দ্বিতীয় পর্বে পর:
জানি না, তবে ওদের মনে হয় কোনও উদ্দেশ্য আছে। আজকাল তো ঝোপঝাড়ে, নদীতে কত কাউকেই বেওয়ারিশ হিসেবে পাওয়া যায়! আমাদেরও সময়মতো হয়তো ওরা নিজেদের উদ্দেশ্য জানান দেবে। যাই হোক, আপনাকে ওরা কোথা থেকে ধরে এনেছে, কে আপনি?
নারী কণ্ঠস্বরটার কথার জবাব দেওয়ার আমি আগ্রহ বোধ করলাম না। বরং চাপা একটা আতঙ্ক আর অস্বস্তি এখন ঘিরে ধরতে শুরু করেছে আমাকে। সত্যি, কারা এরা! আর কেনই বা আমাকে ধরে আনা হয়েছে! ঠিক এই সময়ই একটা পুরুষ কণ্ঠের গোঙানি শোনা যায়। প্রথমে খানিকটা ধীর লয়ে এরপর জোরে। যেন নৃশংস কোনো আয়োজন চলছে একটি বন্দি মানুষকে ঘিরে। নারী স্বরটি আবার কথা বলে: বেশ খানিকক্ষণ ধরেই ওই গোঙানিটা শোনা যাচ্ছে। আমি ডেকেছিলাম, কেউ সাড়া দেয়নি। তাই অবশ্য ভেবেছিলাম, আমি আর গোঙানিটা ছাড়া এই ঘরে আর কেউ নেই। এরপর একটু আগে আপনার সাড়া পেলাম।
আহ প্লিজ, ভনিতা করবেন না। চোখ বাঁধা থাকায় বন্দি এই অস্বস্তিটা আমাকে আরও ঘিরে ধরেছে।
আমারও চোখ আর হাত বাঁধা। আর অস্বস্তিকর ভয়টা আমাকেও রেহাই দিচ্ছে না। যেন মরণ একটা একচোখা খোক্ষস হয়ে দাঁত কেলিয়ে ছুটছে আমার সন্তানের পেছনে।
সন্তান! আপনার সঙ্গে কি আপনার সন্তানকেও ধরে আনা হয়েছে?
নারী কণ্ঠস্বরটির দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। যদিও ও এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি, তবু তো আমি ওর অপেক্ষায় আছি। আমি চাই ও জন্ম নেবে খুব ভোরে। যেন ওকে একটা নতুন সুর্য দেখাতে পারি। সেদিনটাতেও সকালটা ছিল আর সব দিনের মতোই। আমি নিয়ম করে আমার বাড়ির লনে বসে পাঁচ মাসের ফুলে ওঠা পেটটাকে গল্প বলছিলাম ওর বাবার। কী করে আমরা এক বসন্ত রাতে নির্জন খামার ঘরে মিলিত হয়েছিলাম। কী করে আমার ভেতর একটা ছোট্ট রক্তপিণ্ড হয়ে ও একটু একটু করে একটা নতুন জীবনে রূপ নিলো। আর কী করে মানুষ খুব সহজে শিখে যায় ছেড়ে যাওয়ার ছল-চাতুরি। সেই মিষ্টি রোদে বসে আমি পেটে হাত বোলাতে-বোলাতে ওকে অভয় দিচ্ছিলাম: আমি তোর মা, আমি তোকে ছেড়ে কখনোই যাব না।
আপনি তাহলে গর্ভবতী!
হ্যাঁ, গত পাঁচ মাস ধরে রক্তপিণ্ডটাকে একটু একটু করে আকার দিচ্ছি আমি। ও ছেলে না কি মেয়ে তা জানি না। তবে এটুকু জানি, এই অনাগত শিশুটি তার বাবার মতো কাপুরুষ হবে না। সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে শক্ত মেরুদণ্ড নিয়েই। সে কথা বলবে মানুষ হয়ে মানুষেরই মতো।
কিন্তু আপনি কী অপরাধ করেছিলেন? আর কেনেই বা এভাবে এ অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে আপনাকে?
আমি জানি না আমার অপরাধ কী। তবে সেই রৌদ্র আলোকিত দিনে দারিও ফো আর ফ্রাঙ্কা রামের একটা পলেটিক্যাল কমেডি থেকে কয়েকটা লাইন পড়ে ওকে শোনানোর পরই হয়তো আনন্দে পেটের ভেতর নড়েচড়ে উঠেছিল কিছু। আর ঠিক তখনই বাসার সামনে একটা গাড়ি এসে থেমেছিল। দু’জন লোক ওই গাড়ি থেকে নেমে আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। আমি না করতেই ওরা জোর খাটায়। এরপর কখন যে হাতের পেশীতে একটা সুঁচ ফোটে টের পাইনি। ব্যস, আর কিছু মনে নেই।
আপনার ক্ষেত্রেও তাহলে সেই একই ঘটনা! কিন্তু আপনার সন্তানের বাবার সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন?
আমার সন্তানের বাবা? হ্যাঁ, নারীর জঠরে সন্তান উৎপাদনের জন্য একজন পুরুষের দরকার হয় বৈকি। হতে পারে সে স্বামী, বন্ধু বা কেউ না। নিছক একটা বিশেষ মুহূর্তের সম্পর্ক। ধরে নিন আমার গর্ভের শিশুটিও তেমনই একটা বৃক্ষের ফল। না, কোনো নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল নয় সে। সেই বৃক্ষের শেকড় গাঁথা ছিলে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের শক্ত বাঁধনে। কিন্তু তাও যে কখনো কখনো আলগা হয় বুঝতে পারিনি। গাছটা যে শেকড়সুদ্দ চাইলে যে কেউ উপড়ে ফেলতে পারে, সেটিও বুঝিনি। এরপরও আমি পথভুলো হইনি। প্রচণ্ড সেই প্রগতিশীল দমকা বাতাস আমাদের উল্টে-পাল্টে নিয়ে চলেছিল নতুন কিছুর সন্ধানে। চোখে তখন দু’জনেরই পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন আর মনে বিশ্বাস। মুহুর্মূহু ফুলঝুরি ঝরতো নতুন নতুন গান, কবিতা, নাটক গল্পের। এরপর একদিন সেই নতুনকে গলা টিপে ধরতে এগিয়ে এলো কতগুলো ঠকঠক বুট জুতো। ওরা নতুন দিনের গান কবিতা নাটকগুলোকে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। বুট জুতোগুলো বলল: আজ থেকে ওরা যা বলবে, তাই আসলে নতুন, বাকি সব পুরনো রদ্দি। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, হাতের মুঠোয় হাত নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু প্রগতিশীলতার ওই বাতাস আমাদের নিয়ে দাঁড় করায় এক মস্ত কালো ঘূর্ণিঝড়ের সামনে। কত অত্যাচার, নিপীড়ন! তবু শরীরের রক্তে রক্তে ওম নেয় পুরনো বারুদ। আমি আঘাত সয়ে সয়ে তবু দাঁতে দাঁত চেপে বলি: না। কিন্তু সে বলতে পারেনি। শুনেছি দমকা বাতাস তাকে নিয়ে ফেলেছে অচেনা এক বিশ্বাস ঘাতকতার জগতে। সেখানে নাকি সে কালো ওই বুটজুতোগুলোকে পালিশ করে চকচকে করার দায়িত্ব নিয়েছে। তাই যখন আমি টের পেলাম, আমার ভেতর অঙ্কুরোদগম শুরু হয়েছে অন্য কোনো প্রাণের, আমি তাকে নিয়ে পালিয়ে এলাম। ওকে আমি নতুনভাবে বড় করব, ও আমার সন্তান। দুঃখিত, আপনি নিশ্চই আমার কথাগুলোকে হেঁয়ালি মনে করছেন।
না, আমি মোটেও তা করছি না। তবে ঠিকই বুঝতে পারছি আমার চোখের ওপর শুধু কালো পর্দাটিই নয়, একইসঙ্গে আরও একটা সাংকেতিক আড়াল আপনি বিছিয়েছেন। দেখুন, আমরা কেউ কাউকে চিনি না। তবে এই দুর্বোধ্য মুহূর্তে নিজেদের সংকটগুলো জানা মনে হয় আমাদের প্রয়োজন।
সংকট! হা হা, কিসের সংকট? চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে এলেই বা কী আর মেরে ফেল্লেই বা কী? আদর্শের মেরুদণ্ডটা যে কত শক্ত তা ওরা জানে না। আমি কেবল ভয় পাই আমার ভেতরের অনাগত শিশুটির জন্য। ওই যে বলেছি, এখনো ভেতরে ওম নেয় পুরনো বারুদ। ঠিক তেমনি আমি আমার অনাগত সন্তানটিকে বারুদ করে গড়ে তুলতে চাই। জানেন,আমার বাড়ির সামনের সবুজ লনটাতে রাতে জোনাকি নামে। ঘরের বাতি নিভিয়ে আমরা সেই জোনাকির আলো-অন্ধকার দেখি। কখনো কখনো আকাশে মস্ত বড় চাঁদ ওঠে। লনের সবুজ ঘাসের আগায় দোল খায় নির্জন। নুহের প্লাবনের মতো জোছনার বন্যা ভাসিয়ে দেয় চারদিক। আমি আমার পেটে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। পেটে হাত বোলাই। কিন্তু কখনো সেই অপরূপ জোছনা বন্যাকে ফুটো করে দিয়ে চলে যায় কোনো কালো ঘোড়া। ওটার পিঠে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর আলখাল্লা পরিহিত এক আরোহী। ওর চোখ দেখা যায় না, মাটিতেও পড়ে না ছায়া। কালো ঘোড়াটা বিশ্রী ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে। যেন বলে: সাবধান, সব সুন্দর কেড়ে নিতে আমি এসেছি। এরপরও আমি ভয় পাই না। আমি পুরনো বারুদকে শোনাই শ্বাপদের জিঘাংসা।
ঠিক সেই সময়েই আবার পুরুষ কণ্ঠের গোঙানিটা শোনা গেলো। যেন কেউ প্রচণ্ড কোনো যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি গোঙানিটার দিকে কান খাড়া করি। এবার যেন দাঁতে দাঁত ঘষে পুরুষ কণ্ঠটা বলতে শুরু করে: চুপ করো, আহ চুপ করো। একবার যদি ফের আমি দাঁড়াতে পারি নিজ পায়ের ভরে, তাহলে তোদের রক্ষা নেই। তোদের আমি নর্দমার বিষ্ঠার চেয়ে বেশি ঘৃণা করি।
নারী কণ্ঠটা এবার ওর সঙ্গে কথা বলে: কাকে চুপ করতে বলছেন, আর আপনি কে, কী হয়েছে?
সে জবাব আমি তোকে দেব না। তোদের কথা শুনতে চাই না আমি। চুপ কর শয়তানের দোসরেরা। আমার রাইফেলটা যদি কাছে থাকতো!
আমাদের মারতে চাইছেন? বাহ বেশ, আপনি মানে, আপনারাই কি আমাদের ধরে এনেছেন?
কিন্তু পুরুষ কণ্ঠটা উত্তর দেওয়ার আগেই কোথাও দরজা খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শোনা গেলো। কয়েকটা বুকের আওয়াজ যেন ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর আবার সেই পুরুষ কণ্ঠটার চিৎকার আর গোঙানি। এভাবে তোরা আমাকে থামিয়ে দিতে পারবি না। বাঁচতে চাইলে আমাকে মেরে ফেল। একসময় যেন গোঙানি আর চিৎকার ধীর হয়ে আসে। বুটের ঠকঠক শব্দগুলো ঘরময় পায়চারি করে। আমি প্রাণপণে বাঁধা হাতদুটিকে খোলার চেষ্টা করি। কিন্তু বাঁধন তবু যেন আরও গেঁড়ে বসে। এবার ঠকঠক শব্দতুলে একটা বুটের আওয়াজ যেন আমার দিকে এগিয়ে আসে। কে, কে তোমরা?
চলবে…