পর্ব-৪
চিঠির ভাষা বিচ্ছিরি। বিব্রতকর, বিভ্রান্তিকর। বাবা-মায়েরা দিশাহীন। তাদের মেয়েরা আসলে কী করছে! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইছে—বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে অভিভাবকদের ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করতে। তাই অভিভাবকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে—‘আপনার মেয়ে প্রভোস্টকে আটকে রেখেছে তার কার্যালয়ে। মিছিল করেছে। প্রক্টর এসেছিলেন সমোঝতা করতে। মিছিল থেকে প্রক্টরের গায়ে জুতা ছুড়ে মেরেছে। কেন এসব করেছে? কারণ আপনার মেয়ে রাত দশটা বারোটা অবধি বাইরে থাকতে চায়। আপনি কি আপনার মেয়ের এসব কাজ সমর্থন করেন?’ কেউ কেউ তো ভেবেই বসে আছেন, মেয়েকে আর রাখবেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লজ্জায় তাদের মাথা কাটা যাচ্ছে সমাজে। মেয়ে তার বাড়ির পাশের কলেজটিতে পড়ুক তা-ও ভালো। অভিভাবক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আত্মীয়দের এটা-ওটা প্রশ্নবাণ। ততদিনে সব জাতীয় দৈনিকে ১১ জনের নামসহ খবর ছাপা হয়ে গেছে। অনেক অভিভাবক খবরটি লুকিয়ে রাখতে গিয়েও পারছেন না। কারণ পত্রিকার পাতা মারফত আত্মীয়টিও জেনে গেছেন মেয়ের ’নষ্টামীর’ খবর। কিন্তু সব চেয়ে মজার কথা—এই ১১ জনের মধ্যে একজনের নাম আছে, যে সেদিন হলেই ছিল না। তার রুমমেট তো পত্রিকায় পাতায় তার নাম দেখে অবাক। কারণ রুমমেটটি জানে, সেদিন ওই ছাত্রী লোকাল গার্জিয়ানের বাড়িতে থাকবে বলে এপ্লিকেশন করে হাউজ টিউটরকে দিয়ে এপ্রুভ করিয়ে নিয়ে গেছে। ওই এপ্লিকেশনটি উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও হাউজ টিউটরের রুম থেকে সন্ধ্যার রোলকলের খাতাটি ঠিকই আমরা চুরি করে ফেলি প্রমাণ রাখার জন্য। ঠিক এ সময় সময় উদারপন্থী শিক্ষকরাও ক্লাস লেকচারের সময় শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি তখন আমাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। একাত্মতা ঘোষণা করেছেন আরও কয়েকজন উদারপন্থী শিক্ষকও।
এদিকে, চারপাশে খুব আলোচনা চলছে–রাত-বিরাতে ছাত্রীরা হলের বাইরে থাকলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। একমাত্র এই অজুহাতটিই তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রাণপণে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ শব্দযুগলের একটু ব্যাখ্যা দরকার। নারীর নিরাপত্তা বলতে একটা বিষয়কেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে দেখা হয়। তা ছিল নারীর শ্লীলতাহানি। তখন এর মানে ছিল—নারীর ওড়না ধরে টানলেও নারীর শ্লীলতা হানি হয়, নারীকে যৌনহয়রানি করলেও কিংবা জোর করে নারীর সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক করলে, সেটাও হয় শ্লীলতাহানি। এ প্রসঙ্গে ক্লাসে হুমায়ুন আজাদের ক’টা কথা আমার খুব মনে পড়ে। স্যার বলতেন, ‘শ্লীল’ মানে সুন্দর। আর ‘শ্লীলতা’ মানে সৌন্দর্য। একজন নারীর সৌন্দর্য যখন নষ্ট হয় একজন পুরুষের কারণে, তখন কি একইসঙ্গে একজন পুরুষরেও সৌন্দর্যহানি হয় না? একজন পুরুষরেও কি শ্লীলতাহানি হয় না? তোমরা কি ভেবেছ কখনো এমন করে?’ ছেলেমেয়েরো পাশাপাশি একসঙ্গে বসে থাকে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে-সেখানে, সন্ধ্যায় হল গেট খোলা থাকলে না জানি তারা আরও কী কী করবে—এসব চিন্তায় যেন নাওয়া-খাওয়াই ভুলে যেতেন শিক্ষকরা। রোকেয়া হলের প্রক্টর বলছেন, ছাত্রী হলগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যখন ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে থাকে, তা দেখে তার মেয়ে প্রশ্ন জাগে ‘বাবা ওরা কী করছে’। আর একথা মনে হতেই লজ্জায় তার মাথা হেঁট হয়ে যায়। আসলে দিনদুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে-মাঠে-লনে, শামসুন্নাহার হলের সামনের লনে, রোকেয়া হলের সামনে, হাকিম চত্বরের সামনে কিংবা টিএসসিতে এত লোক সমাগমে ছাত্রছাত্রীরা বসে কী-ই বা করতে পারে—একজন স্বাভাবিক মানুষ কি তা জানেন না? যারা এসব জায়গায় বসে, তাদের সবাই কি প্রেমিক-প্রেমিকা? তাদের বেশির ভাগই বন্ধু-সহপাঠী। আর কিছুই নয়।
একদিন জহুরুল হক হলে দিন-দুপুরে ঘটে যায় একটি মিসহ্যাপস্। বন্ধুর হাতে নারীর শ্লিলতাহানি! ঠিক এমন সময়েই কোনো এক শিক্ষকের রুম থেকে টিউটোরিয়াল ক্লাস করতে গিয়ে নাকি ছাত্রী কাঁদতে-কাঁদতে বের হয়ে আসে শিক্ষকের হাতে এবিউমেন্টের স্বীকার হয়ে। তবু নির্লজ্জ প্রশাসন একই দোহাই দিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত আইনটিকে পরিমার্জনের বিষয়ে। তখন মিছিল নেমে এসেছে, রাজপথে। কলাভবনে অপরাজেয় বাংলায়, আম্রকাননে কিংবা টিএসসি সড়ক দ্বীপে (এখন যেখানে রাজু ভাস্কর্য)। যখন-তখন চলছে ছাত্রীদের শান্তিপ্রিয় অবস্থান। একদিন মিছিলে হঠাৎ অতর্কিতে আক্রমণ। ছাত্রীদের মিছিলে ছাত্রদের প্রকাশ্যে হামলা। প্রকাশিত হয়ে গেল তৎকালীন প্রগতিবিরোধী ছাত্ররাজনীতির কুৎসিত একটি দিক। ছাত্রলীগ আর বাম ছাত্রদলগুলো যখন আমাদের সর্বাত্মক সাহায্য করে চলছে, আমাদের মিছিলে যুক্ত হচ্ছে, তখনই সুযোগটি কাজে লাগালো তৎকালীন সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন। ন্যাক্কারজনকভাবে মেয়েদের মিছিলে ওড়না টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো। রোকেয়া হলের সামনের মিছিল থেকে ছাত্রীদের হাত ধরে টেনে হাকিম চত্বরে নিয়ে লাথি-থাপ্পড়ও মারা হলো। পত্রিকাগুলো ছেয়ে গেল এসব খবরে। সারাদেশে তখন ছড়িয়ে পড়েছে এসব খবর। বিশ্ববিদ্যালয় অথোরিটির একমাত্র চিন্তা যখন ছন্ধ্যা ছয়টার পর বাইরে থাকলে ছাত্রীদের নিরাপত্তা হানি হবে, তখন ছাত্রীদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ লেলিয়ে দিল আজ্ঞাবহ একদল ছাত্রকে। অথচ একজন ছাত্রীর লাইব্রেরি ওয়ার্কটা যখন খুব জরুরি, তখন তার জন্য কোনো দ্বিতীয় চিন্তা কর্তৃপক্ষের নেই। আর যখন সন্ধ্যার পর ছাত্রীদের বাইরে থাকার কারণে নিরাপত্তাহীনতার জন্য এতই উদগ্রীব, তখন কর্তৃপক্ষেরই মদদপুষ্ট একদল ছাত্রের এমন অমানবিক আচরণের জন্য কোনো জবাবদিহি চাওয়া হলো না। বরং ব্ল্যাকলিস্টেড ১১ জন ছাত্রীকে ডাকা হলো ভিসির বাসায়। ছাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজন-একজন করে ঢুকতে বাধ্য করা হলো রুদ্ধদ্বার কক্ষে। চলবে…
মন্তব্য