প্রথম পর্বের পর:
তীব্র আলোটা যেন চোখের ওপর গিয়ে স্থির হয়ে আছে। চোখটা খুলতে চেষ্টা করলাম,কিন্তু পারলাম না। শক্ত খসখসে কোনো কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কপালের কোনার দিকটা ব্যথায় টনটন করছে। হঠাৎ করেই স্থান-কালের স্মৃতিশূন্য লাগছে। চোখের ওপর তীব্র ওই আলোতে ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগলো। হাত দুটো নাড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু টের পেলাম ওগুলোও পিছমোড়া করে বাঁধা। একটি টেবিলকে সামনে রেখে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে আমাকে। পা দুটো নাড়াতেই টেবিলটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। আবার কে জানে,ওটা হয়তো টেবিল নয়! কপালের ব্যথাটা এতটাই তীব্র হচ্ছে যে, মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানি বের হয়ে আসছে। আমি চিৎকার করে বলি: কিসের আলো ওটা? আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেনে? কিন্তু কেউ জবাব দেয় না। খানিকক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে নীরবতাটা অনুভব করি।
অবশেষে আমার মনে পড়ছে সব। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে এসেছে। শনিবারের এক ইস্পাত চকচকে দুপুরে ক্যাফেতে মোল্ডারের সঙ্গে বসে কফি খাচ্ছিলাম আমি। পুরো ঘর জুড়ে শান্তিময় একটি শব্দে বাজছে ধ্রুপদি তান। কেবল আমরা দু’জনেই ছিলাম খানিকটা উত্তপ্ত। মোল্ডারটা বড্ড বেশি তর্কপ্রবণ। যেকোনো কথাতেই যুক্তির বিরুদ্ধে একটা পাল্টা যুক্তি সে দাঁড় করাবেই। হোক সেটা অবান্তর,কিন্তু সেটা নিয়ে ও তর্ক করে চলবেই। ওর যুক্তিতে যদি কখনো হেরেও যায়, তর্কের জোরে একটা অপযুক্তির সুঁচ ও ঠিকই ফুটিয়ে দেবে প্রতিপক্ষকে। ও বলে,এতে নাকি প্রতিপক্ষের যুক্তির ধার আরও তীক্ষ্ণ হয়,তাতে লড়াইয়ের প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে আজ কথা হচ্ছিল সেদিনের ভয়াবহ ঘটনাটা নিয়ে। শুধু নিজের আবেগ আর প্রতিশোধপরায়ণতাকে এভাবে চাইলেই কেউ চাপিয়ে দিতে পারে না,এটা অন্যায়। আমার স্বার্থে ঘা লেগেছে,আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি অনুভূতিতে,ব্যস ষড়যন্ত্রের টাকায় কেনা বন্দুকটা লোড করে পথে নেমে গেলাম। আর কবুতরের খাবার ছেটানোর মতো নির্বিচারে ঠাস-ঠাস গুলি করে দিলাম। এতক্ষণ এটা নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না করলেও আমার কথার মধ্যে ওর নিজস্ব বিদ্রোহের খোরাক পেয়ে মোল্ডারও পাল্টা আঘাত শুরু করলো। ততক্ষণে ঘরের ভেতরের ধ্রুপদি তানটা যেন আরেকটু চড়ায় উঠেছে। মোল্ডারও সমান তেজে বল্লো: কেন, তুমি, তোমাদের রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান—সবাই যে তাহলে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র,অধিকারতন্ত্র নামক মতবাদগুলোকে সুঁড়িখানার সস্তা বেশ্যা বানিয়ে ছাড়ছো, তার কী হবে? তোমরা ওই মানুষগুলোকে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে মূল্যবোধ দরকার, তার চর্চা করতে দেবে না, ওর বিশ্বাস স্বপ্নকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে যাবে,আর সে প্রতিবাদ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না! খুঁজে দেখো আজ ওর এই উন্মত্ততার পেছনে কত বঞ্চনা,কষ্ট আর স্বপ্নভঙ্গের জ্বালামুখ লুকিয়ে ছিল। সময়মতো তা ঘৃণার লাভা উদ্গীরণ শুরু করেছে।
দেখো মোল্ডার,তুমি অযথাই ওর পক্ষ নিচ্ছো। ঠিক আছে, আমি মেনে নিলাম যে, তোমার মানবিক,সামাজিক, পারিবারিক,আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে আমরা অবজ্ঞা করেছি। তাই বলে তুমিও অন্যেরটা হরণ করে একই কাজ করবে? দেখো,গণতন্ত্র বা অধিকারতন্ত্র যাই বলো না কেন, তাতেও কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতার একটা সীমা থাকা উচিত। তুমি যত যাই বলো,ওটা উগ্রপন্থা,মানসিক বিকারগ্রস্ততা আর চরম নোংরামিও। মোল্ডার যেন পাল্টা খেকিয়ে উঠলো: বাহ, বাহ! তুমি আজ আমার প্রেমিকাকে ক্ষমতার জোরে বিছানায় নিয়ে যাও, আমাকে আমার বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করো, আমার পরিবারকে অন্ধকারে ঠেলে দাও,আমার ধর্মবিশ্বাস দিয়ে নিজের অন্তর্বাস বানাও,তবু আমাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখেই এর জবাব দিতে হবে! তা আমার সর্বোচ্চ প্রতিবাদ কী হবে?
আমি মোল্ডারের কথার জবাব দিতে যাচ্ছিলাম,কিন্তু হঠাৎ আমাদের দু’জনের পাশে আগাগোড়া কালো স্যুট পরা দু’জন লোক এসে দাঁড়ালো। ঘরের ধ্রুপদি তানের সঙ্গে আমাদের এই দৃশ্যটা কেমন যেন বেখাপ্পা। দু’জন আগন্তুকের চোখেই কালো সানগ্লাস থাকায় চোখ দেখে তাদের উদ্দেশ্য বোঝার উপায় নেই। কারণ দু’জনের চেহারাই ভাবলেশহীন। তারা তাদের কোটের নিচে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দেখালো আমাদের। আপনাদের মধ্যে অধ্যাপক কে? পাথরের মতো শক্ত স্বরে তাদের একজন প্রশ্নটি করলো। সেই শক্ত স্বরটা যেন ঘরের ধ্রুপদি তানটাকে ফুটো করে দিয়ে আমার সামনে এসেই উপস্থিত হলো। আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম,কিন্তু তার আগেই মোল্ডার আমার দিকে আঙুল তুললো। এরা কারা বা আমাকেই কেন খুঁজছে, বুঝতে পারলাম না। হ্যাঁ, আমিই… কিন্তু আপনারা কারা?
আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
কেন, কোথায় যাব?
সেটা গেলেই দেখতে পাবেন। হাতে সময় খুব কম, আশা করি তর্ক বাড়াবেন না। লোকটা ওর কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো। যেন বোঝাতে চাইছে,যেকোনো সময় চাইলেই লুকানো আগ্নেয়াস্ত্রটা বের করতে পারে সে। কিন্তু মোল্ডার রুখে দাঁড়ালো। কারা আপনারা,আর ঠিক কী কারণেই সে আপনাদের সঙ্গে যাবে?
আপনি কে?
আমি মোল্ডার, প্রফেসরের বন্ধু।
আমরা রাষ্ট্রীয় একটি কাজে প্রফেসরকে নিয়ে যেতে এসেছি। ব্যস এরচেয়ে বেশি জানার আপনার প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। আলোচনা শেষে প্রফেসরকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।
কিন্তু আমিতো আপনাদের সঙ্গে এভাবে যাব না। আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা থাকলে বাসায় আসুন।
দেখুন, আপনি কথা না শুনলে আমরা জোর খাটাতে বাধ্য হবো।
মানে, জোর খাটাবে মানে! মগের মুল্লুক নাকি, ইউ স্কাউন্ড্রেল হু আর ইউ? লোকদুটো আমার কথার উত্তর দিলো না। কেবল তাদের একজন এবার প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র বের করলো। আরেকজন কিছু একটা দিয়ে ততক্ষণে প্রচণ্ড জোরে আমার মাথায় আঘাত করলো। তারপর ঠিক কী হয়েছে, আমার আর মনে নেই। এটা কোন জায়গা আর এখানে কিভাবেই বা আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে, তাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। মোল্ডারেরই বা কী হলো? ওই লোকটার আঘাতের কারণেই কি কপালের ডান দিকটা টনটন করছে! আমি আবার চিৎকার করলাম: এই,কে আছ, আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন? হাত খুলে দাও,আমি পানি খাব। ঠিক এরপরই খুব কাছ থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর কথা বলে উঠলো। যেন আচমকা আমাকে চমকে দিয়ে গেলো। চিৎকার করে মনে হয় লাভ নেই,কেউ শুনছে না। পানির জন্য একটু আগে আমিও চিৎকার করেছিলাম। আমি চোখ বাঁধা অবস্থাতেই কণ্ঠস্বরটাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করি: কে? গলাটা আবার শোনা যায়: এখন বুঝতে পারছি আপনাকেও আমার মতো এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। আমি কেউ না,আপনারই মতো একজন। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম: ওরা, মানে কারা?
চলবে…