॥পর্ব-২৭॥
এখানে পড়েছি অনেক কবিতা। জেনেছি জীবনের অনেক গুঢ় কথা। এখানে শিখেছি প্রচুর ভাষা।জীবনের কঠিন চর্চা। দেখেছি এখান থেকে শিল্পের গভীরতম বোধ। দেখতে শিখেছি রাজনীতি। বুঝতে শুরু করেছি আন্দোলন। শিল্প সাহিত্য আর আবৃত্তির কঠিন গভীর জটিল গ্রন্থিল যাত্রাপথ এখানে স্পষ্ট হয়েছে আমার কাছে। এখানে জেনেছি মানুষ ও কবির তফাৎ। জেনেছি কবিতা আর আবৃত্তিকার। তাদের দূরত্ব ও নৈকট্য। জেনেছি কবিতা নর, নারী আর প্রেমের জটিল কুটিল অবস্থান। জীবনের দীনতা ঋদ্ধতা অসহায়তা আর ভালোবাসাও। শিখেছি কবিতার শব্দ দেহ আর আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ। এখানে শিখেছি কবিতার ভেতর-কবিতার বাহির-কবি ও কবিতার ভাঙন আর গড়ার ইতিহাস। কবির গভীর চিন্তা-ভাবনা জীবনদর্শন রাজনীতি বিরহ আস্ফালন এখানেই দেখেছি। দেখেছি দ্রোহ আার প্রেমের জটিল যাপন প্রণালী। পড়েছি এখানেই অসংখ্য কবিতা। করেছি কত না কত কবিতার ডিসেক্সশন। এখানেই কবিতার সঙ্গে দীর্ঘ এক যাপনে উপলব্ধি করতে পেরেছি প্রথম কবিতা মানবের যাপনেরই ইতিহাস। কবিতাই জীবন। কবিতাই প্রেম। কবিতাই সেই সর্বোচ্চ মহত্তম এক শিল্পবোধ। যা নিয়ে চলে ঘোরে-বেঘোরে এক সাবলিমিশনে মানব জীবনকে। এক দীর্ঘতম যাত্রার এ পথ—কবিতা। সেই থেকে কবিতার সঙ্গে আমারও যাপন শুরু। নির্মাণের সঙ্গে পথচলা। তখনো লিখতে শুরু করিনি তেমন করে। লেখার গভীর বোধ তখনো সংঘবদ্ধ কিংবা সুগভীর হয়ে ওঠেনি। আজ বুঝি তখন কেবল করেছি আস্বাদন। আমি কেনই বা আমিই কেন। এত গভীরে করেছি সে সময় যাপন একাকী নিজেরই ভেতরে। আজ লিখতে বসে বুঝি তার সব। বুকের গভীরে যে নিনাদ তারে কত যত্নে করতে শিখেছি লালন। সে তো এই কবিতারই ঘোরে। শব্দে-বাক্যে আর শিল্পবাসনায় চিরকালের আরাধনায় আমি পেয়েছি এক অজানিত লব্ধ অদ্ভুত এক মহাসম্মিলন। যেখান থেকে উৎসরিত হয় জল। যেখানে জীবন নুয়ে পড়ে ভালোবাসায়। যেখানে প্রস্ফুটিত হয় বেদনার গাঢ় এক গভীর ফুল। যেখানে বাসা বেধে রয় যাতনার কালো সব মেঘদল। কোনো একদিন শরতের আকাশে তুলো তুলো ঘন মেঘ হয় উড়বে বলে।
অসাধারণ এক স্বৈরশাসক ছিলেন আমার আবৃত্তির গুরু মাহিদুল ইসলাম। স্রোত আবৃত্তি সংসদের প্রেসিডেন্ট। মানুষ হিসেবেও ছিলেন দারুণ। কিছুকাল আগে মাত্র আলো ভাবীর সঙ্গে তখন নতুন জীবন শুরু করেছেন। মাহিদুল ইসলামকে আমি পেয়েছিলাম একজন অসাধারণ গুরু হিসেবেও। তিনি শিখিয়েছিলেন আবৃত্তি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এরই সঙ্গে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন সময়ানুবর্তিতার এক চরম শৃঙ্খল। অন্তত আমার জীবনে। সময়ানুবর্তিতার চূড়ান্ত অনুশীলন তিনিই করিয়ে নিয়েছেন ওই সময়ে। যা পরে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সাংসারিক আর কর্মজীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। আজও। সকাল সাতটায় ওয়ার্কশপ শুরু। সাতটা পাঁচেও ওয়ার্কশপে প্রবেশ করা যাবে না। বেশ কয়েকদিনই ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার পর আর ক্লাসরুমে প্রবেশ না করতে পেরে শর্বরী ছেড়ে দিল আবৃত্তির ক্লাস। আমি হয়ে গেলাম একা। একা এবং নিঃসঙ্গ আমি। কবিতায় পেলাম অমোঘ আশ্রয়। কত যে কবিতা নিয়ে কাজ করেছি তখন। কিন্তু খুব বেশি একটা স্টেজ করা হতো না আমার। হতো না তার কারণ ছিল সে। প্রায়ই হুট্হাট্ চলে আসতো ঢাকায়। আর আমাকে টেনে আনতো হল ছেড়ে বাইরে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে একসঙ্গে সময় যাপন। কোথায় হারিয়ে যায় আবৃত্তির ক্লাস। কোথায় হারায় কবিতা আমার। তার লেখা অসাধারণ সব কবিতা আর চিঠি আজ গুছিয়ে রাখতে পারলে দারুণ এক প্রেমের উপাখ্যান লেখা হতে পারতো। নির্দ্বিধায় বলতে পারি আজও। এত এত বছর পেরিয়ে এসেও।
খুব দ্রুতই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল বের হলো। আর এনথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তিও হয়ে গেল সে। শুরু হলো নতুন আর এক জার্নি। ক্লাস শুরু হওয়ার আগ অবধি সে ঢাকা জগন্নাথ হলে বাস করে। চলাচল তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। যখন-তখন কলাভবনে এসে আড্ডায় বসে যায়। আমার বন্ধুদের সবার সঙ্গে তার পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ডিপার্টমেন্টের বন্ধু রিনি সেবা শ্যামা জহির টুলু দোলন চিনু পলি জলি সাগর ওদের সঙ্গেও বেশ সখ্য গড়ে ওঠে তার। আমি মনে মনে ভাবি, সেই মেয়েটির কথা। সে আছে তার সঙ্গে! সে কি আছে! সে কি নেই! মুখ ফুটে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না। কিন্তু মনে মনে কৌতূহল আমার রয়েই যায়। প্রতিদিন এভাবে রোজ রোজ দেখা। রোজ রোজ কথা। রোজ রোজ ঘোরা। এখানে সেখানে। এভাবেই গভীরতা বাড়ে প্রেমে। এভাবেই সখ্য বাড়ে আমাদের জীবনের। আমাদের চলাচলের। আমাদের যুক্ত পথের। আমার কাজ তখন ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। কলাভবনের ক্লাস শেষে এখানে সেখানে আড্ডা আমার খুব একটা হতো না। তাই ডিপার্টমেন্ট কিংবা কলাভবনে আমার বন্ধু হয়নি তেমন কোনো। প্রায়ই বাংলা ডিপার্টমেন্টে ক্লাসঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাসে এসে ঢুকবেন হুমায়ুন আজাদ স্যার। গ্রীষ্মের জ্বলজ্বলে দুপুরে দূরে দেখা যাচ্ছে স্যারকেও। ডানদিকে মল চত্বর পেরিয়ে ছোট গেটটা পার হয়ে হুমায়ুন আজাদ স্যার এসে ঢুকেছেন মাত্র অপরাজেয় বাংলার ডান পাশ দিয়ে। এই গণগণে গ্রীষ্মের দুপুরে স্যারের গায়ে ঝা চকমকে কমলা রঙের টিশার্ট নীল প্যান্ট আর সাদা কেডসে হিরো হিরো ভাব নিয়ে স্যার আসছেন। ঢুকবেন এক্ষুণি এসে ফনেটিক্সের ক্লাসে। আর তখনই সামনে তাকিয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছে দূরে আমার কবি। হাতের ঈশারায় ডাকছে নেমে আসতে। কলাভবনে অপরাজেয় বাংলার ঠিক পেছনেই বাংলা বিভাগ। ওখানেই করিডোরে বারান্দায় দুটো ক্লাসের ফাঁকে আমরা বন্ধুরা দাঁড়াই গল্প করি। পরের ক্লাসে স্যার ঢোকার অপেক্ষায়। আমি একবার তাকাই হুমায়ুন আজাদ স্যারের হেঁটে আসার পথের দিকে, আর একবার দূরে তার দিকে। তারপর ক্লাস বাদ দেব সিদ্ধান্ত নিয়ে নেমে আসি। কলাভবনের মূল গেট দিয়ে একেবারে নিচে।
প্রথমবারের মতো আমি ক্লাস ফাঁকি দিতে শুরু করি। আর সেই থেকে শুরু আমার জীবনেরও জটিল ফাঁকির পথ চলা। সুহাসিনীর কথা আসে না। কথা ওঠে না। আমিও বিষণ্নতার ভয় পাই। হারানোর ভয় পাই। সহজে তুলি না তার কথা। দিন যায় এভাবেই। আমরা আরও ঘনিষ্ঠ আর একাগ্র। তারপর একদিন খুঁজে পাই সেই হারিয়ে যাওয়া এককপি ছবি। তারই কাছে ছিল। তার পেছনে লেখা একটি কবিতার কিছু পঙ্ক্তি। এখনো আছে খুব কাছে। সযতনে। নীরবে কখনো দেখি। আবার কখনো দেখি না। বুকের গভীরে রক্ত চুইয়ে পড়ে। আজও সেই ছবির পেছনের সেই কথা হাতে ধরা যখন লিখছি এই কাহিনী…
১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২
দুঃখ জাগানিয়া হে…
আমার শূন্য পাত্রে হঠাৎ স্বর্গসুধা দাত্রী
কেন যে হৃদয় খুললে…
কেন ব্যাথার সমুদ্র মন্থন
বড় অসময়ে, কেন যে স্বপ্নের অকাল প্রয়াণ
কেনই বা রঙিন পালকের মতো
উচ্ছ্বাসের নিঃশব্দ মৃত্যু, চুপচাপ। কী কারণে
বিষণ্ন প্রহর যাপন একাকী পথ চলা
মিতালি কষ্টের সঙ্গে অথবা
প্রগাঢ় অন্ধকারে আপন সত্তা আবিষ্কার?
কেন? কেন?
সখা হে, দুঃখ ভুলানিয়া, বুঝেছি
কী মধুর রক্তপাতের নাম
কী প্রচণ্ড নীল সুখের প্রতিশব্দ
ভালোবাসা…
তারপর আর নতুন কোনো কথা নয়। নয় পুরাতন কোনো ভাঙা প্রেমের যাতনা। আমি হলে ফিরে আসি। আর আমার স্যান্যাল দার নির্দেশে রিং ফিঙ্গারে পড়ে থাকা সেই আংটিটি খুলে ফেলে দেই। আর কোনোদিন পরি না সে আংটি…
চলবে…