অলস দিন-যাপনের ফাঁকে ফাঁকে অধরা বিষের কণা। জাপটে ধরে জীবনের টুঁটি। এই এক মানবজীবন। কেন যে মানুষ হতে গেলাম! কেন যে নারীর ভেতরে বুনে দিয়েছিলেন বিধাতা মানুষের বীজ। আর তারই দারুণ আস্ফালনে কেটে গেছে কতকাল। কে জানে তার স্বরূপ। কে জানে তার অরূপ। আমিই কি জানি তার সব? তবে কেন আজ বিবাহের লাল শাড়িটি নতুন করে ফিরে আসে ধ্যানে স্বপ্নে জীবনের পরতে নতুন কোনো বিষ নিয়ে? উদ্দাম গতিহীন যে জীবনের পরতে পরতে ছিল কেবলই সুখ। জীবন যাপনের। আনন্দের। সুখের। লালামাইয়ের ঘন অন্ধকারে ডেকে ওঠা তক্ষকের ডাকেও ছিল কি এক আদিম ধ্যানস্থ স্বাদ। পেয়ারার গন্ধে মাতাল বন পাহাড়ের ধারে লোভের জালে কাটা পড়া সেই বাদুরের মৃত শব কি এক দারুণ আবেশ দিয়েছিল সেই প্রত্যুষে। ঊষালগ্নে ছড়িয়ে গেছিল যে কুসুম কুসুম লাল, তার সঙ্গে কি ছিল কোনোদিন সেই শাড়িটির লালের কোনো অধরা সাজুয্য? আমিতো কুসুমের কোমলে সাজিয়ে ছিলাম বাসর।
মানুষের ভেতর জেগে উঠেছিল কোনো এক আদিম ধ্যানস্থ নারী। জেগে উঠেছিল পার্বতী উমা হয়ে। জন্ম দিয়েছিল স্বরস্বতী কিংবা লক্ষ্মী। নিজেরই হাতে পড়েছিল স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁথিতে সিঁদূর আর হাতে শাখা। আর তাই বুঝি স্বামীরা কেবল স্বামী হয়ে পড়ে রয় ঘরে সংসারে অনৈকট্যে। কবে স্বামী হয়ে উঠবে বর? কবে ঘর হয়ে উঠবে মন্দির। কবে মানুষ হয়ে উঠবে দেব। কবে নারী হয়ে উঠবে দেব বন্দনাকারী। পার্থিবের মাঝে কবে যোগ হবে অপার্থবের প্রেমযোগ? জীবাত্মা পরমাত্মায় কি কোনোকালে হবে না দেখা? হবে না সফল এই সব প্রেম-ধ্যানযোগ? কেবলই ফেনিয়ে উঠবে করাল কালো বিষ? বলকে বলকে ঝরবে রক্ত? স্বেদ রক্তে আবার কবে জন্ম নেবে কোনো এক মহামানবী? কবে? আমি সেই ধ্যানে থাকি। নিরন্তর ভালোবাসি। নিমগ্ন থাকি এক আদিম ধ্যানে। নিমগ্ন থাকি কোন সে চৈতন্যে। কে জানে! পূজায় মঙ্গল পাতায় জপ করি। বেলফুলে মালাগাঁথি কার? কার কায়া? কোথায় সে। কোন সে আপন? আর সরে সরে যাই বেদনাহত, জীবন থেকে দূরে। বহু দূরে। নারীর ভেতর থেকে মানুষে। অনন্তে বিলীয়মান হই এক নারী অন্য এক মহাকালে।
এইভাবে এক জীবন। কত কাল। কত যুগ। কত জন্ম। তার করতে পারি না ঠাহর। শুধু মনে হয়, এক জীবনে দুই জীবনযাপনের দূরূহ ভার। সইতে পারি না আর। আমি কি পুরুষ ছিলাম কোনো এক জন্মে! তাই এই জন্মে নারী আর পুরুষের দারুণ দুঃসহ দুরূহ দ্বন্দ্বে কেটেছে সবটা প্রহর? তাই কর্ম আর দায়িত্ব দুই স্রোত এসে মিশে গেছে কোনো এক অমীমাংসিত সত্যে? না কি এই সত্য? এই কঠিন? এই কঠোর? এই হলো মানুষ জীবন। নয় নারীর নয় পুরুষের। এ এক মানুষ জীবন। এই কথাই কি বলে গেছিল কৈশোরে আমার পুরোটা দুপুর? এপার ওপার করা পুরোটা পুকুরের জল? লালমাইয়ের সুনীল আকাশের মুখে জেগে থাকা উড়ন্ত চিলের করুণ বেদনাহত কণ্ঠ? এই কথাই কি আজও বলে যায় আমার দুরন্ত দুঃসাহসী পায়ের পাতা? আর তাই দলে যায় দুপায়ে যত কাঁটা-আগাছা-পাথর। ফুল কই? তার শেষে? কাঁটার আঘাতে রক্ত ঝরে জন্ম হয় প্রতি রক্তকণায় যে ফুলের। তার ঘ্রাণ কই? আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় হয়তো উচ্ছেদ হয়েছে কোনো এক অর্জুনের কঠিন তীরের আঘাতে। কিংবা কোনো এক ভাগীরথীর তীরে সূর্য বন্দনাকালে উপস্থিত হয়েছিল কোনো মায়ার যোগ? ভুলিয়ে নিয়ে গেছিল আমারে কোন সে ছলনায়। এক গভীর ঘুমের ভেতর যে কারণে আমি হারিয়েছি আমার কৈশোরের সাজানো স্বপ্ন, সাজানো সুন্দর, হারিয়েছি সোনার কাঠি। তাই ভাঙতে পারেনি ঘুম। আমার দুরন্ত যৌবন কেটেছে এক দুরারোগ্য কঠিন ব্যধিতে। যার সংক্রমণ এক জনম থেকে ছড়িয়ে পড়েছে অন্যজনমে, জন্ম-জন্মান্তরে? আমি তারে বালি, এক মানুষ ঘুম। কবে যেন কোন বেঘোরে ঘুমিয়ে গেছিল তৃষ্ণার্ত ক্লান্ত মানুষ আমার। তাই অযতনে অবহেলায় পার করেছি এক নারীর জীবন। লালমাইয়ের ঘন জঙ্গলের কাঁটায় তারে করতে পারেনি আকীর্ণ অথচ মানুষ তারে করেছে পদানত। ঘন মেঘের কুণ্ডুলী যাকে কোনোদিন করতে পারেনি পরাজিত, আলো-আঁধারি ভালোবাসা তাকে করেছ চিরকাল পরাস্ত। ভুলে গেছি ঘুম, ভুলে গেছি হাতের মেহেদি। গর্ভের সন্তান। এক সন্তানকে নাড়ীতে বেঁধে রক্ত পিপাসু আরও এক মানুষকে করেছি কেবলই লালন। কেবলই হৃদয়ের অর্ঘ্য দিযেছি ঢেলে ভুল মানুষে। পরাজয়ে গ্লানিতে ব্যর্থতায় ঢেকে গেছে তাই এক দারুণ মানুষ জীবন। নারী প্রেম, নারীর ভালোবাসা, নারীর হৃদয় মন্থন তাই আজ ঢেকে আছে এক রক্তজবার বুকের গহীনের রক্তাক্ত প্রান্তরে।
চলবে…