৭ম পর্বের পর:
নিদারুণ যাতনায় জীবন ভীষণ কঠোর হয়ে উঠলো। মনে হলো প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে। তখন বয়স ৮ কি ৯। ময়নামতির কোল ছাড়লাম। বুঝতে শুরু করার বয়স থেকেই যারা আমার বন্ধু হয়েছিল, যারা ছিল এতকাল আমার আপনারও আপন, তাদেরও ছেড়ে এলাম। দোলন, প্রীতম, মহি, মাইনু, হীরা, মানিক, স্বর্ণা, সুমু, কচি আপা, মুন্নি আপা, রচি রুবা—কারও নাম ভুলতে পারি না। সবুজ মাটির কোল সোনালি রঙ ধানক্ষেতের পাশে নিঝুম রাতের গ্রাম আর আলোর লহরে ঝোলানো সব রাত ফেলে আমি যেন উঠে এসেছি কোনো এক এনসিয়েন্ট সিটিতে। ময়মনসিংহ শহর আজও আমার কাছে ঠিক তেমনি অবাঞ্চিত অপ্রত্যাশিত অসুন্দর। ঘিঞ্জি গলি কাকে বলে! বাড়ির ওপর বাড়ি কাকে বলে! এর বেড রুম থেকে ওর বাড়ির রান্নাঘর দেখা যায়—আমি প্রথম জানলাম। হারিয়ে গেল কুসুম ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে দেখা খোলা আসমান। রাতে কি সন্ধ্যায় বাবার হাতের লাগানো লেবু ফুলের সুবাস। আমার প্রথম ভালোবাসা—ভোর হতেই শিউলীর শরীর কি সুগন্ধ আমার হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল চিরতরে। চারপাশে সবুজ। দূরে উঁচু-উঁচু পাহাড়ের পাশ দিয়ে সর্পিল রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম দলবেঁধে কলোনির ছেলেমেয়েরা। যাওয়ার পথে শিশিরের ছোঁয়া পায়ে লাগতো। একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ কখনো ফেলে দিতো পায়ের কাছে ফেলে যাওয়া বাবুই পাখির বাসা। কখনো পথে কুড়িয়ে নিতাম জাম-বরই কিংবা পড়ে থাকা বাদুড় টিয়েতে খেয়ে যাওয়া পেয়ারা। কখনো পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম জাল ফেলে বছর শেষে ধরে তোলা অসংখ্য জিওল মাছ। আকাশজুড়ে উড়ে চলা চিলসহ নাম না জানা কত-কত পাখির ডাক শুনেছি শুধু ওই স্কুলের পথেই। কত-কত ফুলের ঘ্রাণ এসেছে লালমাইয়ের বাতাস ছড়িয়ে আমার নাকে। কত যে বিশাল হয়েছে আকাশ আমার মাথার ওপরে প্রতিদিন। আর কত যে তারা জমিয়েছে আসর সেই রাতগুলোতে আমার চোখের প্রান্তে।
আজ কিছু নেই। সব ইট-কাঠ-মাটি-কংক্রিট! ময়মনসিংহ পলিটেকনিক কলোনিতে কোয়ার্টার খালি নেই। আমরা একটা আলাদা ভাড়া বাসায় উঠলাম। ব্রাহ্মপল্লী জায়গাটার নাম। খুব সর্পিল গলির চারপাশে সব বাড়ি। আমি অবাক চোখে চেয়ে থাকি। এমন সব? কেমন করে হয়? আমার ছোট্ট মনটা হঠাৎ করে বিশাল কিছু থেকে এসে যেন আটকে পড়লো এক বন্দিশালায়। যতই বের হতে চাই, পারি না। ওই গলি দিয়ে বের হয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। গলির রাস্তাটা পার হয়ে মেইন রোডে পড়তেই দেখি—পাড়ার ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে। অশালীন ইঙ্গিত করে। আজে-বাজে কথা বলে। সব কথার মানেও জানি না তখন। কিন্তু বুঝতে শুরু করি মেয়েদের এমনই শুনতে হয় একা-একা রাস্তা চলাচলে। এটাই নাকি স্বাভাবিক! এটাই নাকি যুগ-যুগ ধরে চলে এসেছে। আমি কাউকে বলতে পারি না আমার কষ্ট। আমি বোঝাতে পারি না আমার বন্দ্ত্বি। মেনে নিতে পারি না ছেলেদের অমন প্রতিদিন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে—’লাভ ইয়্যু’ জাতীয় কথাবার্তা। আমার মন মানে না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। শুধু একটি জায়গা আমি খুব আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি। তা হলো স্কুল। হলি ফ্যামিলি স্কুলে এসে ভর্তি হই ক্লাস ফাইভে। সেখানে যাওয়ার রাস্তাও দুর্গম। বাবা অফিসে। বড় ভাই বিদেশে পড়তে গেছেন। বাকি দুই ভাইয়ের ক্লাস। বোনের স্কুল। মা ঘর সামলান। আমাকে যেতে হয় পাড়ার সব মেয়ের সঙ্গে দলবেঁধে। যাওয়ার পথে ভাঙা-ভাঙা রাস্তা। এখানে-সেখানে ময়লার ঢিবি উঁচু করে রাখা। সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। স্কুলে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। এত-এত রিকশা। এত-এত মানুষ, এত-এত দোকান! দোকানে ঝুলিয়ে রাখা নায়ক- নায়িকার ভিউকার্ড—এ সব পার হয়ে, এ সব ঠেলে-ঠেলে স্কুলে যেতে গিয়ে আমার চোখ ভরে জল আসে—লালমাইয়ের ঘাসের জন্য, ফুলের জন্য, পুকুরের জলের জন্য, নীরবতার জন্য, পাখির ডাকের জন্য, আকাশের নীলের জন্য। আমি সেখানে আসা-যাওয়ার সময় কাঁঠালের মুচি পাড়তাম। বাবার অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পথে পড়ে থাকা কাঠ গোলাপ কুড়িয়ে নিতাম। কখনো অফিসের দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোলাপের কাঁটার আঘাত সয়েও ছিঁড়ে নিতাম গোলাপ। ঘরে ফিরেই স্কুল ড্রেসটা খুলেই বসে পড়তাম ভোরে কুড়িয়ে রেখে যাওয়া শিউলীর মালা গাঁথতে। আর আজ? এ কেমন জীবন মানুষের! হায় হায়! এ কেমন জীবন নারীর! ঘর ছেড়ে পথে পড়লেই দু’পাশে বিশাল-বিশাল বিল্ডিং। রাস্তার দু’পাশে বাজে ছেলেদের দল। আকাশ নেই। বাতাস অবারিত নয়, বন্ধুরাও কেমন যেন কঠিন ইটের মতো। ওই কঠিন পথ পার হয়ে স্কুলের গেইটটা দিয়ে কোনোমতে ভেতরে প্রবেশ করলেই বিশাল খোলা মাঠ। সাদা পোশাকের সিস্টার-মাদার আর ফাদার শিক্ষকরাই হয়ে উঠলেন তখন আমার বেঁচে থাকবার একমাত্র প্রেরণা। কি নরম তাদের কথা! কি আদর তাদের ভাষায়! কি সুন্দর তাদের পড়ানোর ভঙ্গি! কি অপরূপ তাদের জীবন! তাদের কোনো ঘর নেই। তাদের কোনো সংসার নেই। তাদের কোনো সন্তান নেই। তারা পরিচ্ছন্ন। আকাশের মতো ক্লিন। সুন্দরের মতো দারুণ। বিশাল-বিশাল ক্লাসরুমে ঝোলানো মা মেরির ছবি। দেবশিশুদের ছবি। আর ওই যে দূরে গির্জার মাথায় ঝুলছে যিশুর অর্ধমৃত শরীরসমেত ক্রুশ, তাও আমাকে কেমন যেন ভেতর থেকে আকৃষ্ট করতে থাকে।
আমি বাইবেল খুঁজতে থাকি পড়ার জন্য। কিন্তু কাউকে বলতে সাহস হয় না। বেশ কিছুদিন খোঁজাখুঁজি চলে একা-একা, চুপি-চুপি। এর মধ্যে শেষ হয় বছর। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে নামকরা স্কুল বিদ্যাময়ী সরকারি স্কুলে। অসম্ভব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষায় পার হয়ে যাই একবারেই। মার উৎকণ্ঠিত মুখ সুন্দর আর নিশ্চিন্ত দেখায় আমার কাছে। এখানে এসে কিছুটা বেড়ে যায় জীবনের গতি। স্কুলে ঢুকতেই বিশাল মাঠ। মাঠের পাশেই পরিষ্কার কাকচক্ষু জলের পুকুর। বাঁধানো পুকুর ঘাট। পাশেই টালির ছাদের ঘরে হেড মিস্ট্রেজ ফুলরানীর আবাস ভবন। তারই সামনে নানা রঙের ফুলে ভরা ফুলের বাগান যেন মনে বেশ খানিকটা স্বস্তি এনে দেয় আমার। রাণী বিদ্যাময়ীর আবাস ভবনে ক্লাস আমাদের। বিশাল রাজবাড়ির নানা কক্ষ আর কাচারী ঘর বৈঠকখানা সব মিলে স্কুল ঘর। আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার কিশোরী জীবন শেষ হতে শুরু করে। ভেতরে বাস করা নারী নামে আর এক মানুষ জেগে উঠতে থাকে ক্রমশ…। তার শরীর, তার মন, তার কর্ম আর তার ভাবনাগুলো হতে শুরু করে বিকশিত। সঙ্গে-সঙ্গে একের পর এক জটিলতার প্রবেশ জীবনকে করে তোলে ব্যতিব্যস্ত। মনের ভেতর রঙ ছড়াতে শুরু করে নতুন পৃথিবী। সেই রঙের সঙ্গে মিশে যায় কিছু কালিও। নারীর পথ মারাত্মক—তার আভাস পেয়ে যাই শুরুতেই।একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে…।
চলবে…