॥পর্ব-১৯॥
আমি মাথা নত করে বলি, জি। আমি এসএসসিতে স্টার মার্কস পেয়ে পাস করার পর মা এটি আমাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন।
বেশ। ওই আঙটি তুমি খুলবে না। কিছু একটা মেটাল ওই আঙুলে পরে থাকবে সবসময়। সোনা-রূপা-তামা কিছু একটা। এই কথাটা মনে রাখবে, কখনো খুলবে না।
আমি মাথা নিচু করে বলি, মনে রাখব। খুলব না।
কথা এই পর্যন্তই। কিন্তু এ সব কথা থেকে আমি স্পষ্ট একটি ইঙ্গিত পেলাম যে, আমার সামনে খুব ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। ভয়াবহ বিপদ সামনে। আমাকে সতর্ক হতে হবে। সান্যালদা বোধ করি, আমার এই অতলস্পর্শী প্রাণান্তকর অরক্ষিত প্রেমের কথাই বলছেন। তা থেকে কিভাবে সরে আসব, তারই আভাস দিয়েছেন ওই আঙটিতে। আমি খুব যত্নে আঙটিটি আঁকড়ে ধরি। আর নয়। এই দ্বিধা, এই মাঝ পথ, এই দুরূহ আকর্ষণ থেকে আমাকে সরে আসতে হবেই। তার জন্য এই আঙটিই একমাত্র আমার সহায়। আঙটিটিকে এই অসহায় মুহূর্তে দেবতার মতো মনে হয়। অন্ধকারে ডুবে থাকা লালমাইয়ের গ্রামগুলোয় একটি মাত্র আলোর বাতির মতো মনে হয়। গভীর শীতের রাতে একবিন্দু উষ্ণতার মতো লাগে তাকে। ওই আমাকে পথ দেখাবে।আমার পথপ্রদর্শক।আমি খুব যত্নে আগলে রাখি আঙটি। খুব ভালোবেসে পরে থাকি বাম হাতের রিং ফিঙ্গারে।
স্টুডিওতে একটা সাদাকালো ছবি তোলা ছিল, সেটা আনতে যাই কিছুদিন পর। ও বাড়ির আশেপাশেই ছিল। যোগ হয়ে যায় আমার সঙ্গে। একটা লেফ্ট প্রোফাইল ছবি। চাপা ভাঙা গালের লেফ্ট প্রোফাইল আমার সবচেয়ে ভালো আসে। এটা ছোটবেলা থেকেই। ফাইভ-আর সাইজ। ব্ল্যাক অ্যাএন্ড হোয়াইট। কেন যে ছবিটি তুলতে ইচ্ছে হয়েছিল জানি না। স্টুডিও থেকে তিন কপি নিয়ে আমি দোকানে কিছু বই খুঁজি। ছবিগুলো তার কাছে রেখেছিলাম তখন। বইগুলো নিয়েই বাড়ি আসি কিছুক্ষণের মধ্যেই। ছবিগুলো তেমন করে আর খুলি না। রাতে একটা বই পড়ছিলাম। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মানবজমিন’। পড়তে পড়তে হঠাৎ ছবিগুলো বের করি। একটা ছবি নেই ওখানে। চুরি হযে গেছে। গেল কোথায়? ছবিটা গেল কোথায়? কি আশ্চর্য! ছবিটা পড়ে গেল না কি? তিনটি ছবির মধ্য থেকে একটি পড়ে গেল? আমি টেরটিও পেলাম না? বাকি দুটি রয়ে গেল? অদ্ভুত লাগে বিষয়টি আমার কাছে। কিন্তু ওটা নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবার সময় পাই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে থাকার জন্য চলে আসার দিন ঘনিয়ে আসে।একটি ট্রাংক, একটি নতুন তোষক, বালিশ আর বিছানার চাদর সঙ্গে দিয়ে দেন মা। আমিও গোছগাছ করতে থাকি। মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকি। একা, ১৭/১৮ বছর বয়সে জীবনের পথে একদম একা চলার প্রস্তুতি।যদিও এর চেয়ে বেশি মনোনিবেশ আমি করি আমার ব্যক্তিগত বিষয়টির ওপর তখন। একটি ছবির কথা ধীরে ধীরে ভুলেই যাই একসময়। মেঝোভাইয়াই আমাকে রেখে আসেন গিনি আপার বাসায়। নিগার সুলতানা গিনি। আমার ছোট খালার বড় মেয়ে। তখন বুয়েটের টিচার্স কোয়ার্টারে থাকেন।
দুলাভাই বুয়েটে পড়ান। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সেই গিনি আপা। যিনি এইচএসসি পরীক্ষার পর বিয়ে করে বরের সঙ্গে চলে আসেন বুয়েট কোয়ার্টারে। দুলাভাই তখন সম্ভবত রাশিয়া যাচ্ছিলেন কোনো একটা ফেলোশিপ করার জন্য। বিয়ের পর পরই গিনি আপার প্রথম সন্তান অদ্বিতীর জন্ম। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলভাবে পড়ালেখা শেষ করেন।মাঝে অম্লানেরও জন্ম হয়। কিন্তু কোথাও তার আর চাকরি-বাকরি করা হয় না তেমন। অসাধারণ প্রতিভাময়ী এই নারী তারপরও হাল ছাড়েননি। পড়েছেন একের পর এক। বিয়ে-সংসার-বাচ্চা, তার সঙ্গে লেখাপড়া—এ যে কী দারুণ ঝক্কি, তার কিছুটা আমি টের পাই এত বছর পর যখন আইন পড়তে আসি। আমি মাঝপথে ছেড়েও দেই আইন পড়া। ঠিক মাঝপথও নয়। অর্থাৎ দু’বছর খুব সিনসিয়ারলি সন্ধ্যের পর প্রায় তিনমাইল পথ একা একা হেঁটে গিয়ে ক্লাস করি মোহাম্মদপুর ল’ কলেজে। একদিনও কামাই করি না ক্লাস।১৬টি বছর পড়ালেখা থেকে অতটা দূরে থাকার পর সেই ছোট বেলার মতো নিজের সিনসিয়ারিটি দেখে নিজেই মুগ্ধ হই। আমার সুনামও হতে থাকে। স্যাররা আমাকে খুব ভালো ছাত্রী হিসেবে দেখতে থাকেন। আর ল’ কলেজের এবারের ভালো রেজাল্ট করবে—এমন দুই একজনের মধ্যে আমাকে ভাবতে থাকেন। কিন্তু তিন আর সাড়ে ছয় বছরের ছোট ছোট বাচ্চা সামলে সকাল বিকাল চাকরি করে ঘরে স্বামীর উদাসীনতার নিদারুণ যন্ত্রণার সামাজিক আর অর্থনৈতিক ফল ভোগ করতে আর পারিবারিক অর্থনৈতির হাল সামলাতে সামলাতে একসময়, ঠিক পরীক্ষার আগে আগে আমি ডিরেইল্ড হয়ে যাই। মোহাম্মদপুর ল’ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমাকে ফোন করলেন রেজিস্ট্রেশনের জন্য। বললেন, তুমি কেন রেজিস্ট্রেশন করছ না?আমি জানি, তুমি পরীক্ষায় এটেন্ড করলেই ভালো রেজাল্ট করবে।বে্শিদিন বাকি নেই। আজকালের মধ্যেই এসে ফরম ফিলআপ করে যাও।
আমি কী করে বলি—স্যার, আমি রাতদিন খেটে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি। ঘরে আমার অবুঝ দুই দুধের শিশু।তারা লবণ দিয়ে সাদা ভাত খায়। আমি মোহাম্মদপুর ল’ কলেজে ভর্তি হয়েছি পায়ের মল বিক্রি করে।ভেবেছিলাম কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী নতুন চাকরিতে ঢুকবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।পরীক্ষার সময় আসতে আসতে দুজনে সামলে নেব সব।কিন্তু দুবছর পর যখন সংসারের চার জন মানুষের মাঝে আমি একা, একদম একা, তখন পরীক্ষার জন্য রেজিস্টেশন করার সময় এসে গেছে। এখন কী করে বলি, স্যার আমার বুকে যখন দুই অবোধ শিশু, তাদের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থার সব দায়িত্ব, স্কুলের বেতন, বাড়িওয়ালার চাপ, স্বামীর ব্যাংক লোনের পাহাড়। এখন রেজিস্ট্রেশন করার মতো অবস্থা আমার নেই।
তিন মাস পর, পরীক্ষার ঠিক আগের দিন স্যার আবার ফোন করেন। জানি তার কতটা আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হয়েছিল সেদিন আমাকে দ্বিতীয়বার ফোন করতে গিয়ে।ক্যানসার রোগে আক্রান্ত প্রায় মৃত্যু পথযাত্রী একজন শিক্ষক কতটা ভালোবেসে আমাকে বার বার ফোন করেছেন। স্যার বললেন, তুমি পরীক্ষার হলে যাও। আমি অনুরোধ করি। তোমার রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও আর যা যা কিছু সব আমি সামলে নেব। আমি গুছিয়ে দিচ্ছি সব। আমি থাকব শুরুর আগে আগে পরীক্ষার হলে। একটা দারুণ সম্ভাবনা তুমি নষ্ট করো না। আমি অনুরোধ করছি তোমাকে। সেদিনও না বলতে আমি লজ্জায় শেষ হয়ে গেছিলাম। আর নিজেকে অমানুষ, বেয়াদব গাল দিয়েছিলাম মনে মনে। তখন আর পরীক্ষা দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় নেই আমি। এ্ তিন মাসে কী কী ঘটেছে আমার জীবনে, আমার সংসারে, সেগুলো আমি কোনোদিনও স্যারকে বলতে পারব না।
খুব ছোটবেলায় যখন পরীক্ষাভীতি নিয়ে স্কুলে যায় একজন মেয়ে, তখন থেকেই পরীক্ষা আমার বড় প্রিয়। নিজেকে যাচাই করার মানসিকতা সেই ছোটবেলা থেকেই আমার। সেই আমার পক্ষে পরীক্ষায় বসার মতো মানসিক অবস্থা নেই।
(চলবে)