একুশ
আমি সারাদিন একা একা ঘুরে বেড়াই। বাংলাদেশে কুয়েত মৈত্রী হল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ছোট ছাত্রী হল। এখানেই শুরু হলো একা একা প্রথম জীবন আমার । দু’টো পাঁচতলা দালানের মাঝখানে ছোটখাটো একটা মাঠ। সেখানে শীতের রাতে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলে মেয়েরা। একপাশে ক্যান্টিন। সেখানে সকালের নাস্তাসহ দুপুর আর রাতের খাবার পাওয়া যায়। বিকেলে পুরী সমুচাসহ চা-নাস্তা। মাঠটার সামনে পেছনে করে দুটো বিল্ডিং। পেছনের দালানের সামনের অংশটায় হাউজ টিউটর আর প্রভোস্টের অফিস। দুটো অংশের মাঝখানে একটা সর্পিল লন। পুরো হলটাকে ইংরেজি জেডে আকার দিয়েছে। বার্ডস আই ভিউতে দেখলে তেমনই মনে হয়। এই লনটাই দুটো আলাদা বিল্ডিংকে যুক্ত করে রেখেছে। এই হলো আমার চারণভূমি। হলের ভেতর চলাচলের জায়গা। লনটা ধরে সামনে এগুলোই একদিকে বাইরে যাওয়ার মেইন গেট। তারই একটা অংশ ঘুরে বাম দিকে চলে গেছে। যেখানে হলের সীমানা শেষ হয়েছে। সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে লাগোয়া হাউজ টিউটরদের বাসভবন। তারই পাশে ছাত্রদের একটা হল। খুবই ছোট পরিসর তার। একটানা লম্বা বারান্দার পাশে ছোট ছোট রুম। তিনতলা মোটে। এটি মহসিন হলের এক্সটেনশন। কলাভবনের কাছেই অবস্থিত মূল মহসিন হল থেকে বেশ দূরে। অসংলগ্ন।
আমার ডিপার্টমেন্ট কলাভবনে। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল থেকে কলাভবন যেতে হয় রিকশায়। শুধু সকাল আর দুপুর বেলা ছোট একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হতো ছাত্রীদের কলাভবনে পৌঁছে দিতে। তাতে ভীষণ ভিড় হতো। আমি ওটাতে একেবারেই যেতাম না। ভিড়ভাট্টা হৈ চৈ আমার তখনো তেমন পছন্দের বিষয় হয়ে ওঠেনি। কলাভবনে যতক্ষণ ক্লাস চলে, ততক্ষণ সময় কেটে যায়। কিন্তু বাকি সময়টা ভীষণ যাতনার। ক্যান্টিনের খাবার ভালো লাগে না। পাতলা ঝোলের মুরগি। বাজারের সবচেয়ে কম দামে কেনা মাছ খুব কড়া ভাজা করা হয়। তারপর রান্না করা হয় আলু ঝোলের তরকারি। ছোট বেলায় মা মাছ রান্না করতেন। কখনো মাছ একটু নরম থাকলে খুব গজ গজ করতেন বাবার সঙ্গে। মাছ নরম হয়ে গেলে নাকি একটু ভেজে তবে তরকারি ঝোল রান্না করতে হয়। আমার সে সব কথা মনে পড়ে যায়। খুব বাজে। বিচ্ছিরি এখানে মাছের তরকারি ঝোল। আর আছে বেশি পানি দিয়ে মসুর ডাল। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এক বিশেষ বিষয়। ডাল খাও যত খুশি। কোনো বাধা নেই। মেয়েরা খাওয়া শেষ করে। তারপর মাছের বাটিটা ভরে ডাল নেয়। তাতে লেবু চিপে ডালের স্যুপ খায় প্রায় প্রত্যেকেই। ডাল খাবার এই প্রসেসটিকে আমরা মজা করে বলতাম ‘হলাইজেশন’। এটা নাকি খুব উপকারী। ডালের ওপরের পানিটা নাকি ভীষণ প্রোটিনসমৃদ্ধ। এই একটা মাত্র খাবারই পাওয়া যায় হলে খুব উপকারী। দিনগুলো এভাবেই। কিন্তু বিকালটা বেশ কেটে যায়। আমি এখানে একটা অসাধারণ জায়গা পেয়েছি। সেটা হলের ছাদ। এত বিশাল ছাদ এর আগে দেখিনি। এত বড় ছাদটা রাতে খুব জমে ওঠে। টিউটোরিয়াল পরীক্ষা কিংবা এসাইনমেন্টের ঝামেলা না থাকলে ছাত্রীরা সন্ধ্যার পর ছাদে সময় কাটায়। কখনো কখনো দেখি পেছনের বিল্ডিংটার ছাদের অন্ধকারে নিভু নিভু সিগারেটের আগুনও জ্বলে ওঠে। আমি তখন অবাক চোখে তাকাই। ছাত্রী হলের ছাদ রাতের আঁধারে সিগারেটের আগুন! জ্বলছে আর নিভছে! বিশাল লালমাইর কোলের ছোট্ট আমি। আমি যখন বড় হচ্ছি। বড় হতে হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলাম। মা-বাবা-ভাই আর বোনের বাইরে বিশাল জগতের তেমন কিছুই জানি না। চিনি না। খুব আঁটোসাঁটো বাঁধন ছিল আমাদের পরিবারে। যে কারণে খুব বাইরে ঘোরাঘুরি করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। আমার অবাক হওয়ার বিষয় খুব সহজ। অন্য মেয়েরা যেগুলোকে খুব সহজে নিতে পারে। আমার তাতেও বিস্ময় জাগে। তাই রাতের অন্ধকারে জ্বলতে থাকা সিগারেটের আগুন আমাকে সত্যিই প্রথম প্রথম খুব বিস্মিত করে তোলে।
কিন্তু আমার বিকালটা ঠিক তেমনি পড়ে থাকে। একা। আমি এই একা একা ছাদটিকে নিবিড় করে ধরি। সেই থেকে আমাকে একায় পেয়ে বসে। একাকে ভালো লাগতে শুরু করে। নিজের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। রোজ বিকালে ছাদে উঠি। মানুষ দেখি। কত মানুষ আসে যায়। কত ছাত্র-ছাত্রী। কত আত্মীয় স্বজন আসছে আর যাচ্ছে। এখানে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল আর মহসিন হলের এক্সটেনশনের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশাল এক মাঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গা খালি পড়ে রয়েছে। ওখানে সারাটি বিকাল চলে আড্ডা। ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোন কিংবা বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মাঠেই চলে নিত্য আড্ডা। হলের গেস্ট রুমে আর ক’জনই বা বসে। কখনো রাতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। মহসিন হল এক্সটেনশনের ছেলেরা মাঠে নেমে আসে। গলা ছেড়ে গান করে। ওখানেই অনেকগুলো দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশের একজন নাম করা সঙ্গীত শিল্পী এসডি রুবেল। বহু রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। চারপাশে অবসন্ন অন্ধকার। সেই অবসরে ছাদে দাঁড়িয়ে কিংবা রুমের বারান্দায় গলা বাড়িয়ে কান খুলেছি। রুবেলের দারুণ কণ্ঠে গেয়ে ওঠা ক্ল্যাসিক্যাল আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। চিনতাম না ওকে। জানতামও না কে গাইছে। আর সত্যি হলো এই, তখনো সে নাম ছড়াতে শুরু করেনি। কিন্তু এটুকু বুঝতাম ছেলেটির গানের গ্রামার জানা আছে। দরদ আছে। তখনো জানি না যে, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নয়। একদিন সকালে কলাভবন যাচ্ছি। খুব ভোরে আমার ক্লাস থাকতো। ভোর আটটায় ক্লাস। ভীষ্মদেব চৌধুরী পড়াতেন রবীন্দ্রনাথ। সৈয়দ আকরাম হোসেন স্যারও ক্লাস নিতেন। দু’জনেরই ক্লাস সব অড টাইমে। হয় সকাল আটটায় । আর নয়তো দুপুর আড়াইটায়। এই আমি তখন ভীষণ ঘুমকাতুরে। ঘুমের আলস্যে আমি অনেক ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঠিক। সেই আমি রবীন্দ্রনাথ ফাঁকি দেইনি কোনোদিন। এটাও ঠিক। সেদিনও চলছি আমার প্রাণের ঠাকুরের টানে। হঠাৎ দেখি পুলিশের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে হলের সামনে। এই ভোর বেলাতেই। তার মানে হলো গতরাতে রেড পড়েছে এক্সটেনশন হলে। গাড়িতে নত মুখে কিছু ছাত্র বসে আছে। দেখি তারই মাঝে রুবেল বসে।
রুবেল, তুমি এখানে?
হ্যাঁ।—মাথা নিচু করে রুবেলের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
পাশ থেকে বন্ধু ফিসফিস করে বলে ওঠে, তাড়াতাড়ি চলো। জানো না রুবেল ঢাকা কলেজে পড়ে? ও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। মহসিন হলে অবৈধভাবে থাকে।
আমি যেতে যেতে আবার পেছন ফিরে তাকাই গাড়িটিতে বসে থাকা ছাত্রদের দিকে। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। তার অসাধারণ গলায় ক্ল্যাসিক্যাল গান আজও মনে পড়ে। সেই ক্ল্যাসিক্যালের আবেশ শুনে মুগ্ধ হয়নি সারাটা মৈত্রী হল, সেই সেই অন্ধকার রাতগুলোয় তা কেউ বলতে পারবে না। সেই মুখর মাঠ। বিকেলের অবসরে চলছে তুখোর আড্ডা। লাইব্রেরিতে পড়ায় ব্যস্ত অনেকেই। হলের ভেতরটা তখন একেবারেই নীরব। আমার কেউ নেই তেমন করে। প্রতিদিন হলে আসবে।
মা-বাবা তখন ময়মনসিংহে। বড় ভাই রাশিয়া। প্যাট্রিস লুমুম্বার দিন শেষ করেছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে আসবে আসবে করছে। মেঝো ভাই অ্যাপ্ল্যাইড ক্যামেস্ট্রি থেকে মাস্টার্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ফিরে গেছে বাড়িতে। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করে চলেছে। অতএব আমি একা। এই প্রথম আমার সব থাকতেও নেই নেই অনুভব। কী এক গভীরতায় জেঁকে বসে। তখন নীরব আমার সব বিকেল। আমার ভাই নেই এখানে। বোন নেই। বাবা নেই। মাও দূরে। আমি একদম একা। সেই সব হলশূন্যহওয়া বিকেলগুলোতে আমি ছাদে উঠি। বাইরে মুখর। এখানে নীরব। আমি নীরবতার মাঝে নিজেকে খুঁজি। নিজের দিকে তাকাতে সময় পাই। একা একা ছাদের বিশালত্বের সঙ্গে নিজের ক্ষুদ্রতাকে অনুভব করার সময় পাই। আহা বিকাল এত সুন্দর। এত বিশাল! এত নীরব! এত বিপরীত এখানে! যেন লালমাইয়ের গোধূলি এখানে। চলেছে সন্ধ্যের দিকে। যেন সেই আকাশ এখানে পুনর্বার জন্ম নিয়েছে। যেন লালমাইয়ের সবুজ এখানে। মিনিয়েচার হয়ে রয়েছে সামনের মাঠে লালমাইয়ের বাতাস এখানে। হালকা আবেশে। নিজের সঙ্গে কথা বলার এত চমৎকার জায়গা আমি পেয়ে যাব এই একলা জীবনে, তা আগে কি কোনোদিন ভেবেছিলাম? এই একলা একলা আকাশে আমি যেন নাটাই কাটা ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়াই। সে একলা বাতাসে আমি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে শিখি। যা ভুলে গিয়েছিলাম লালমাই ছাড়ার পর পরই। ময়মনসিংহের কানাগলিতে এসে। আবার কখন নতুন বাতাস বইতে শুরু করলো। ময়মনসিংহের ঘিঞ্জিগলির গ্লানি যখন দূর হয়ে গিয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের দারুণ বাতাসে, কবিতার দারুণ পঙ্ক্তিতে, কবি আর কাব্যের কথকতার আবেশে যেদিন সোনালি রঙ ধরাতে পেরেছিল, তাও কেমন এক দ্বিধার অন্ধকারে ডুবে গেল। বড় অসময়ে। বড় যাতনা দিয়ে।বড় অনাকাক্ষিত তার রূপ। প্রেম ভালোবাসার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। নতুন পরিবেশে পড়তে আসা। এই সব জটিলতার মাঝে ছাদটা একান্ত আমার। আমার একরত্তি স্বস্তির জায়গা হলো। বহুদিন বহু বছর যুগ যুগ পর। আমি আবার পেলাম মাথার ওপর নীল আকাশ। অবারিত সবুজ। আমি প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেই হলের ছাদে। আরও অনেক দিন। অনেক বছর বাদে। এখানেই লুবনার সঙ্গে আমার নিদারুণ সময়যাপন। রক্তাক্ত বহু রাত্রি যাপিত হয়েছে। এই ছাদে। কুয়াশায়। শীতের রাতে। কখনো চায়ের লিকারে। কখনো গরম কফির উষ্ণতায়। হৃদয়ের রিক্ততায়। বীভৎস যাতনায়। দারুণ আনন্দে। বিপন্ন বিষাদে—বিষণ্ণতায় এবং অবশেষ যার মৃত্যুতে। সে মৃত্যুর কথা পরে বলছি। এমনি এক একাকী গোধুলি সেদিন। শেষ আলোর মায়া কেবল কাটাতে শুরু করেছে পৃথিবী। দু’দিক থেকে এসে লেগে যাওয়া ছাদের কোণটাতে আমি তুলে দিই পা। দু’পা তুলে পাঁচতলার ছাদের কোণাটাতে একা একা বসি। যেকোনো সময় অসাবধানতায় পড়ে যেতে পারি একেবারে নিচে। ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। তবু আমি নির্ভীক। ঠিক এভাবেই বসে আমার সুখ। প্রায় প্রতিদিনই অন্ধকার হতে শুরু করলেই এভাবে বসি। নিচে মুখর। ওপরে নীরব। এই পৃথিবীর মাঝখানে বসে নিঃসঙ্গতায় জড়াতে শুরু করি নিজেকে। অনেক বিকালে এখানে বসে কাটিয়েছি। কাটিয়েছি কত যে সন্ধ্যা আর রাত। অনেক রাত এখানে একা একা তারাদের দেখেছি। দেখেছি চাঁদের ষোলোটি কলা। কত পূর্ণিমা এখানে ভিজিয়ে রেখেছে আমার, জোৎস্নায়। কত অমাবস্যার অন্ধকার ঢেকে দিয়েছে হৃদয়ের দান। কী করে বলি তার সব। বৃষ্টিতে ভিজেছি অবারিত এখানে। অনেক রাত্রি-প্রহর পার করে ভোরের সূর্যোদয় দেখেছি একলা। একা। তবু দারুণ সময় সে আমার। আমি ভুলতে বসেছি আমার দগ্ধ গ্লানি। হৃদয় হরণ আর যাতনার গভীরতা। ঠিক এমনি এক বিকালে আলোছায়ার খেলা তখনো শেষ হয়নি। আঁধার গ্রাস করেনি তখনো চরাচর। হলে ঢুকে পড়ার ঘণ্টা ওঠেনি বেজে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। আমি সে অপেক্ষায়। নিচে তাকাই। প্রতিদিনের মতো। হঠাৎ বুকের ভেতর ছলকে ওঠে কি এক ঝলক! ভুল দেখছি কি! কার ছায়া ভাসে চোখে! কার হেঁটে আসার ছবি এতটাই চেনা! অত ওপর থেকে নিচে কোনো এক মানবের পথচলা কেন আমারেই এতটা সচকিত করে তোলে! তখনো বুঝিনি। আজ এত বছর পর টের পাই ভালোবাসার দাগ কোথায় কোথায় কিভাবে বসে যায়। কী করে জালে আটকা পড়ে যায় মানুষের সম্বিৎ। জ্ঞান। বুদ্ধি। ধারালো বোধ! সেই হেঁটে আসা ছায়ার সঙ্গে লেগে আছে চিরচেনা—প্রথম গোলাপের ঘ্রাণ। আমি এতটা ওপর থেকেই টের পাই। বুঝতে পারি আমার আর বেঁচে থাকার কোনো পথ নেই। নিজের মরণ ঠেকানোর আর কোনো পথ আমার জানা নেই। এই প্রথম বিকাল যখন আমি সম্মোহিতের মতো নিচে। ওই প্রিয় ছাদ ছেড়ে নিচে নেমে আসি।
চলবে…
নারী: পর্ব-২০॥ শাপলা সপর্যিতা