প্রশাসন শুরু করলো টালবাহানা। প্রশাসনের যুক্তি—রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত ছাত্রীহলের গেট খোলা থাকলে নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সান্ধ্য আইন পরিবর্তনের বেলায় নারীর নিরাপত্তা নিয়ে অনেক ভাবনা প্রশাসনের। কিন্তু একজন ছাত্রী রাস্তায় গাড়ি বিকল হলে বা রাস্তায় জ্যাম থাকলে হলে ফিরতে দেরি হলে, তাকে আর ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাকে ফিরে যেতে বলা হয়। ওই ছাত্রী হলে ঢুকতে না পেরে রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়লো কি না, এই নিয়ে প্রশাসনের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। ধীরে-ধীরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হতে থাকে। এরপরও যারা পথপ্রদর্শক ছিলেন যথেষ্ট স্থিতধী এবং মেধাবী ছাত্রী। বলতে দ্বিধা নেই ওই সময়টায় প্রশাসনের চেয়ে বেশি স্থির মাথায় কাজ করছিলাম আমরা। আমাদের লক্ষ্য ছিল দু’টি। এক. কোনোভাবেই এ আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া যাবে না। কারণ এটি উদ্ভূত হয়েছিল সাধারণ ছাত্রীদের মধ্য থেকে। দুই. খুব ঠাণ্ডা আর শান্তিপ্রিয় পরিবেশ তৈরি করে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ১৯২২ সালের সূর্যাস্ত আইনটিকে পরিমার্জন আর পরিবর্তন করে ১৯৯৫ সালের প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট করে নেওয়া। যার জন্য অনেক ঝামেলার বিষয় অবশ্য আছে। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বুঝিয়ে এরপর সিন্ডিকেট আর সিনেটের মিটিং এরেঞ্জ করে আইন পাস করা। পরবর্তী বিষয়গুলো একেবারেরই গৌণ। তাই আমরা প্রথম থেকেই পজেটিভ এডিচ্যুডে আগাবো। ঠিক হলো খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমরা যাব লিখিত একটি স্মারকলিপি নিয়ে ভিসির কার্যালয়ে। সরাসরি দেখা করে সূর্যাস্ত আইন ও আরও আনুষঙ্গিক বিষয়ে আমরা স্যারের সঙ্গে কথা বলে স্মারকলিপিটি স্যারকে দিয়ে আসব বিবেচনা করে সিন্ডিকেটের সঙ্গে আলোচনার জন্য। এ জন্য কয়েকজন জাঁদরেল ছাত্রীকে নির্বাচিত করা আছে সাধারণ ছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ, দারুণ মেধাবী, দোর্দণ্ড তার প্রতাপ। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলপন্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি বরাবরই লাল-নীল-সাদা প্যানেলে বিভক্ত থাকে—এ কথা তো সবারই জানা। কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, নিপা ভবন কয়েক পাক ঘুরে মিছিলটি যখন রেজিস্টার্ড বিল্ডিংয়ে ভিসি কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হয়, তখন নির্বাচিত ছাত্রীদের স্যারের রুমে ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা কার্যালয়ের সামনে কলাসিপল্ গেট তালা দিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর বাইরে এসে দাঁড়ালেন ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে। বস্তুত ঘটনা আর বিষয়টি বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল থেকেই উদ্ভূত। কারণ রোকেয়া শামসুন্নাহারের চেয়ে দূরে থাকবার কারণে মৈত্রী হলের মেয়েরা সুবিধাবঞ্চিত হতো বেশি। সান্ধ্য আইনের যান্ত্রণায় ঝামেলাও পোহাতে হতো তাদেরই বেশি। তবু এই সময়টাতে রোকেয়া হল আর শামসুন্নাহার হল আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। যদিও পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে মতবিরোধ ঘটে। ঘটনার বিশ বছর পর এই তো সেদিন কিডস্ চ্যানেলের ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের আফিসে আমার সঙ্গে দেখা হলো ওই সময়ের শামসুন্নাহার হলের এক নারী নেত্রীর সঙ্গে। যিনি এত বছর পরও দাবি করছেন, ঘটনার সূত্রপাত তাদের হাতে। তাদের কারণেই বিষয়টি সফলতার মুখ দেখেছে। এই সফলতার ফসল ঘরে তুলবার দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছে পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে। সে কথায় আসব প্রসঙ্গক্রমে। তো প্রথমেই ছাত্রীরা ধাক্কা খেল। ভাবনা ছিল, স্যার হয়তো দুই-একজনকে রুমে ডেকে কথা বলবেন। কিন্তু স্যার শুরুতেই ছাত্রীদের সঙ্গে যে অপমানজনক ব্যবহার করেছেন, তাতে তারা কতটা আহত হয়েছে, তা বোধ করি তিনি আজও অনুভব করতে পারেননি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার এক ফাঁকে আনকনভিন্সিবল্ ভাইস চ্যান্সেলর ভীষণ রেগে গিয়ে দারুণ অশালীনভাবে ধমকে উঠলেন। তার ধমকের ভাষাটি ছিল এই রকম: এই মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কি তোমার চোখ ফুটে গেছে না কি?
চিরকালের ক্ষমতাধর ক্ষমতার অপব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় আর অধঃস্তনের নমঃ নমঃ মেনে নিতে নিতে এমন বিশ্বস্ত ধারণায় পৌঁছে গেছিলেন যে এই ধমক খেয়ে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অংশটি মাথা নত করে ফিরে যাবে আপন খোঁয়াড়ে। তিনি বোধহয় বুঝতে পারেননি মানবতার কোনো জায়গাটিতে আঘাত করেছেন। প্রতিটি ছাত্রী আর প্রতিটি নারীর ভেতর বাস করা মানুষের কোনো সম্পদটিকে নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন।ছাত্রী উত্তর দিলেন: স্যার। আপনি কী করে আশা করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে একজন ছাত্রীর চোখ বন্ধ থাকবে?
পেছনে তখন শতশত ছাত্রী দাঁড়ানো। পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশাল অংশ প্রত্যক্ষ করলো একজন অবিবেচক ভাইস চ্যান্সেলরের অশালীন ব্যবহার। নারীর নিজের গর্বিত উচ্চারণের ভেতর দিয়ে মনুষত্বের ঘোষণা। এই মুহূর্তে সে নারীর নামটি উচ্চারণ করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু লেখাটিকে জড়িয়ে কোনো রকম জটিলতা হোক, তা আমি চাই না।
আসলে আমি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সূযাস্ত আইন’নিয়ে লিখতে বসিনি। লিখছি নারীর সামগ্রিক বিষয় নিয়ে। কিন্তু আমার জীবনপ্রবাহে এই প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে লিখলে বেশ খানিকটা অসম্পূ্র্ণ রয়ে যাবে। তাই এই বিষয়টির অবতারণা। প্রশাসনের কাছে কোনো ধরনের আশ্বাস পাওয়ার বদলে এসব অপমানজনক ব্যবহার আমাদের হজম হলো না। আমার পথপ্রদর্শকদের এবারের ডিসিশন হলো, বিষয়টি জানানো দরকার দেশবাসীকে। দরকার জনমত গঠন করা। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক, মুক্তবুদ্ধির চর্চারত দেশের জ্ঞানী-গুণী এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে জানানো। ডাকা হলো সংবাদ সম্মেলন। মধুর ক্যান্টিনে প্রথম সংবাদ সম্মেলন। দেশের প্রথম শ্রেণীর সব পত্রিকায় পরের দিন ছবিসহ সংবাদ সম্মেলনের ছবি আর ঘটনা। ছাত্রীদের দাবিসহ ঘটনার বিশদ খবর প্রকাশিত হলো। নড়েচড়ে বসলো প্রশাসন। ছাত্রীরা সাপোর্ট পেল মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল উদার শিক্ষকের। সাপোর্ট পেল ছাত্রলীগ ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর; শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও। তখন আন্দোলন রাজপথে নেমে এলো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুরু করলো আমাদের ফাঁদে ফেলার নতুন প্রহসন। আমরা ১১জন ব্ল্যাক লিস্টেড। শোকজ নোটিশ পাঠানো হলো হলে আমাদের নামে, সঙ্গে তার কপি গেল ডিপার্টমেন্টে, বাবা-মায়ের কাছে। আর হলের প্রভোস্টের কাছে। শুরু হলো আরও এক নতুন অধ্যায়।
চলবে…