চতুর্থ পর্বের পর:
কিছুক্ষণের জন্য আমার আর কিছু মনে নেই। তারপর অনুভব করলাম গাল বেয়ে যেন একটা ধারা এসে ঠোঁটে মিশলো। রক্ত, নোনতা রক্তের ঘ্রাণ। কেউ একজন আমার চেয়ারটা ধরে উঠিয়ে দেয়।
স্যরি প্রফেসর, আপনার মতো মানুষের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করতে হলো। যদিও আমি আগেই বলেছিলাম, আপনি যা জানেন বলে জাহির করছেন, তা ভুল। আর এই ভুলগুলো যে বা যারা বুখা, অর্ধশিক্ষিতগুলোকে পড়িয়ে পড়িয়ে বিদ্রোহী করে তুলছে সরকারের বিরুদ্ধে, সিস্টেমের বিরুদ্ধে, তারাই আসলে গণতন্ত্রের প্রকৃত শত্রু। আর আমরা শত্রুদের উপযুক্ত পাওনা পরিশোধে বদ্ধপরিকর।
আমি নোনতা রক্তের থুতু ফেল্লাম। সিস্টেম আর গণতন্ত্র!
ইয়েস, ডেমোক্রেসি, অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। কিন্তু সেটি যদি আপনাদের মতো মানুষদের হাতে পড়ে, তাহলে তো সমস্যা। কারণ সব কিছুর ওপরে তো সুপ্রিমিসিকে স্বীকার করে নিতেই হয়।
কিন্তু তোমাদের গণতন্ত্র কি বাকস্বাধীনতার কথা বলে না? কিংবা সিস্টেমের সিস্টেমেটিক সমালোচনা, মেয়েটি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে।
স্পিচ ফ্রিডমেরও একটা লিমিট থাকে মিসেস। প্রফেসর তার লেখায় সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছেন, আমরা নাকি দুষ্কৃতকারীদের হত্যা করে মিথ্যা শুটআউট নাটক সাজাচ্ছি। হিউম্যান রাইটস তাতে মিশে যাচ্ছে ধুলায়। শুধু তাই নয়, প্রফেসরের অভিযোগ, আমরা নাকি এক সময় নিজেদের স্বার্থেই এসব দুষ্কৃতকারীদের লালন করেছি। আবার সুযোগ বুঝে স্বার্থ গোটাতে তাদের নির্বিচারে হত্যা করতেও বাধছে না। কী, আরও শুনতে চান?
আগেই বলেছি, আমি ভুল কিছুই লিখিনি।
গুড, ভেরি গুড প্রফেসর। পলিটিক্যাল সায়েন্সের হিউম্যান রাইটস আর বাস্তব কতটা ভিন্ন, আমরা আপনাকে দেখাব। শুধু জেনে রাখুন, সভ্যতার শুরু থেকেই পৃথিবীতে কোনোদিন হিউম্যান রাইটস ছিল না। ছিল কেবল ক্ষমতা আর তা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বার্থের সুতো। যাই হোক, আশা করি কিছুটা সময় নিজেদের মধ্যে কাটাতে আপনাদের ভালোই লাগবে। হ্যাভ অ্যা নাইস টাইম।
বুটের ঠক ঠক আওয়াজটা দূরে সরে যায়। আমি পেছন থেকে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকি: হেই স্কাউন্ড্রেল, কে তোমরা? মেরে যখন ফেলবেই, তখন বাঁধন খুলে দাও। কাপুরুষ নোংরা নর্দমা কোথাকার। কিন্তু কেউ আমার চিৎকারের ধার ধারে না, কেবল অদ্ভূত একটা শূন্যতা ঝুলে থাকে। নারী কণ্ঠটি আবার খিলখিল শব্দে হেসে ওঠে। কাকে বলছেন? ওরা আমাদের কথা শুনবে না। শুনলে অনেক আগেই শুনতো।
কিন্তু তাই বলে সত্যিই বাক-স্বাধীনতা বলে কিছুই থাকবে না! স্বার্থে টান পড়লে জিহ্বা টেনে ধরবে গণপ্রজাতন্ত্রিক তথাকথিত রাষ্ট্র! ঠিক যেমন মধ্যযুগে ধরা হতো। এমন গণতন্ত্র আর আধুনিকতার গায়ে আমি পেচ্ছাব করি।
প্রফেসর, একটা কথা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই যে এত তত্ত্ব-যুক্তি, এসব দিয়ে সত্যিই কতটুকু উদ্ধার করতে পারবেন জনঅধিকার? আমারতো মনে হয়, দিন যত যাচ্ছে তত প্রত্যক্ষ একটা সশস্ত্র বিপ্লবের অভাবে ক্ষমতাতন্ত্রের বিস্ফোরণে সমাজের ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও চাপা পড়ছে গণতন্ত্র।
কিন্তু কোনো কাজের জন্য তো শুধু গায়েগতরে খাটলেই হয় না। ওই যে বললেন বিপ্লব, আপনারা সশস্ত্র আন্দোলন করে যেন তার একটা সুঠাম রূপ দাঁড় করাতে পারেন, তার জন্যই আমরা তত্ত্ব দিয়ে এর দেহ মজবুত করি।
মেয়ে কণ্ঠটি আবার হাসে। হ্যাঁ, তত্ত্ব দিয়ে অনেক হাতি-ঘোড়া মারা যায়। সেই সঙ্গে একটা আরামদায়ক বিপ্লব বিপ্লব সুখও অনুভব অসম্ভব হয় না। আমার কী মনে হয় জানেন? সভ্যতার শুরু থেকে নিপীড়িত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হতে থাকা মানুষের রক্তমাংসের স্তূপের ওপর কতগুলো মোটা মোটা বই নিয়ে আপনারা ধ্যান করছেন। আসলে আপনারা প্রত্যক্ষভাবে মাঠে নামতে ভয় পান। সাধারণ মানুষ থেকে আপনারা অনেক দূরে। সাধারণরা আপনাদের বোঝে না। হ্যাঁ, আপনারাও বিপ্লবী, তবে মরবার ভয়ে অস্ত্র ফেলে কলম তুলে নেওয়া কলমবাজ।
এবার আমার হাসার পালা। তা ম্যাডাম, এই যে এতক্ষণ জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শোনালেন, সেটাও তো উদ্ভূত কোনো তত্ত্ব থেকেই। আর ওই যে বলেন, ভেতরে খেলা করে পুরনো বারুদ, তাতে ওম দেওয়ার কাজটুকু করি আমরাই।
আমার কথা শেষ হতেই আবার পুরুষ কণ্ঠটির গোঙানি শোনা যায়। প্রথমে খানিকটা ধীর লয়ে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কণ্ঠস্বরটা একটু পর স্পষ্টভাবে বলে: পানি পানি।
ওরা তোমাকে পানি দেবে না। দিলে অনেক আগেই দিতো।
হঠাৎ কণ্ঠস্বরা যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ওঠে। সব শুয়োরের বাচ্চাকে আমি গুলি করে মারব। একবার শুধু রাইফেলটা আমার হাতে পাই।
এরইমধ্যে দুম করে যেন মেয়ে কণ্ঠস্বরটি প্রশ্ন করে: কে আপনি, আর কী হয়েছে গোঙাচ্ছেন কেন?
পুরুষ কণ্ঠস্বরটা আরও তীব্র রোষে ফেটে পড়ে। চুপ কর বেশ্যা মাগী। আমি তোর বাপ হই। লজ্জা লাগে না, ওই কুকুরগুলোর পা চাটতে। সাহস থাকলে আমার চোখ আর হাত খুলে দে…।
আপনার মতো আমাদেরও চোখ আর হাত বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। আমরাও নড়তে পারছি না।
এবার আর পুরুষ কণ্ঠস্বরটি কোনো উত্তর দেয় না। কেবল ঘরের মধ্যে বিশ্রী একটা নীরবতা বাড়তে থাকে। আমরা তিনজনই হয়তো তিন জনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছি। অথচ কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। এভাবে ঠিক কতক্ষণ কাটলো হিসাব নেই। অতপর নীরবতার এই কুয়াশা ভেদ করে পুরুষ কণ্ঠটির শান্ত স্বর শোনা গেলো: ওরা আমার পায়ে গুলি করেছে। বুলেটটা বোধহয় বাম হাঁটুটা একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছি প্রচুর রক্ত বের হচ্ছে ওখান থেকে। কারণ ক্রমেই আরও দুর্বল লাগছে আমার। কেন ওরা আমাকে এখনো মেরে ফেলছে না, কে জানে! আপনাদের অবস্থা কল্পনা করে আমার সেই পুরনো কথা মনে পড়ে গেলো। গ্রামের কথা, বাবা-মার কথা। কতদিন আগে যে সেসব ছেড়ে এসেছি। মারবার আগে আমার বাবা-মাকেও নাকি ওরা এভাবে বেঁধে রেখেছিল তিনদিন। আমি শুনেছি, ওই তিনদিন ওরা তাদের কিছু খেতেও দেয়নি। আমার সন্ধান চায়। শুনেছি ঠিকানা স্বীকার না করায় ওরা বাবার দুই হাতের সব নখ উপড়ে নিয়েছিল।
কিন্তু কে আপনি, ওরা কেন খুঁজছিল আপনাকে?
আমি কে তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আর আমাকে তো খুঁজতেই হবে। তক্তপোষে বিদ্রোহের আগুন লেগে গেলে, সব মহাজনই চায় তা নিভিয়ে ফেলতে। কিন্তু মহাজনরা জানে না, স্বাধীকার আর মুক্তির আগুন ছাই চাপা তুষের মতো। নিভিয়ে ফেললেও ধিকিধিকি ঠিকই জ্বলে। সময় মতো তার স্ফুলিঙ্গ দাবানল ছড়ায়। আমি কিংবা আমরা সেই স্ফুলিঙ্গকে পাহারা দেই। জানেন, আমার বাবা-মা হত্যার প্রতিশোধও নিয়েছিলাম। ওদের দুটোকে ধরে শরীরে ইচ্ছে মতো আঁকিবুকি কেটেছি। তারপর সেই ক্ষতে মিষ্টি তরল ঢেলে দিয়েছিলাম পিঁপড়ার ভাগাড়ে। তবু বিষে নীল হয়ে যাওয়া ও দুটোর মুখ দেখে আমার কষ্ট জুড়োয়নি। গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলাম আরও ১৪ জনের একটা দলকে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। লোকটাকে ঠিক কী বলব, বুঝতে পারছি না। আপনাদের জন্যই আজ এই অবস্থা। নিজেকে মুক্তিকামী দাবি করেন অথচ যুক্তি আর নিয়মের ধার না ধেরে কথা বলেন অস্ত্রের ভাষায়।
পুরুষ কণ্ঠটি চিৎকার করে ওঠে: চুপ কর দালালের বাচ্চা। তোর তো ঘর পোড়েনি, তাই তুই যুক্তি কপচাতে পারছিস। আমার ঘর পুড়েছে, বাবা-মা, সন্তান বেঘোরে মরেছে। ওদের লালসার খোরাক হয়েছে আমার স্ত্রী। কেন, তখন কী দোষ করেছিলাম আমি? তখন তো আমার হাতে অস্ত্র ছিল না। তোর মতোই ঘরের আরামদায়ক শান্তিতে বসে সাহিত্য আর যুক্তির চর্চা করতাম আমি। আমাদের ছোট্ট ঘরটার বাইরে বসন্তের হাওয়ার চাদরে যখন ফুলের রেনু ভেসে আসতো, তখন আমার স্ত্রী গান ধরতো। কিংবা শীতের সেই জুবুথুবু সময়েও আমি বাচ্চাদের নিয়ে আগুন তাপানোর কাঠ ফাড়তাম। কিন্তু কোথায় গেলো সব? অধিকার জানান দিতেই ষড়যন্ত্রের কাণ্ডারি বানিয়ে দিলো। হ্যাঁ, আমি অধিকার চেয়েছিলাম, নিজ ভূমিতে বাস করার, নিজ জমিতে পরিশ্রমের ফসলের অধিকার। কিন্তু তাতো ওরা মেনে নেয়নি। রাতারাতি আমাদের বানিয়ে দেওয়া হলো দেশদ্রোহী। পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো গ্রাম। সমর্থ ছেলেদের নিয়ে যাওয়া হলো বন্দুকের মুখে। সেদিন একরাতে ওরা কতগুলো মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল জানিস? তারপরও আমাকে যুক্তির ধার ধারতে হবে, থু…।
আমি স্বীকার করছি তোমার প্রতি অন্যায় হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তুমিও একই কাজ করতে পারো না। তাহলে ওদের সঙ্গে তোমার পার্থক্য থাকলো কোথায়?
পুরুষ কণ্ঠটির হা হা হাসি শোনা যায়। পরক্ষণেই ও ব্যথায় কাঁতরে ওঠে। কিছুক্ষণ পর আবার নীরবতা স্থান নেয় আমাদের মাঝে। একসময় আবার কণ্ঠস্বরটি বলে: তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো যখন আমি জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিলাম, তখন আমার বয়স আর কতই বা ছিল, বড়জোর ২০ থেকে ২২। গহীন জঙ্গলের ছায়া ছায়া গোপন সবুজের মধ্যে যখন আমার হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন বন্দুক। সেদিনই তাকে বলতে শুনেছিলাম, অধিকার নাকি কখনো এমনি এমনি পাওয়া যায় না। মুখের কথায় কাজ না হলে তা ছিনিয়েই আনতে হয়। অন্তত পৃথিবীর অতীত ইতিহাস তাই বলে। আর এ পথে সর্বনাশ হয়ে ঘোরাফেরা করে ষড়যন্ত্র। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য যদি ষড়যন্ত্র চলে, তবে ক্ষমতা উপড়ে ফেলতেও ষড়যন্ত্র বৈধ।
কিন্তু এটাও জানেন নিশ্চয়, এক ষড়যন্ত্র নীরবে আরেক ষড়যন্ত্রের বীজ বুনে দেয়। এক রক্তপাত আরেক রক্তগঙ্গার ক্ষেত্র তৈরি করে।
শুনুন হে তত্ত্ববাদী জ্ঞানপাপী, পৃথিবীর ইতিহাস যুদ্ধের। রক্ত মৃত্যু এসব খুব মামুলি ব্যাপার। হাম্মু রাব্বির সেই আইনই আসলে সত্য, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ।
আচ্ছা, একটু আগে যে বললেন, গহীন জঙ্গলের কথা। সেখানে কে আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল? কে ছিলেন, আপনার এই অদ্ভূত যুক্তির গুরু?
এমন সময় আবার সেই ঠকঠক বুটের আওয়াজটা স্পষ্ট হয়। এবার আর একটি নয়, মনে হয় অনেক জোড়া বুটের শব্দ মার্চপাস্ট করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। পুরুষ কণ্ঠটি আবার চিৎকার শুরু করে: কাপুরুষের বাচ্চারা, তোদের একটি গুলিতে আমি নেতিয়ে পড়িনি। সাহস থাকলে হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে বুকে গুলি কর।
নারী কণ্ঠটিও প্রশ্ন করে: আমাদের এভাবে কতক্ষণ রাখা হবে জানতে পারি? বুটজুতোটার অবস্থানে হালকা হাসির আওয়াজ আসে। সেখান থেকে আরেকটা কণ্ঠ কথা বলে, খুব বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হবে না মিসেস। বিশেষ করে আপনাকে তো আর বেশি কষ্ট দেবই না। শত হোক আপনার ভেতরে আরেকটা কিছু নড়চড় করছে। তবে প্রফেসর আর ওই লোকটিকে আমাদের আরও কিছুটা সময় দরকার হবে।
পাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠটি চিৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই ধুপ করে একটা শব্দ পাওয়া যায়। তারপর আবার গোঙানির শব্দ।
চলুন মিসেস, আপনার সঙ্গে কাজটা সেরে ফেলি। আশা করি সহযোগিতা করবেন। আর যাওয়ার আগে প্রফেসরকে বিদায় জানাতে ভুলবেন না।
কয়েকটি বুটজুতোর শব্দ নারী কণ্ঠটির দিকে এগিয়ে যায়। ওকে কি অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে! কোথায়? নারী কণ্ঠটি কথা বলে ওঠে: প্রফেসর, আর হয়তো দেখা হবে না। তবু বলি, জীবনের সব ক্ষেত্রে যুক্তি কাজ করে না। কখনো কখনো অন্ধ আবেগ আর প্রতিশোধ স্পৃহাও তাকে চালিত করে। রাশি-রাশি সোনার ফসল কল্পনাতেই সুন্দর। তাকে গোলায় ভরতে মাঠে হাড় নিঙ্ড়ানো ঘাম ঝরাতে হয়। বিদায়…
চলবে…