৬ষ্ঠ পর্বের পর:
সে রাতে আর পড়ায় মন বসে না। একটা গল্পের বই নিয়ে বসি। তাতেও মন বসে না। মনের ভেতর না দেখা রাজকন্যার ছবি আঁকি। মিমিটা দেখতে কেমন? কেমন গায়ের রং? কোথায় হারালো? এই বন-পাহাড়ের রাত একা-একা কী করে কাটাবে ও। যখন মধ্যরাতে বাঘডাস ডাকবে, তক্ষক চেঁচাবে, শেয়াল ডাকবে, তখন সে কার বুকে মুখ লুকাবে। আমার মায়ের মুখটাও সে রাতে থমথমে। কোনো কাজে বুঝি তারও মন বসে না! শাশ্বত মায়ের বুকেও কি এক অদ্ভুত সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। বাকি রাতের কথা কিছুই জানি না। এমন অদ্ভুত ভয় ধরানো রাত, এমন শঙ্কা জড়ানো রাত, আর কখনো লালমাইয়ের বুকে নেমেছিল মনে করতে পারি না। বুকে একটা কষ্ট গেঁথে থাকা রাত। সে রাতে আমি শিউলির ঘ্রাণ পাই না। সে রাতে আমি বাঘডাসের ডাক শুনি না। সে রাতে আমি খেজুরের রসে মাটির কলস ভরে ওঠার আশায় থাকি না।
ভোর হয়। সোনালি রোদ ওঠে বনের কিনারে। দূর পাহাড়ে, বনপথে নতুন পেয়ারা ধরে। টিলার ওপর ছোট্ট ঘরটাও ঝাড়মোছ হয়। জানালা দিয়ে দূরে দেখা যায় তালগাছ তখনো একপায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি দেয় আকাশে। দুপুরে পুকুরে যেতে ইচ্ছে করে না। এত সাধের এপার-ওপার করা পুকুর। উথালপাথাল দুপুর। মন্থর পড়ে থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঘাসের মাঠে খেলতে নামি। হঠাৎ মাঠ থেকে সবাই কোথায়, কী উদ্দেশ্যে যেন দৌড়াতে থাকে। ছোট-বড় সবাই। কিছু না বুঝে আমিও দৌড় দেই সেদিকে। সেখানে গিয়ে থেমে যায়, সব অন্বেষণ সব ভয় সব সন্দেহ। দেখি দিনের শেষে যেখানে সূর্য শুয়েছে পৃথিবীর সিথানজুড়ে। সেখানে শুয়ে আছে মিমি রাজকন্যা। কী সুন্দর তার শরীর। দুধে আলতা গায়ের রং। পূরবীর রাগে যেন আরও বেশি আরক্ত।
আমার দেখা প্রথম মৃত্যু। মিমির মৃত্যু আমার জীবনপ্রবাহে আজও নিদারুণ স্পর্শে জেগে আছে। সেদিন ওর চোখে আমি দারুণ ঘুম দেখেছিলাম। আধাবোজা চোখ অপরূপ রূপে শুয়ে থাকা পাঁচ বছরের মেয়েটা কি অধিকারে এখনো জুড়ে আছে আমার সলাজ-সজল প্রকৃতি, আমার অদ্যোপান্ত যুদ্ধবাজ জীবন। তার সঙ্গে তার মায়ের চাপা কষ্ট এখনো আমার বুকে বেজে চলেছে। সেদিন মিমিকে খোঁজা হয়েছিল সারা কলোনিতে। ঘন পেয়ারা বনে, উঁচু পাহাড়-টিলায় আর আমার ধ্যানপুকুরেও জাল ফেলে। ওর বাবা দারুণ ধার্মিক মানুষ। গিয়েছিলেন তাবলিগে। মা একা ছোট আরও একটি মেয়ে নিয়ে। বাইরে যাওয়া নিষেধ। নারীর কণ্ঠ শুনবে না পরপুরুষ। চেহারা দেখবে না অন্য কেউ। তখন মোবাইল তো দূরের কথা টিঅ্যান্ডটি পাওয়া যেত না। কাকে বলবেন সেই মা, তার পাঁচ বছরের কন্যা সন্তানটি বাড়ি ফেরেনি। কাকে ডাকবেন ‘ভাই, আমার মেয়েটিকে খুঁজে দিন।’ কাকে জানাবেন উৎকণ্ঠা? সেই মা সারাটি দিন মেয়ের খোঁজ না পেয়ে শেষ বেলায় যখন পরাজিত হলো মায়ের মন আজন্ম ঠেসে রাখা ধর্মবোধ কি আচারের কাছে। তখন সব শেষ। তিনি জানেন না। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় কলোনির অন্য মাথায় চলে গেছিল কাঁঠালের মুচি পাড়তে। লাফ দিয়ে মুচি যখন হস্তগত করতে পেরেছিল, তখন অলরেডি পায়ের নিচ থেকে সেপটি ট্যাংকির ঢাকনা সরে গেছে। আর ছোট্ট শরীরটা ঢুকে গেছে সেই ট্যাংকির ভেতর। আমার সারাটা রাত যখন মিমির কথা ভেবে উৎকণ্ঠা, আজ এই বয়সে এই সময়ে এসে ভাবী, মিমির মায়ের সারাটা রাত সেদিন কী করে কেটেছিল? পাশে মিমির বাবা নেই, ভাই নেই, পাড়া-প্রতিবেশী কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলা একদমই নিষেধ, বেশি মেশা নিষেধ পাশের বাসার বেপর্দা নারীর সঙ্গে। সেই নারী আরও একটি তিন বছরের ছো্ট্ট শিশুকন্যাকে বুকে চেপে সারা রাত যখন অজানা শঙ্কায় কাটাচ্ছিলেন, তখন একই এলাকায় তারই খুব কাছে একটি সেপটিট্যাংকে দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতরাতে-কাতরাতে প্রাণ হারিয়েছে তার মিমি। মিমির মৃতদেহ যখন রাখা হয় তার বাড়ির সামনে, আমার তখন বয়স বড়জোর সাত। আমার এখনো মনে পড়ে মিমির মা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ধীর-শান্তচিত্তের অস্থিরতা হয়তো আমার ছোটমন ধরতে পারেনি। বাড়িতে এসে বারবার মাকে বলছিলাম, ‘মা মিমির মা কেন মিমির কাছে এলো না? কেন ওকে আদর করল না ওর মা?’ মা তখন নিশ্চুপ ছিলেন। কেবল তার চোখে গড়িয়ে পড়েছিল জল। আজ জীবনের এত বেলা পার করে এসে বুঝেছি নিষ্ঠুর আচরণ নারী পদে-পদে মেনে নিয়েছে যুগ-যুগ ধরে। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষের জন্য কান্না করা মানা আছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমার লালমাইয়ের কোলের কাছে পূরবীর রাগে কিশোর বেলার সূর্য ডুবে যায়। বাবা ট্রান্সফার হয়ে যান ময়মনসিংহ পলিটেকনিক্যালে।
চলবে…