ঘর, আচ্ছাদন ও জেন সাধুর মুক্তি
আমরা কথা বলছিলাম জেন সাধু মিৎস্যু হিরোকিকে নিয়ে। তাঁর নামের অর্থ হলো ‘অত্যুজ্জ্বল আলোকময়তা’। গত আলোচনায় তোমাদের শুনিয়েছিলাম বাজারের পথে তাঁর নীরবতা অনুসন্ধানের অদ্ভুত গল্পটি। একজন জেন সাধু অতিন্দ্রিয়তার উচ্চতর অবস্থানটিকে পার হতে চান এইরকম অত্যন্ত সংবেদনশীল ও প্রায়োগিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে। জেন সাধকরা নিজেদের পরীক্ষা করেন না এবং অন্যকেও সে পরীক্ষায় ফেলেন না। তাঁরা তাঁদের চমৎকার ও অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের ভেতর মানুষকে যুক্ত করার সুযোগ দেন, যেন মানুষ স্বেচ্ছায় যুক্ত হয় কিংবা না হয় এবং নিজেরা এইসব কর্মকাণ্ড থেকে নিরীক্ষামূলক উপলব্ধির জগতে প্রবেশ করেন। ইন্দ্রিয়পরায়ণতার জান্তব জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়মুক্ত হওয়ার সাধনপ্রণালী জেনরা অন্যভাবে করেন। তারা ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে অতিন্দ্রিয় ভাবাবেশ দ্বারা ধীরে ধীরে রূপান্তর ঘটান।
সাধু তাঁর গত আলোচনার রেশ ধরে কথা বলছিলেন সেই অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত সাধকদের উদ্দেশে, যারা অতিন্দ্রিয় সংবেদনশীলতার পথে আত্মনিয়ন্ত্রণের পাঠ নিচ্ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন—মিৎস্যু হিরোকির জীবন তাঁর নামের মতো ছিল না মোটেই। শৈশব ও তারুণ্য কেটেছিল সীমাহীন ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও উপভোগে। তিরিশ বছরে পা দেবার পর যখন তাঁর বাবা তাঁকে বিয়ে করালেন এক ধনাঢ্য পরিবারের কন্যার সঙ্গে, নববিবাহিতা স্ত্রীর কপটতা ও স্বেচ্ছাচারে তিনি এতটাই মর্মাহত হলেন যে অবশেষে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। হিরোকি এরপর আর ঘরে ফিরে যাননি। তাঁর কোনও সন্তান না থাকায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাবার পথ প্রসারিত হয়। এক দীর্ঘ ও দিশাহীন পরিভ্রমণের পর অবেশেষে উপস্থিত হলেন এক জেন আশ্রমে যেখানে দীর্ঘকাল তিনি বসবাস করেন। পূর্বের গল্পটি ছিল হিরোকির অধ্যাত্মজীবনের মধ্যভাগের, যখন তিনি উচ্চতম স্তরে প্রবেশ করতে সচেষ্ট। আর আজকে যে গল্পটি বলবো সেটি তাঁর শেষদিকের কথা, যখন তিনি অত্যন্ত প্রশান্ত ও বুদ্ধময় সত্তায় পরিণত হওয়ার পথে।
এক সন্ধ্যায় কয়েকজন লোক এলো আশ্রমে, তিনি যে ঘরটিতে বাস করেন, সেখানে। ওই ঘরটিতে কোনো দরজা-জানালাই ছিল না। ওরা এতটাই অবাক হলো যে, আসলেই এখানে কেউ বাস করে কি না, সে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে লাগলো। ওরা ফিরে এলো এবং আশ্রমের ভেতরের বাগানে খুঁজে পেল এক তরুণ সাধুকে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই সাধু আবারও দেখিয়ে বললেন যে, প্রজ্ঞাপরম বুদ্ধময় সত্তা মিৎস্যু হিরোকি ওই ঘরটিতেই থাকেন।
কিন্তু ওতে কোনো জানালা-দুয়ার তো নেই!
তাতে কী হয়েছে? তিনি তো আছেন। আপনারা যদি তাঁর সাথে দেখা করতে চান প্রকৃতই, তবে নিশ্চয় তিনি দেখা করবেন, একটি ঘরের দুয়ার বা জানালা থেকে কী লাভ, যদি মানুষের মনের দুয়ার ও জানালাই বন্ধ থাকে? আপনারা নিজেদের ভেতর খুলে দিন সব দুয়ার ও জানালা, দেখবেন ওই ঘরটিও খুলে যাবে। যান, তিনি আছেন ঘরে, একটু আগেই তাঁকে ঢুকতে দেখেছি।
অত্যন্ত বিস্মিত মনে ওরা সাধু হিরোকির ঘরের দিকে আবার গেল। এবার ওরা দরজা ও জানালা না খুঁজে আন্তরিকতার সাথে ডেকে উঠলো, হে মহান সাধু মিৎসু হিরোকি, আপনি কি ঘরে আছেন?
ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পর কথা ভেসে আসলো—আছি আমি, তোমরা দাঁড়াও, আসছি। দেখা গেলো ওই ঘরটির একটি অংশের আচ্ছাদন সরিয়ে দীর্ঘ সময় পর তিনি বেরিয়ে এলেন। ওরা হতবাক হয়ে দেখলো ঘটনাটি এবং বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো—আপনি তাহলে এভাবেই আচ্ছাদন খুলে বের হন আবার ভেতরে ঢোকেন!
সাধু, ওদের নিয়ে বারান্দার একপাশে একটি মাদুরের ওপর বসলেন, পাশের একটি ছোট জলের গোলাকার পাত্র থেকে এককোষ জল তুলে মুখে ছিটালেন। মুখ মুছতে মুছতে স্মিত হেসে বললেন, এটাই আমার ঘর আর এই হলো সে ঘর হতে বেরোবার ও প্রবেশ করার পদ্ধতি।
কিন্তু কেন?
তোমরা কি ভেবেছ এটি কেবলই আমার থাকবার ঘর? তা নয়। এ আমার মনেরই প্রতিবিম্ব। মনের ভেতরের জানালা ও দুয়ারগুলো আমি সরিয়ে দিয়েছি। কেবল তার আচ্ছাদন রয়েছে। জানালা ও দুয়ার থেকে কী লাভ, যদি তা বন্ধই থাকে প্রয়োজনের সময়? আমাদের মনও তাই। ঠিক যথাসময়ে সে বন্ধ করে দেয় সব জানালা-দুয়ার। এটা একসময় তার অভ্যাসে পরিণত হয়, নিরাপত্তার অজুহাতে। আমি জীবনে অধিকাংশ মানুষকে দেখেছি ঘরে এবং মনের ঘরেও এভাবেই বন্ধ রাখে সব। তাই আমি এসবের বালাই রাখিনি। আমাকে অত্যন্ত কষ্ট করে এখান থেকে বেরুতে হয় ফের প্রবেশ করতে হয়। এই কষ্টটি আমি সহ্য করি কেন? আমি বাহ্য জগতের সঙ্গে জানালা-দুয়ার নয়, অন্তর দিয়েই যোগাযোগ রাখতে চাই। এটা হলো আমার নিবিড়তম যোগাযোগ-চেতনার প্রথম ধাপ।
চলবে…