পর্ব:১২
পুড়ে গেছে তার ঘর যৌথজীবনের সব স্বপ্ন আর আবাস। এই হলো মানবজীবনের অধরা অনাকাঙ্ক্ষিত সকল। কে জানে তার রূপ। কে জানে কখন উঠবে ঝড়। আসবে বন্যা কিংবা প্রলয় আর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে যাবে। উড়িয়ে নিয়ে যাবে যতনে সাজানো ঘর। নির্দ্বিধায় সাজানো যুদ্ধজীবনের সফলতার বীজ? যা গড়ে উঠেছিল এই সমাজের বিরুদ্ধে। এই প্রথার বিরুদ্ধে। এই ধর্ম আর আজীবন সংস্কারের বিরুদ্ধে। নারী কখনো প্রলয়ঙ্করী, কখনো প্রিয়তম সূধা। নারী কখনো আবরণ। নারী কখনো আভরণ। আবার কখনো বা ক্ষুধা। নারী কখনো দুর্গা কখনো এক ইপ্সিত সূধা। এই হলো নারীর চিরকালের বেশ, চিরকালের রূপ কিংবা অরূপ। এতেই মুগ্ধ মানব প্রজাতি। এতেই মুগ্ধ পুরুষ। আবার এতেই ক্ষুব্ধ পুরুষ। এতেই স্নিগ্ধ পৃথিবী বসুন্ধরা, এতেই সৃষ্টি পার্থিব যতসব কথকতা। কেন এই লেখা? কেন যে অকারণে এই প্রসঙ্গ অবতারণা করেছি আজ? কী করে বলি? ঘটমান জীবন বড়ই অসহায়। চাইলেই কি আজ এখানে এই সাদা কাগজের বুকে লিখে দিতে পারি তার সব নামধাম আর ঘটনার বর্ণনা? তাতে কত বিতর্ক, কত আলোচনা, কত সমালোচনা আর কত যে বিড়ম্বনার ঝড়! যাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ভেঙে ফেলে দেবে গর্তে, কে আগলাবে তারে? তাই বলা যায় না। তাই নাম নেওয়া যায় না। তাই বুকের গভীরে রেখে দিতে হয় ক্ষত। এই সব ক্ষত আত্মার, এই ক্ষয় মানব জন্মের, এই লয় ভালোবাসার। আমি তারই কথা বলি আজ নিজেরই নামে। ভালোবেসেছিল দু’জন মানুষ । সমাজ ধর্ম আর সংসারের বাইরে দারুণ তাদের যৌথজীবন। আসাধারণ তাদের প্রেম। এই ছিল জনম জনমের পাপ। ধর্মের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, শাসকের বিরুদ্ধে চিরকালের চর্চিত অন্ধ বোধের বিরুদ্ধে জীবন চর্চার বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি পরিবারের বিরুদ্ধে। পরিবার জিনিষটা আসলে কী বলুন তো? মাঝে মাঝে দুরন্ত দুর্বার দুঃসহ হয়ে উঠি এই বারিবারিক প্রথার বিরুদ্ধে। অমীয় চক্রবর্তীর ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমরাতো জীবনের অর্ধেক সময় পার করেছি সঙ্গম আর সন্তান উৎপাদনে/তবু ক’জন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি বলুনতো ভালো আছি/ আমি খুব ভালো আছি।’
ব্যক্তির সুখ অন্বেষণ এক দুর্দান্ত অপ্রতিরোধ্য পাপ। এ করার নয়। এ বোঝার নয়। আমি সুখে নেই। আমি ভীষণ রোগাক্রান্ত। আমি মানবেতর জীবনযাপন করি। ঘরে আমার স্বামী আছেন। তিনি বর নন। সত্যিকার অর্থেই স্বামী। আমি তার সংসার দেখি। আমি সেখানে আমার দায়িত্ব পালন করি। আমি তার সন্তান জন্ম দেই। আমি তার সম্পদ দেখে রাখি। আমি তাকে ছায়া দেই। মায়া দেই। পরম যত্নে মাঝরাত জেগে অসুস্থ হলে মাথায় পানি ঢালি। আমি প্রথম চৈত্রে একাহারী থাকি। উপবাসে দেখি না চাঁদের মুখ স্বামীর চাঁদমুখ না দেখে। আমি কখনো খুলি না হাতের শাখা। খুলি না নাকের নথ। আমার নিঃশ্বাস যা নাকের নাকফুলে লেগে পরিশুদ্ধ না হলে ওই শ্বাসে স্বামীর অমঙ্গল। আমি যথা-অযথা কাজে খেতে ভুলে যাই কিংবা সময় করে উঠতে পারি না আহার গ্রহণ করার। কিন্তু আমি কখনো ভুলি না স্বামীর মঙ্গল কামনায় দিতে সিথিতে সিঁদুর। কখনো প্রেমে ভালোবেসে গান গেয়ে ঘুম পাড়াই তারে। খুব যাতনায় পা-ও টিপে দেই। নখ কেটে দেই। কখনো ফেসিয়াল করে দেই। চুলে মেহেদি লাগিয়ে দেই। আমি দুরন্ত সন্তানকে দুহাতে আগলেও স্বামীর জন্য নিজে হাতে নাস্তা এবং চা করে দেই। দুঃসময়ে মাথায় ছাতা ধরি। রাস্তায় নেমে পড়ি তিনি বিলাস করে চাকরি ছেড়ে দিলেও। আমি তাকে এতই ভালোবাসি। আমি তার অকর্মন্যতার দায় কাঁধে নিয়ে অবুঝ শিশু সন্তানের নিরাপত্তাও হরণ করি। আমি মা আমি প্রেমিকা। আমি দেবী দুর্গা। আমি দশহাতে সামলাতে পারি জীবনের জয় পরাজয়। স্বামীর যত বিলাস। আর বিলাসী বিষধর জীবনপ্রণালী। হায় আমি সংসারী। আমি পরিবার ধরে রাখি। আমি প্রথাকে সম্মান করি। আমি বাবার মুখ রক্ষা করি। আমি মায়ের সম্মান যতনে রাখি। আমি অনন্যা। আমি অসাধারণ। আর তাই স্বামী রেগে গেলে জবাই করতে উদ্ধত হয় আমাকেই। সন্তান অবোধ চোখে দেখে তার বাবার আস্ফালন। পুত্র আমার তার বাবার কাছে শিখে নেয় কী করে বসে রাখতে হয় নারীকে। আর কন্যা হলে নিজে নিজেই ভেবে নেয় এভাবেই নারীকে বেঁচে থাকতে হয়। এভাবেই মাথা নিচু করে চলার নামই নারী জীবন। ফ্লায়িং কিকে ছিটকে পড়ি দূরে সদ্য সন্তানের জন্ম দেওয়ার কিছুদিন পরেই। তবু আমি স্বামীর জন্য ভাত রাঁধি।
আমি বলছি নারীর কথা। মানুষের কথা। বলছি আমার কথা। আমার পাশের বাসার নারীর কথা। আমার বোনের কথা। আমার সহকর্মীর কথা। আমার জীবনব্যাপী দেখে আসা ঘরে কি বাইরে যুদ্ধবাজ সব নারীদের কথা। তবু কখনো নারী উদ্ধত হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে শ্যামা কালী। বিষধর হয়ে ওঠে। খড়্গ উঁচু করে ধরে। পারস্যুয়েশন অব হ্যাপিনেস বলে বিষয়টা তার বোধে খুব গোপনে লুকিয়ে থাকে। কখনো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। জড়িয়ে পড়ি তখন অন্য আর এক পুরুষের প্রেমে। সেখানেও আর এক যাতনা। ভুল মিথ্যে অভিনয় আর প্রতারণার পাহাড়। আমি ভেঙে ভেঙে গড়ি নিজেরে। তারপর আবার ভাঙি। আবার গড়ি। তারপর একদিন ঘন অন্ধকার খুঁজি। অন্ধকার ভালোবাসি। অন্ধকারে বেঁচে থাকি। অন্ধকারে মরে যাই। কেউ জানে না। যে ভাইর মুখ ডুবেছিল ঘর ছেড়েছি বলে। আমি স্বামী ছাড়া অন্য আর পুরুষকে ভালোবাসি বলে। যে বোনের মুখ অন্ধকার হয়েছিল যে আত্মীয়ের ুমুখে আমার দুষ্কর্মের শত গান বেজে উঠেছিল সপ্তসুরে তালেলয়ে, তারাও সব তখন অতলে গভীর অন্ধকারে। জানে না, খোঁজে না, লয় না কোনো খবর, আমার কি আমার সন্তানের বিপদে আনন্দে এমনকি মরণেও। খুব বিষাদ আজ মনে ধ্যানে স্বপ্নে আর বাস্তবে। যে মেয়েটি রূদ্ধশ্বাসে বের হয়েছিল সংসার ছেড়ে। সঙ্গে ছিল একমাত্র পুত্র। তারেও ভালোবেসেছিল কেউ। দারুণ সে ভালোবাসা। দুর্দান্ত সে মানুষ। হ্যাঁ, তারে আমি মানুষই বলি, বলি না পুরুষ। আমি তাদের পাশে-পাশে। কে চায় নারীর সুখ। কে চায় নারীর মঙ্গল? কেউ না, কেউ না, কেউ না। তার ঘর, তার মা, তার বাবা, তার ভাই, তার পরিবার, তার আজীবনের সংস্কার প্রথা। তাই অসাধারণ প্রেমে দারুণ সুখে যাপিত যৌথ জীবনকে হঠাৎ ছুটি দিতে হয় তার। সে নারী।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করে বিসিএস পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করেও সরকারি চাকরিতে জয়েন করেও তাকে সব ছেড়ে চলে যেতে হয় বিদেশে। ফিরে আসতে হয় গায়ে কাঁটা দাগ আর মনে দারুণ ক্যান্সার নিয়ে। তবু তো মানুষ। আর কেউ জানুক বা মানুক কিংবা না জানুক না মানুক। সেতো মানুষ। মানুষ তো সে? হঠাৎ তার ভেতরের মানুষ জেগে ওঠে। সে মানুষ খোঁজে। পেয়েও যায় দারুণ মানুষ। কী দেয়নি তারে সে পুরুষ? কী করেনি তার জন্য সে পুরুষ? তারে জানাই শত শ্রদ্ধা। আজ নারীর পর্ব ১২ ছাড়া আর কোনোই মাধ্যম নেই যাতে আমি মনখুলে বলতে পারি তার স্বরূপ, জানাতে পারি আমি শ্রদ্ধা। ঝেড়ে দিতে পারি আমার আজন্মের সব ক্ষোভ। তার সঙ্গে সম্পর্কটা আমার তেমন নয়। এমনকি প্রায় প্রায়ই দেখা হলেও নয়। সে নারীকে হাত পা বেঁধে নিজের পুত্র সন্তানটিকে সঙ্গে দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো সেই চিরায়ত আগুণের নদীতে। না হলে যে মা গলায় দড়ি দেবেন। পরিবারের মুখে পড়বে চুনকালী। বোনেরা স্বামীর কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। স্ত্রীর কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না ভাই। আত্মীয় স্বজন নিয়ে সমাজে মাথাটা বড় হেঁট হয়ে যাবে সবার। তাই সবার সব পাপের দায় কাঁধে নিয়ে সে চলে যায় পুরনো সংসারে। যে স্বামী কোনোদিন বর নয়। যে স্বামী কোনোদিন বন্ধু নয়, যে স্বামী কোনোদিন প্রিয়তম নয়। তারই সঙ্গে আবার দুঃসহবাস। সেই প্রথাগত নিয়ম পালন। এদিকে যার জীবনের অনেক অনেক সময় গিয়েছে চলে। যার জীবনের নতুন প্রবাহ গিয়েছিল খুলে, শুধু তারেই নিয়ে, তারেই ভেবে। কী তার রূপ এবার? কিই বা তার স্বরূপ। অপমানে অসুখে অযতনে যাতনায় বিরহে ক্লান্ত বিধ্বস্ত তার দিন শরীর আর মন। মন? হায় মন। কে রাখে মানুষের মনের খবর?
সত্যিই আমি তখন থাকি তার কাছে-কাছে পাশে-পাশে। দেখি একজন মানুষ কাঁদে অন্য আর এক মানুষের জন্য। তখন ভাবি মনে মনে এ কি পুরুষ? পরনারীর প্রেমে পাগল দায়িত্বে শতহস্ত যত্নে পিতার মতো? আমি মানুষকে ভেঙে যেতে দেখিছি নারীর জন্য। আমি মানুষকে উড়িয়ে দিতে দেখেছি মানুষের জন্য। সে আমি কী করে বলি পুরুষ আগ্রাসী? পুরুষ শাসক? পুরুষ নিপীড়ক? পুরুষ দূঃশাসন? পারি না। আর তাই এই অটোবায়োগ্রাফির নাম দেই নারী। অনেক প্রশ্ন ওঠে তখন। কেউ কেউ ধরেই নেন, এখানে কেবল নারীর ওপর পুরুষের আস্ফালনের কাহিনীই তুলে ধরা হবে। কিন্তু না। আমি নারীকে তুলে ধরছি কেবল। নারীর রূপ নারীর ছলনা নারীর অরূপ নারীর যাতনা নারীর স্খলন কি দহন যাতনা কিংবা বিষাদ। তার পাশে পাশে পুরুষ – কিভাবে কেন কি অন্যায় কি ন্যায় নারীর জীবন। এই লিখে চলেছি। একমাত্র তাই লিখে চলেছি যা যা ঘটছে যা দেখছি আর যা যা সইছি অবোধ অক্ষম মানুষের মতো!
চলবে..