॥পর্ব-৩৩॥
আমি ফিরে আসি। ফিরে আসি প্রিয় ঘরে। আর কোনো যোগাযোগ করি না তার সঙ্গে। ফিরে আসি প্রিয় মৈত্রী হলের একার সন্যাসে। ছাদে উঠি। নিচে তাকাই। ছাদের কোণাটায় একধারে, অন্যদিকের কোণায় পা তুলে, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে বসি। আকাশের সন্ধ্যার আলো নেভে। নিচে ঘাসের মাঠে প্রেমিকেরা আগেরই মতো ফুল হাতে আসে প্রেমিকার কাছে—চেয়ে দেখি। প্রেমিকারা ফুল হাতে রুমে ফিরে আসে। প্রেমিকেরা ফিরে যায় প্রেয়সীর চোখের তারায় জ্বলে থাকা স্বপ্ন বুকে নিয়ে। চেয়ে দেখি। আকাশ অন্ধকার হয়। কখনো ঘনঘন রিমঝিম, কখনো ঝুমঝুম বৃষ্টি ঝরে। আমি বসেই থাকি ছাদের কোণে। বৃষ্টিতে ভিজে যাই, মেঘে মেঘে উড়ে যাই, কান্নায় ভেসে যাই। কোনো কোনো রাতও পার হয় এভাবেই। আমি নির্বাক আকাশ দেখি। হঠাৎ কখনো সচকিত হই। পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে পাপামেলন নামের জামরঙা গোলাপ। কেউ যেন খুব কাছে ডাকে, এই পেছন থেকে বলে উঠবে, ‘জলকুসুম, জলকুসুম’। ডাক শুনি বিভ্রমে। তারপর একসময় এটি কেবলই শাপলা ফুলের আর এক অর্থবোধক শব্দ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই। প্রাণপণে নিজেকে গুটিয়ে আনার চেষ্টা করি। ম্যধরাতেও উঠে যাই ছাদে। একা। কখনো কখনো লুবনা আসে। আমাকে সঙ্গ দিতে। অনেক রাত জাগি তারার সঙ্গে। আঁধারের সঙ্গে মেঘের সঙ্গে।
লুবনা খুব নরম মনের মেয়ে। খুব চুপচাপ। খুব চাপা। তবু কথা বলে। আমাকে ভালোবাসে। আমার মন ভালো করতে চেয়ে কথা খুঁজে পায়না। তবু চুপ করে বসে থাকে রাতের আকাশের নিচে আমার পাশে। কখনো কনকনে ঠাণ্ডা হিম রাত। ছাদে লেপকাঁথা নিয়ে উঠি দুজনে। খোলা মাঠে বসে এসডি রুবেল গায় রাগ বেহাগ। বাতাসকে আরও আর্দ্র করে তোলে ওর কণ্ঠ। আকাশ ভাসে বাতাস ভাসে, ভাসে যাতনা, ভাসে বিষাদ বেদনা। জল জমে আমার চোখে, লুবনারও চোখে। ফ্লাস্কে চাও থাকে কোনো কোনো রাতে। কখনো নির্বাক তারাদের দিকে চেয়ে দুজনেই শুয়ে থাকি রাতের আঁধারে এক অদ্ভুত বিন্যাসে। ভোর হয়। সবাই ক্লাসে যায়। আমি প্রায় প্রায়ই ক্লাসে যাই না। কিভাবে দিন যায়, বলতে পারি না। শুনতে পাই, আবার আসা-যাওয়া চলে তার হলের মাঠে। শুনতে পাই, তার মন খুব বিষণ্ন। চুল দাড়ি শেভ না করতে করতে লম্বা হয়ে গেছে। কাঁধে ঝোলা। লেখাপড়া সবই ছেড়েছে একেবারে। মৈত্রী হলে আমার সব বন্ধু তারও বন্ধু। রূপা, শর্বরী, ডেইজী, রীতা, মুন্নি—ওদের সঙ্গেও বেশ আড্ডা জমে তার। লুবনার সঙ্গে বেশি কথা হয়। আমার কাছে লুবনার আসা-যাওয়া কমতে থাকে। লুবনা থাকে ১১১ নম্বর রুমে, নিচ তলায়। আমি ৫০৯ নম্বরে ৫ তলায়। কখনো যদি রাতে নিচে নামি, তখন দেখা হয় লুবনার সঙ্গে। তার সঙ্গে কী কী কথা হয়, এসব লুবনা আমাকে শোনায়। বুঝতে পারি, তার বেদনায় লুবনার কষ্ট যোগ হয়েছে। ধীরে ধীরে লুবনার সঙ্গে তার সখ্য বাড়তে থাকে। আমি তখন কোনো এক ছুটিতে ময়মনসিংহ গেছি। একদিন হঠাৎ রাত আনুমানিক নটা হবে। লুবনা আর সে আমাদের বাসায় এসে উপস্থিত। আমি তো দরজায় লুবনাকে আর পাশে তাকে দেখে অবাক। এত রাতে! তোরা! লুবনাকে আমার কাছে রেখে সে চলে যায়। রাতে কথা বলে জানতে পারি তার মনটা খুব খারাপ। হঠাৎ করে মনে হলো—‘চল লুবনা দূরে কোথাও যাই, বলেই ওরা দে ছুট।’ সকাল হতে সে লুবনাকে নিতে আসে। ওরা মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি দেখতে যাবে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ষোলো কিলোমিটার দূরে। লুবনা আমাকে বার দুয়েক যেতে বলে সঙ্গে। আমার যেতে ইচ্ছে করে না। লুবনার কথায়ও তেমন জোর দেখিনি। ওরা ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় নটা। আব্বা রাগ করেন। অত রাত করে লুবনাকে রেখে যেতে এলে বেশ জোরে কথা বলেন। লুবনার খুব মনে লাগে। সারারাত লুবনাকে বিষণ্ন দেখি। ধীরে ধীরে তার প্রতি লুবনার, হয়তো লুবনারও তার প্রতি ভীষণ একটা আশ্রয়ের সম্পর্ক হতে থাকে। আমার তাই মনে হতে থাকে। আমি প্রাণপণে তার কাছ থেকে লুবনার কাছ থেকে দূরে সরতে চাই। আমিও খুব করে অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার আর সেটা হয় না।
ঢাকা নান্দনিক নাট্য সংস্থায় তখন যোগ হয়েছিলাম উজ্জ্বলাদির কারণে। ওখানে বেশি করে সময় দিতে চেষ্টা করি। স্রোত আবৃত্তি সংসদের ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনায় আরও বেশি করে মন দিতে চেষ্টা করি। তবু রাতের বেলা প্রভোস্টের বাসার পেছন দিকে লাগোয়া, মৈত্রী হলের যে নীরব অংশটি, সেখানে আমি আর লুবনা বসি। অনেক কথা হয়। মুক্তাগাছায় তোলা ওদের দুজনের ছবি দেখায় আমাকে। বন্ধুরা সবাই বোধ করি খুব চাইছিল ওদের মধ্যে হৃদয়ের সম্পর্ক হোক। লুবনার কথা আমি বলতে পারি না। তখন লুবনার বড় খালার ছেলে শামীমভাই ছোটবেলা থেকে স্থির করে রাখা ওদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী। লুবনাকে রাজি করানো যাচ্ছে না। কিন্তু ওদের অনেক পথ চলা একসঙ্গে। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হওয়া ওদের। এসব গল্পে গল্পে রাত পার হয়ে যায় আমাদের। কিন্তু লুবনার সঙ্গে আমার কবির সখ্য বাড়তেই থাকে। আমারও সে বিষয়টি কেন যে সহ্য হয় না। আমি একসময় অন্য সব বন্ধুর সামনেই রিঅ্যাক্ট করে বসি। লুবনা বরাবরই কম কথা বলা মানুষ। সবসময়ই দোটানায় থাকা মানুষ। কোনো সিদ্ধান্ত একা নিতে পারে না। একেবারেই প্রতিক্রিয়াশীল নয়। নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকাই তার স্বভাব। লুবনা গুটিয়ে নেয় নিজেকে। তারপরের খবর আর আমার জানা নেই। চলে যায় একটি বছর। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি কবিতা আবৃত্তি আর নাটকের গ্রুপের কাজ নিয়ে। ভাইজানের বিয়ে হয়ে যায় আমারই রুমমেট বাংলা ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র আপা করবীর সঙ্গে। ভাইজান আবার চলে যায় রাশিয়ায়। আবার ফিরে আসে। আবার চলে যায়। আবার আসে। বন্ধুরা যে যার মতো। তার কথাও আর জানি না। শুনেছি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আলাভোলা জীবন। স্বেচ্ছাচারিতায় ভরে উঠেছে তখন তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন। খবর পাই ময়মনসিংহের বন্ধুদের কাছে। অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায়।
আব্বা সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেন। ভাইজান আমার পড়াশোনার খরচের দায়িত্ব নেয়। কিছুদিন পরই তার আঁকাবাঁকা কথা আর বানিয়ে বানিয়ে বাড়িতে আমার নামে মিথ্যে কথা বলাটা মাত্রা অতিক্রম করে। আমার সহ্য হয় না। আমি বড় ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না। আব্বাকে বলি, অনার্সের রেজাল্ট হয়ে গেলে আমি আর লেখাপড়া করতে চাই না।
আব্বা কোনো কারণ জানতে চান না। বলেন, ভেবো না এ সংসারে কেবল ছেলেরাই শেষ অবধি পড়বে। এখানে ছেলে-মেয়ে নেই। পড়া শেষ করো।
আমি আব্বার এই উত্তরে ফিরে আসি। চাকরি খুঁজি। আমি তখন উদ্ভ্রান্ত। দিশেহারা। হলের বিকেল অসহ্য। বিরক্তিকর। কাজ নেই। একসময় বন্ধুত্ব হয় প্লেয়ার কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা আবাহনী ক্লাবের হকি প্লেয়ার আলমগীর, রাজু, মামুন, সিয়াম, খুরশীদের সঙ্গে। আলমগীর তখন জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন হয়ে খেলছে। মুন্নাই একমাত্র ফুটবল খেলে। অল্প বয়সেই ওরা প্রচুর ইনকাম করে। প্রচুর দেশ ঘোরে। পড়াশোনায় কেউই তেমন ভালো নয়। কিন্তু নিশ্চিন্ত। নির্ভয় ওরা। উদ্দাম গতিশীল জীবন ওদের। খুব হৈ চৈ হাসি আড্ডায় কেটে যায় মৈত্রী হলের মাঠে। কখনো মেইন গেটের বাইরে শাহনেওয়াজ হলের পাশেই ফুটপাথে বসে। আমি তখন বেপরোয়া। আমি আর কাউকে মানব না। ভাইকে না। প্রতারক প্রেমিককে না। সমাজকে না। সংসারকে না। ওরা তখন বেড়াতে যাবে সব বন্ধু উত্তরবঙ্গ। নাটোরে আলমগীরের বাড়ি হয়ে জয়পুরহাটে মামুনদের বাড়ি ঘুরে আবার ফিরে আসবে। মৈত্রী হলের সব বন্ধুরাও যাব ঠিক করি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোন রাজনীতির প্যাঁচ কষতে থাকে কে জানে। মেয়েরা কেউ যাবে না। আমি কথায় অটল। যাব বলেছিলাম। যাবই। হোক সব ছেলে আর একা আমি মেয়ে। আমি আমার কথা রাখব। ওরা আমার ভালো বন্ধু। রাতের গাড়িতে রওনা হই আমরা। পেছনে পড়ে থাকে কানকথা। সমাজ ভাঙা দুঃসাহসী নষ্টাভ্রষ্টা শাপলাকে নিয়ে যখন জোর গুজব প্রিয় প্রিয় বান্ধবী নামের নারী মুখে, তখন ভোরে আমি গিয়ে নামি শান্তাহার রেলস্টেশনে। রিকশায় আমি, রাজু আর আলমগীর। ভোরের হাওয়ায় ঠাণ্ডা বাতাসে আমাদের তিনজনের বাধনহীন দুরন্ত দুর্বার গতিময় আনন্দের বন্যা। পুরো একটি দিন নওগাঁয় আলমগীরের ভাই-ভাবির বাড়িতে পরম আত্মীয়ের মতো দিন কেটে যায়। পরদিন আমরা স্টার্ট করি জয়পুরহাটে মামুনের বাড়ির উদ্দেশে। যাব খঞ্জনপুর।
চলবে…
নারী: পর্ব-৩২॥ শাপলা সপর্যিতা