্সীগঞ্জ শহর হয়ে মুক্তারপুরে আসেন তারা।
জায়দার ছিল বিকালে আর আবিরের নাইট ডিউটি। দুপুরের আগে আসেন কাশেম আর জামাল। তখন ঘরে ছিল আবির। মা-ও দুপুরে ডিউটিতে যাওয়ার জন্য দ্রুত রান্না করছিলেন। তারা কেমন করে যেন বাড়িটা চিনে এসেছে। হয়তো আবিরের মামার কাছে ঠিকানা জেনেছেন। কাশেম বলেন, বাউজ, আপনেরা গেরাম ছাইড়া এমনে চইলা আইলেন, আমাগো কিছু জানাইলেন না। একদিন গেলেনও না।
আবিরের রাগ উঠে যায় মাথায়। সে কথা বলতে চায় না। জায়দারও কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো না, তবু তার আগে মোকসেদা কথা বলে, কাকা, এই কতা কন কেমনে? আমরা ক্যান এইদেশে আইছি, জানেন তো বালা কইরাই। একদিন তো জিগাইতেও যান নাই।
জায়দা মোকসেদাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন, ঐ ছেমড়ি মুখের উপড়ে কতা কস ক্যান? চুপ কর।
জামাল বলেন, না, ভাবী ও কিন্তু ঠিক কতাই কইছে। কেমনে কী হইয়া গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাইয়েরে কারা মারলো তা টের পাইলাম না।
আবির গোয়েন্দা উপন্যাসের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা মিলাতে থাকে। সে অনেক বই কিনে পড়েছে। তবে যেহেতু তার আয় সীমিত তাই কেনার সাধ্যও কম। রিকাবি বাজারে এক লোক ঘড়ির মেকার। তিনি নাকি কোন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও। বিকালে এসে দোকান খুলে রাত পর্যন্ত এই কাজ করেন। তার দোকানে সেবা প্রকাশনীসহ অনেক প্রকাশনীর বই আছে। সেগুলো সুন্দর করে বাঁধাই করে তিন -শেলফে সাজিয়ে রাখেন। প্রতিটি বই তিনি একটাকা করে একদিনের জন্য ভাড়া দেন। আবির তার দোকান থেকে প্রায় সব বই এনে পড়ে ফেলেছে গত কয়েক মাসে। মাসুদ রানা, কুয়াশা, দস্যু বনহুর, শার্লক হোমস, দুপেঁসহ অনেক গোয়েন্দা উপন্যাস পড়া হয়েছে। এছাড়া ফেলুদা, ঘনাদা, ব্যোমকেশও পড়েছে।
আবির যদি পুলিশে চাকরি পেতো তাহলে বইপড়া এইসব জ্ঞান খাটিয়ে তার বাবার হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে পারতো। এখন তাদের গ্রাম থেকে আসা কাশেম কাকা আর জামাল কাকা যা বলছেন তার মধ্যে নানা ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পুলিশের ক্ষমতা থাকলে সে বালুমহলে দুইদিন ঘোরাফেরা করলেই ধরে ফেলতে পারতো।
কাশেম আর জামাল অনেকক্ষণ ছিলেন। সেদিন জায়দার ডিউটিতে যেতে লেট হয়ে যায়। তারা বলে যান, গেরামে আপনেগো জাগাজমি নাই কিন্তু আমাগো তো আছে। বেড়াইতে যাইতে পারেন না? গেলে কি আমরা ফালাইয়া দিমু।
জামাল আবিরকে বলেন, আসগরতো বড় হইয়া গেছোস ভাইস্তা। তুই তো যাইতে পারোস। যাইস। না গেলে সম্পর্ক থাকে কেমনে?
তারা চলে যাওয়ার পরে জায়দা ডিউটিতে যান। সেদিন আর ঘরে কোনো কথা হয় না। রাতে জায়দা ফেরার আগেই আবির চলে যায় নাইটে। পরদিন সকালে জায়দা বলেন, কিছু বুঝলি কাউলকা তোগো চাচাগো কতায়?
আবির বলে, মা, আমার মোনে অয় এখানে আইয়া তাদের কয়দিন থাকতে হইবো। মোনে হয় তারাও জড়ায় গেছে চর মশুরার লগে।
জায়দা বলেন, তোর জন্মের আগে থেইক্কা চিনিরে। ঘটনা অন্য। ইলেকশনের কয় বছর বাকি আছে?
কোন ইলেকশন? সংসদ নাকি ইউনিয়ন?
ইউনিয়ন ইলেকশনে মোনে অয় জামাল তগো গেরাম থিক্কা খাড়াইবো।
আবির এদিকটা ভাবে নাই। জায়দা বলেন, ভোট পাওনের লেইগ্গা বায়না কইরা রাইখা গেল। বুঝলি?
এখানে আসার পরে আবির বুঝেছে তাদের চর অঞ্চলের রাজনীতি শহর ও এইসব অঞ্চল থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। ওখানে মারামারি হলে বিচারের জন্য উভয়পক্ষ থেকে লাখ লাখ টাকা জামানত রেখে সালিশে, তারপরে টাকাগুলো পকেটে ভরে তোরা মিল্লামিশ্শা থাকিস। নিজেরা মারামারি করলে মাইনষে কী হয়, বোঝোস না? এসব বলে বিবাদ মিটানো হয়। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে কয়েকটা উপদেশ দিয়ে খালাস। যার জান গেছে তো গেছেই, যার ঘর-দুয়ার গেছে তো গেছেই। যার বাপ-ভাই-স্বামী গেছে সেসব নিয়া আর কথাও ওঠে না। যারা সালিশে বসতে না চায়, তাদের জন্য কথা হলো, যাও থানা আছে, কোট-কাচারি আছে মামলা করো বছরের পর বছর ধইরা চালায়া যাও। এক মামলার রায় হতে না হতেই আবার নতুন করে জুইত্তা, কাতরা, সড়কি নিয়া আরেক দফা হয়ে যায়।
অনেকেই বলে, চৌরারা মারামারি না করলে মুন্সীগঞ্জ থানা, কোট-কাচারি আর সদর হাসপাতালের দুয়ারে শেওলা পড়ে যেতো। ওদের কারণেই এই শিক্ষিত পেশাজীবী লোকেরা টিকে আছে।
আবিরের বাবাকে মেরে ফেলার পরে মামলা চালাবে কে? সরকারি তরফে একটা মামলা হয়েছে। তার রায় কী হয়েছে, কখনো জানা হয় নাই। আবির বিষয়টা জানতে চায়। সে আজ মনে করে তার মায়ের পবির্তনের ভেতর কোনো রহস্য আছে। সে যেন মায়ের কথা আর বুঝতে পারছে না। তার মায়ের বয়স তার দ্বিগুণ। তার বয়সের সঙ্গে যুক্ত আছে সমপরিমাণ জীবনের অভিজ্ঞতা। সে বুঝবে কেমন করে?
মা এখন রান্না করেন, খান, ডিউটিতে গিয়ে কাজ করেন, নামাজ পড়েন। মাঝে মাঝে মাজারে গিয়ে পুণ্যবান ব্যক্তির নাম স্মরণ করেন। মুক্তারপুরে একটি মাজার আছে। মনাই ফকির। তিনি নাকি আম গাছের উপরের ডালে চঁিই পেতে ইচা মাছ ধরে এলাকার মানুষদের খাইয়েছেন। কামেল মানুষ। তার মাজারে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে ভেলা ভাসানো উৎসব হয়। স্থানীয়রা বলে ‘বেড়া ভাসানো’। সাত বাড়ি থেকে কলা গাছ আর সাত বাড়ির বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ নিয়ে দোতলা ঘর বানানো হয়। সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ধলেশ্বরী নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। শত শত বছর ধরে এখানে এই উৎসব হয়ে থাকে।
মাজারে ওরস হয়। মেলা হয়। সেখানে বয়াতি গান হয়। আবদুর রহমান বয়াতি আসেন। মাখন সরকার, তার শালী আকলিমা আসেন। তাদের মধ্যে পালা গানও হয়। এখানে আসার আগেও জায়দা কয়েকবার এসেছিলেন আবিরের বাবার সঙ্গে তিনি তো নিজেই প্রায় বয়াতি ছিলেন। শত শত গান ছিল তার মুখস্থ। মেলাটা দিনে দিনে অনেক বড় হচ্ছে। এখন অনেক কিছু বিক্রি হয়।
মুন্সীগঞ্জ শহরে ভাদ্র মাসেই মনসাপূজার সময় দশমীর মেলা হয়। সেই মেলা ভেঙে গেলে মুক্তারপুরে মেলা জমে। মুন্সীগঞ্জে শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রধান খালটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে বালুর মাঠ। বালুর মাঠেই মেলা হয়। আগে হতো ওয়াপদার মাঠের সামনে, রাস্তার পাশে। এখন দর্পণা সিনেমা হল আর নয়াপাড়ার মাঝখানে পুরান রাস্তা আর নতুন বালুর মাঠেল অংশে মেলা বসে। মুন্সীগঞ্জে যত বড় মেলা হয় এখানে তত বড় হয় না। তবে ইদানিং এখানেও বড় হচ্ছে।
মনাই ফকিরের মাজারে মহরম মাসের দশ তারিখে আশুরার দিনেও একটা ছোট উৎসব হয়। সেদিন হাসান-হোসেনের জারি গান হয়। খুব সকালে মুক্তারপুর বাজারের বটচারার নিচে ইমাম হাসানের কবরের প্রতীক হিসাবে বিষের সবুজ রঙের কবর আর ইমাম হোসেনের শহীদের প্রতীক লাল রঙের কবর বানানো হয়। সেখানে আগরবাতি- মোমবাতি দেওয়া হয়।
ভেলা ভাসানো হয় মূলত খোয়াজ খিজিরের নামে। হজরত খিজির আলাইহে ওসাল্লাম নামে একজন নবি আছেন। তিনি পানিতে বাস করেন। মুসা নবির আমল থেকে তিনি পানিতে অমর হয়ে আছেন। বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠের খরার পরে আষাঢ়-শ্রাবণের বৃেিত এই পললবাহিত নি¤œভূমিতে পানি বেশি হয়ে গেলে, বন্যা হলে, দরিদ্র মানুষদের জীবন বিপন্ন হয়ে গেলে খোয়াজ খিজিরের নামে শিরনি দিয়ে ভেলা ভাসানো হয়। তিনি যেন প্রসন্ন হয়ে আল্লাহর কাছে এই বিপন্ন মানুষদের নামে মুশকিল আসানের অনুরোধ করেন। এর পরে পানি কমতে থাকে।
জায়দা বানু মনাই ফকিরের মাজারে গান শুনতে যান। আগে গ্রামের বাড়িতে থাকতে আবিরের বাবার একটা টেপ রেকর্ডার ছিলো। চার ব্যাটারি দিয়ে চালানো হতো। শাহু পাগলার অনেকগুলো ক্যাসেট ছিলো। বয়াতীদের বিচ্ছেদ ও পালাগানের। জায়দাও শুনতেন। টেপটা কোন মেকারের দোকানে মেরামত করানোর জন্য দেওয়ার পরে আর ফিরে পাওয়া যায় নাই।
এখন জায়দার বিনোদন বলে কিছু নাই। আবিরকে বলেছিলেন একটা টেপ কিনতে, আবির কিনে নাই। সে নিজে একলা শোনে ছোট্ট একটা রেডিও কিনেছে। সিগারেটের প্যাকেটের মতো পকেটে রাখে। একটা চিকন তার কানে দিয়ে একলাই গান শোনে। আর কেউ শুনতে পারে না।
মাঝে মাঝে চার ভাইবোনে মিলে লুডু খেলে। আবির ঘরে না থাকলে ওরা জায়দাকেও খেলতে অনুরোধ করে। তিনি খেলেন না। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হয়ে তিনি জীবনের রঙ যেন হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ডিউটি ঠিক রেখে পারলে প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে গিয়ে নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেন, আল্লাহ যেন জীবনের বাকি দিনগুলো সহি-সালামতে রাখেন, এই পুণ্যবান ব্যক্তির উসিলায় সমস্ত মুশকিল থেকে আসান করেন। আমরা পাপী মানুষ। আমাদের অবস্থান আল্লাহর কাছে একেবারেই হয়তো তুচ্ছ। একজন পুণ্যবান ব্যক্তির মাজারে এসে অতীতের ভুলের জন্য আত্মসমর্পণ করে এই নেককার বান্দার নামে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করতেও পারেন। মুশকিল আসানও করতে পারেন।
জায়দার মতো মানুষেরা মনে করেন, কোনো মানুষ অপরাধ করার পরে কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হতে ভয় পায়। কোনো ব্যক্তির সহায়তায়, সুপারিশে গেলে পরিস্থিতি যেমন সহজ হয়। পোলাপানেরা স্কুলে কোনো অন্যায়-অপরাধ করলে মা-বাবাকে যেমন সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চায়, তুমিও লগে লও, নাইলে স্যারে মারবো। ঠিক আল্লাহর কাছেও অপরাধ করলেÑ সে অপরাধ সজ্ঞানে হোক আর অজ্ঞাতসারে হোকÑ কোনো পুণ্যবান সৎ লোকের সাহচর্যে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জীবিত পুণ্যবান ব্যক্তিদের চিনে নিতে অনেক সমস্যা। কামেল লোকদের মাঝে মিশে আছে চতুর্দিকের ভ-রা। তাই মৃত কামেল লোকের মাজারে যাওয়া।
তিনি আরো মুনাজাত করেন জীবনের বাকি দিনগুলো যেন মানসম্মানের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে পারেন। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক পুরুষ মানুষদের সঙ্গে দিন কাটাতে হয়, রাত কাটাতে হয়। নাইট ডিউটি করতে হয়। কত রকমের ঘটনার কথা শোনা যায়। তিনি যে কারখানায় কাজ করেন, সেখানে আগে একজন সুপারভাইজার ছিল, যার সঙ্গে যত বিধবা মহিলাদের সঙ্গে নাকি গোপন সম্পর্কের কথা শোনা যায়। মালিক-ম্যানেজার এসব জেনেও তাকে চাকরিতে রেখেছিলেন। কারণ ঐ সুপারভাইজার নাকি আবার মালিক-ম্যানেজারদের গোপন সম্পর্কের কথা জানতো।
কোনো কোনো ফ্যাক্টরিতে কিছু মহিলা শ্রমিকের অনেক দাপট দেখা যায়। তাদের সবাই ভয় পায়। কারণ যার-তার নামে অভিযোগ করে, হাজিরা কাটিয়ে দেয়। সারাটা রাত ডিউটি করার পরে যদি সকাল বেলা তার হাজিরাটা কাটা যায় তখন কেমন লাগে! এত বড় পাহাড়ের মতো রাতটার সব কাজই বৃথা হয়ে যায়। চরম বিপদের সময় চাকরি খেয়ে দেয়। এইসব মাগি মালিক-ম্যানেজারের কাছে ভালো থাকে। তাগো বেতন অন্যদের থেকে বেশিই থাকে। যখন তখন চাইলেই বেতনের অগ্রিম ‘ভাংতি’ বেতন নিতে পারে। এমনকি হাত পাতলে দুই-চারশো টাকা এমনিতেই পায়। এইসব মাগিরে সবাই ডরায়। এরা তলে তলে মালিক-ম্যানেজারের লগে শোয় নাকি। নাইলে এত পাওয়ার পায় কই? মালিকেরা তাগো কতারে এমন গুরুত্ব দেয় কেন?
জায়দা বানুর চেহারা ভালো না। চর অঞ্চলের রোদে পোড়া কালো রঙ। চেহারাও বেশি সুবিধার না। হাত-পায়ের চেয়ে মুখটা তার বেশি কালো। চিরকাল তার মনে নিজের চেহারা নিয়া আফসোস ছিল। কিন্তু এখানে আসার পরে, কাজে লাগার পরে, মালিক-ম্যানেজার আর সুপারভাইজারদের দৃভিঙ্গি বোঝার পরে তার মনে হয় কালো চেহারা হওয়াতেই তিনি অনেক বিপদ থেকে বেঁচে যাবেন। তার মান-ইজ্জতের ওপর আঘাত আসার সম্ভাবনা অনেক কম। তবুও বলা যায় না, কোন মাগি কোন ধরনের সমস্যার সৃি করে। তাই তিনি সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে ইজ্জতের গ্যারান্টি চান।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-৬॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ