॥১৫॥
এ ছিল হৃদয়হরণ, সঙ্গে প্রেমেরও মরণ। আমাকে নিয়ে যার এত কাব্যকলা, কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে; তাকে আমি ফেরাই—এত নিঠুর হতে পারেনি আমার সাড়ে সতের বছরের হৃদয়। এতকাল বলিনি কেন সব? উত্তর, ভয় ছিল। যদি বেশি চাইতে গিয়ে সবই হারাই। তুমি কি বোঝোনি চোখের ভাষা? রেল লাইনের ধারে চলে গেছে যে পথ, তার শেষের ঠিকানা তো বাসন্তী রঙ শাড়িতেই লেখা ছিল। কেন জানোনি তার সব অক্ষর? সেই একই কথা—তাও সে কবিতার ভাষায় ‘ভয়, প্রত্যাশার মাত্রাধিক্য যদি অনন্ত দুখের কারণ হয়।’ এই কথা ক’টি অমোঘ শ্লোকের মতো জীবনের এই মাঝবয়েসে এসেও গেঁথে রয়েছে বুকের ঠিক মাঝখানে।
ভুলতে পারি না তাকে কোনোদিন। ভুলতে পারিনি আজও কোনোমতেও। কিন্তু তখন এ আর শোনা যায় না কানে। এ তখন আর বোঝার নয়। মেঘের সব জল এসে ভিড় করে আমার গহন কালো দুচোখের কিনারে। হৃদয় দেওয়া হয়ে গেছে তার অন্য নারীতে। লাল কাঁচের চুড়ির কিংকিনিতে বাজে বিষের বীণা। রাতদিন অষ্টপ্রহর ভেসে চলে যায় কোন সে অজানায়, কে জানে তখন, আহা! আমি নীড়ে ফিরি। আমার আকাশের সব রঙ চুরি করে কে যেন ফেরি করে বেড়ায় আমারই চোখের সামনে দিয়ে হায়! আমি নিঝুম, নির্বাক। আকাশ দেখি। বাতাসের ঘ্রাণ তেমন কাড়ে না হৃদয়।
কদিন আগেও শরতের আকাশে মেঘে মেঘে আঁকা হতো যে মুখ, আজ আয়নায় দাঁড়ালে বারে বারে হারাই তাকে। তার চোখের কাজল বেয়ে নেমে যায় কোনো এক গভীর সর্পগন্ধ্যার প্রগাঢ় নীল বিষ। সেই যে দূরে দেখা যায় বাড়িটির বেলকনি,সেখানে বসে মধ্যরাতে কেউ বাজায় বিরহ বাঁশি। আমি লালমাই ছেড়ে আসার পর ময়মনসিংহের অসহ রাত্রিগুলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনতাম তার বাঁশি। কোনোদিন দেখিনি যারে। তার বাঁশি শুনি আজও একা মাঝরাত্তিরে। বুকের ভেতর শত শত কাঁচের চুড়ি আজ কেন যে ভেঙে পড়ে সেই বাঁশির সুরে বুঝতে পারি না। আর পেরে উঠি না অসহ বেদনার সঙ্গে। ছুরিতে বিষ মেশানো ছিল। ক্রমাগত তা বিষের কণিকা ছড়ায় আর নিদারুণ যাতনায় বিষাক্ত করে তোলে প্রতি পল। সূর্যের এত আলো, কেবল গাঢ় অন্ধকার ছড়ায় কেন আজ? রাতের আঁধার লুকায় কেবলই শ্মশানে।
বালিকা বধূটিরে দেখতে যাই একদিন। কী সুন্দর একহারা গড়ন তার! পড়ালেখার তুলনায় বয়স তার একটু বেশিই, যদিও দুধেআলতা গায়ের রঙ। তার হাত ভরা বৈশাখী মেলা থেকে আমার কবিরই এনে দেওয়া রঙবাহারি কাচের চুড়ির রিনিকিঝিনিকি শব্দগুলো এখনো বুকের গভীরে এক তীব্র বিষাদের আল্পনা এঁকে চলে। জীবনের এই মাঝবয়সে এসেও ঠিক এমনই প্রগাঢ় সেই অনুভব। ভুলতে পারি না সে বিরহজ্বালা আজও কোনোভাবেই। মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে তার মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে বেশ কিছুদিনের জন্য। তার বড় ভাই ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পড়েন। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার জন্য যে কোচিং সেন্টারে মা আমাকে ভর্তি করে দিয়েছেন, সে কোচিং সেন্টারে তিনি আমার শিক্ষকও। তিনিই তার ছোটবোনের জন্য আমার কবিকে ঠিক করে দিয়েছিলেন গৃহশিক্ষক হিসেবে। আমি তার কিছুই জানি না। অবশ্য জানার কারণও নেই।
তখন আজকালকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ নয়। এছাড়া কোচিং-এর সময় ছাড়া বাকি সময় খুব একটা বাড়ির বাইরে থাকা আমাদের পরিবারের প্রথা নয়। কোথায় কখন কেন গিয়েছিলাম, সব দাসখত লিখে বাড়ির বাইরে যেতে হতো আমাদের বাড়ির ছেলে আর মেয়েদের। আর সন্ধ্যেবেলা মাগরিবের আজানের সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির ছেলেদেরও ঘরে ফিরে আসতে হতো। অতএব অতসব গল্প আর ঘুরেফিরে বেড়ানো অতসব লুকোনো সব কিছু জানার ফুরসৎ ছিল না মোটেও। তাছাড়া কী করে জানব, যে দুদিন আগে লিখে গেছে অমর প্রেমের কাব্য, সে অত দ্রুতই লিখে দেবে অন্য এক বালিকার মনে রঙের মাধুরী দিয়ে আলপনা? কে জানে? কেন দেবে? কে বলে দেবে?
ছেলেটির মা নেই। ছেলেটির বুকের ভেতর কী যেন নেই, কী যেন চায়, কী যেন হারায়ে গেছে, কী যেন পাওয়ার ছিল—এই বেদনার তোলপাড় আমাকে সজল করেছিল। আমার মা তাকে খুব আদর করে স্নেহের ছায়ায় টেনে নিয়েছিলেন। যখন খুশি, তখন আমাদের বাড়িতে তার ছিল নিত্য যাওয়াআসা আর পাত পেতে বসা। দিনকে দিন আমি বেদনার ভারে ভারাক্রান্ত। কী করে বোঝাই, কী যাতনা বিষে দেখি তার মুখ! কী বেদনায় মূক হয়ে থাকে আমার প্রদোষবেলার কিরণ কেড়ে নেওয়া ভোর? কী অকারণ আমার ভৈরবীর রাগে হয় ছন্দপতন। কী করে বলি? কারে জানাই ওই সাড়ে সতেরো বছরের বিরহ যাতনার ক্ষত? কারে দেখাই সে রক্তাক্ত ক্ষরণ? তবু সে আসে। দিনে দিনে কাছে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। আমার মারাত্মক রকম জন্ডিস ধরা পড়ে। বিলিরুবিন ১৮।
ডাক্তারের বারণ কাজকর্ম করা। পড়ালেখাও নেই তখন। খাবার-দাবারে সব রেসট্রিকশনস্। আর ঘরের মধ্যে শুইয়ে থাকা। ছাত্রজীবন শুরুর পর এই প্রথম অখণ্ড অবসরে বন্ধুরা আসে। মাঝে মাঝেই। আমার ঘরে দারুণ জন্মেস আড্ডা বসে । আমি ওদের সঙ্গে তাল মেলাই। ঘরে বসে কী করব আর! বুকের নিভৃতে নিদারুণ জ্বালা আমাকে কেবলই পোড়াতে থাকে। তবু সে কেন আসে? কেন আসে? যে আমাকে ভাবের কাব্য লিখে দারুণ দিশাহারা করে দিয়ে মালা দিল দুদিনের জন্য বেড়াতে আসা সেই সখিটিরে। যে এতটুকু অপেক্ষার পালা শেষ হতে দিল না!
সেই এক ব্যাখ্যা, যার নিজের করে রেখেছে সমস্ত ব্যর্থতার আড়াল —‘যদি অনন্ত দুখ..’ তবু ব্যথা নিয়ে বুকে জেগে থাকে এক নিঝুম চাঁদ। তবু কাছে আসে সে। প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট। ওই প্রথম আলোকিত শিহরণ শরীর মনে জীবনের প্রথম প্রহরে। প্রথম চুমু খেয়েছিলাম বোকার মতো। অদ্ভুত হেসে বলে উঠেছিল—এভাবে নয় বোকা। বলে গভীর ভালোবাসায় এঁকে দিয়েছিল প্রথম ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ। তখন দুজনের মাঝে ছিল না বালিকাটি।
দুচোখের পাতায় গভীর কাজলের ওপর আল্পনা আঁকতো যখন তার ঠোঁট আমি থরথর কাঁপনে দিশেহারা। যখন পৃথিবী তোলপাড়, যখন প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শে সুখে-অসুখে মেখে দেয় অকারণ ভালোবাসার সুখ, তখন কোথায় পালাতো সেই বৈশাখী চুড়ির কিনকিনি? জানি না দুজনের কেউ। কিন্তু ক্ষণপরেরই তার অন্তর্ধান আর মাঝ রাত্রিতে চুপি চুপি এসে বসতো সে বালিকাটি আমার শিথানে। আমি বুকে লাল রক্ত নিয়ে জেগে উঠতাম আধো তন্দ্রার মাঝ থেকে। আর আরক্ত নীল বিষ বুকে নিয়ে জেগে থাকতাম এক একটি অনন্ত রাত্রি।
চলবে…
নারী: পর্ব-১৪॥ শাপলা সপর্যিতা