॥পর্ব-৪ (শেষ পর্ব)॥
চিত্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে বক্তব্যের বিষয়কে চিত্র-প্রতিচিত্র সহযোগে তুলনামূলক একাধিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করা, যেন বিষয়টিকে তার বহুমাত্রিকতায় দেখে গভীররভাবে ও নিবিড়ভাবে বুঝতে পারা যায়। যেখানে সবটুকু বুঝে ওঠা সম্ভব নয়, সেখানে তাকে যতদূর সম্ভব তার ইঙ্গিতময়তার তাৎপর্যে চেনে নেওয়া। কাছের বিষয়কে দূর থেকে, দূরের বিষয়কে কাছে নিয়ে, অন্তরের বিষয়কে বের করে, বাইরের বিষয়কে অন্তরে নিয়ে বুঝে নেওয়ার কাজটিতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয় সুনির্মিত চিত্রকল্প। উপমা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একরৈখিকতায় কাজ করে কিন্তু চিত্রকল্প বিষয়কে বহুরৈখিকতায় উপস্থাপন করতে চায়। কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমের গানে বিশেষত বিরহের গানে অদ্বিতীয় সঙ্গীত রচয়িতা। বিরহের যে কত রঙ হতে পারে, তা জানা যায় নজরুলের প্রেমের গান শুনে বা সেসব গানের বাণী পাঠ করে। অভিজ্ঞতা ও অনুমান, দৃষ্টি ও কল্পনা, অনুভব ও স্বজ্ঞা বিনিয়োগ করে তিনি রচেছেন বিচিত্র স্বাদের বিচিত্র রঙের বিচিত্র অর্থব্যঞ্জানার অজস্র প্রেমসঙ্গীত। সেসব রঙ-রস-গন্ধ-স্বাদ-ব্যঞ্জনা সৃজনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে অসাধারণ মানের নানাবিধ চিত্রকল্প। বিরহও যে কত উপাদেয় ও উপভোগ্য হতে পারে, তার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নজরুল ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ সূচক বিখাত প্রেমসঙ্গীতটিতে। এই গানের প্রতিটি স্তবক পূর্বনজিরহীন চিত্রকল্পে সুসজ্জিত। এই গানে অতীতের স্মৃতি নয়, অভিজ্ঞতার বর্ণনা নয়, কাউকে দোষারোপ করা নয়, বিরহভরা দিনরাত যাপনের ভয়ংকর-সুন্দর অগ্রিম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যা চোখের জলে ভিজিয়ে উপভোগ করতে হয়। অগ্রিম দুঃখের মাধুরীতে অনুরক্ত ও আবিষ্ট হয়ে ওঠে প্রেমাভিজ্ঞ প্রাণমন। বিরহ মানেই চোখের জল । নজরুল সেই চোখের জলকে করে তুলেছেন ঝরঝর বৃষ্টি আর উতলা নদীর শ্রাবণ-প্রকৃতি। চিত্রকল্পগুলো ধারণ করেছে ভয়ংকর-সুন্দর প্রকৃতির ছবি আর বিচ্ছেদাতুর প্রাণের দুর্দমনীয় আবেগ-উতরোল। গানের এক একটি স্তবক এক একটি চিত্রকল্প আবার সবগুলো একসাথে একটি অভিন্ন চিত্রকল্প।
শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে॥
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে॥ঝুরিবে পূবালি বায় গহন দূর-বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে
যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলীর দীপ-শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু’হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে॥
চিত্রকল্প নির্মাণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি যাতে করে আকৃষ্ট ও আকুল হয় পাঠক-শ্রোতার হৃদয়মন। নজরুল একইসাথে আধুনিক ও রোমান্টিক কবি। তিনি প্রথাভাঙ্গার কবি। তাঁর সৌন্দর্যচেতনাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনন্য ও অভিনব। তিনি তাঁর গানের বাণীতে একাজটি করেছেন সবচেয়ে বেশি এবং অত্যন্ত সফলভাবে। নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘তোর রূপে গন গাহন করে জুড়িয়ে গেল গা’ সূচক গানটিতে অভিনব চিত্রকল্পের মাধ্যমে তেমনি অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন।
তোর চরণের আলতা লেগে
পরাণ আমার উঠল রেঙে (রে)
ও তোর বাউরি কেশের বিনুনীতে জড়িয়ে গেল পা॥তোর বাঁকা ভুরু, বাঁকা আঁখি, বাঁকা চলন সই,
দেখে পটে আঁকা ছবির মতন দাঁড়িয়ে পথে রই।
গানের নারীকে দেখে কবির অন্তর রেঙে ওঠা, তার বাউরি চুলের বিনুনীতে পা জড়িয়ে যাওয়া এবং পটে আঁকা ছবির মতো নির্বাক ও নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রভৃতি রূপকল্পে তার সহজ সৌন্দর্যের অতল মাধুরী এবং সম্মোহন শক্তির অপ্রতিরোধ্যতার প্রকাশ বিধৃত। বাউরি কেশের বিনুনীতে পা জড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্যকল্পটি সম্পুর্ণরূপে অভিনব ও অপূর্বসুন্দর। কেশ আর পায়ের অবস্থান দুই বিপরীতে মেরুতে। কাজেই কেশে পা আটকে যাওয়ার দাবিটা অবাস্তবই মনে হয়, যেমন অবাস্তব মনে হয় পাখির নীড়ের সাথে চোখের তুলনা। আসলে ওই পল্লীমেয়ের বাউরি চুলের সৌন্দর্য এতটাই মোহনীয় যে- কবি সে সৌন্দর্যে চোখ দিয়ে আর দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না। দৃষ্টি ফেরাতে গেলে সায় মেলে না মনের। ফলে তার অবস্থা যাকে বলে অপলক দাঁড়িয়ে থাকা। তো দাঁড়িয়ে থাকলে পা চলবে কিভাবে? শেষপর্যন্ত এই দাঁড়ালো যে- বাউরী চুলের সৌন্দর্যের বাঁধনে আটকে গেছে ভুবনচারী কবির পা। আপাত অসঙ্গতিপূর্ণ অথচ গভীর ব্যঞ্জনায় নিখুঁতভাবে সঙ্গতিপূর্ণ এমন রূপকল্প কটি বাংলা গানে পাওয়া যাবে? নজরুল শুধু স্বতন্ত্রই নন- অনন্যও যে বটে, তার নমুনা এমন অদ্ভুত-সুন্দর চরণ। আর এটি শুধু নারীর চুলের মোহন সৌন্দর্যকেই তুলে ধরে না, তার রূপগুণের সম্মোহন জালে কবির হৃদয়মন আটকে যাওয়ার মধুর বিষয়টিকেও উদ্ভাসিত করে তোলে।
গভীর নিবিড় অনুরাগের সৌন্দর্য সৃষ্টির কাজটি নজরুল তাঁর অগুণিত গানে করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে অভিনব চিত্রকল্প সৌন্দর্য সৃষ্টির কাজে মূল সহায়তা জুগিয়েছে। নজরুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দিবো খোঁপায় তারার ফুল’ গানটি মূলত অনুরাগ প্রকাশের মিষ্টি গান। রোমান্টিক মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি রচেছেন অনুরাগের নান্দনিক বয়ান। অভূতপূর্ব যতসব চিত্রকল্প সহযোগে কবি রচেছেন শিল্পসুষমার অবিনশ্বর সৌধ। সেইসব চিত্রকল্পে শৈল্পিক সুষমায় একাকার হয়েছে মাটিবর্তী বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং আকাশচারী কল্পনা। তারা ফুল, তৃতীয়া তিথির চৈতীচাঁদের দুল, হংস-সারির দুলানো মালিকা, বিজলি জরীণ ফিতা, মেঘরঙ এলোচুল, জোছনার সাথে চন্দনের সংমিশ্রণ, রামধনুর রঙ দিয়ে তৈরী আলতা প্রতিটি উপকরণে বাস্তব অভিজ্ঞতা আর কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটেছে। পুরো গানটি একাধিক মনোহর চিত্রকল্পের আকাশ যেখানে তাকালে চোখ জুড়ায়, মনও ভরে। গানের ‘জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে মাখাবো তোমার গায় / রামধনু সাতরঙ ছানি আলতা পরাবো পায়।’ চিত্রকল্পটিতে নান্দনিক সৌন্দর্য উপচে উঠেছে। এই সৌন্দর্য চোখ দিয়ে দেখার যতখানি, তারচেয়ে বেশি কল্পনায় এঁকে নেয়ার, তারচেয়েও বেশি সৌন্দর্যপিয়াসী মনের উপভোগের। যাদের সৃজনশীল মন নেই, যাদের মনে ন্যূনতম রোমান্টিকতা নেই, তাদের পক্ষে এসব চিত্রকল্পের মহিমা বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। নজরুলের আরেকটি অনুরাগের গানেও একই রকম শিল্পসৌন্দর্য ও অপূর্বসুন্দর চিত্রকল্পের সমাহার লক্ষ করা যায়। ‘গুনগুনিয়ে ভ্রমর এলো ফুলের পরাগ মেখে / তোমার বনে ফুল ফুটেছে যায় কয়ে তাই ডেকে। ’ সূচক গানটির প্রতিটি স্তবক এক একটি দারুণ সুন্দর চিত্রকল্প যেখানে মিষ্টি কল্পনা আর মাটিবর্তী অভিজ্ঞতা মিশেছে শৈল্পিক সুষমায়। প্রথম স্তবকে প্রিয়জনের বাগানে ফুল ফোটার খবর। পরের স্তবকে তা আরও নিবিড় হয়ে অনুরাগের গোপন খবরটি অনেকখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে—‘তোমার ভ্রমর দূতের কাছে / যে বারতা লুকিয়ে আছে / দখিন হাওয়ায় তারি আভাস শুনি থেকে থেকে।’ তার পরের চিত্রকল্পে ফুল ফোটার খবরটি বাগান থেকে মনে উন্নীত হয়ে তা প্রকৃতির রূপ বর্ণনা থেকে মানবীয় প্রেমের আখ্যান হয়ে উঠেছে, ‘দল মেলেছে তোমার মনের মুকুল এতদিনে / সেই কথাটি পাখিরা গায় বিজন বিপিনে। ’
শেষ স্তবকের চিত্রকল্পটি আরও মনোহর আর অনুরাগনিবিড় যেখানে মন দিয়ে মন ছোঁয়া এবং তারও অধিক শারীরিক স্পর্শের শিহরণ আভাসিত উদ্ভাসিত উদ্বেলিত হয়ে উঠতে চেয়েছে: তোমার ঘাটের ঢেউগুলি হায় /আমার ঘাটে দোল দিয়ে যায় /লতায় পাতায় জোছনা দিয়ে গেন কথা চাঁদ লেখে॥’শেষের লাইনটির সৌন্দর্য ব্যঞ্জনা চাঁদনীরাতের তাজমহলের রূপমাধুরীর মতো অনিঃশেষ।
গীতিকার-সঙ্গীতকার নজরুল ইসলামের অন্যতম অসামান্য কৃতিত্ব হচ্ছে বাংলাভাষায় ইসলামী গানের প্রচলন করা। ইসলাম ধর্ম মধ্যপ্রাচ্য থেকে সূচিত হয়ে একসময় ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। নজরুলের ইসলামী জাগরণমূলক গানগুলোতে খুবই যুৎসইভাবে সে-সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের নানাবিধ অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে। এধরনের গানে তিনি এমনসব চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন যা মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সুদিনের কথা তুলে ধরেছে এবং একইসাথে তাদের মন-মেধা-অভিজ্ঞতা-বিশ্বাসে আত্মজাগরণের বার্তা, প্রেরণা, শক্তি, সাহস এবং ইতিবাচক উন্মাদনা সঞ্চার করেছে। তেমনি একটি গান , ‘বাজলো কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে।’ গানটির প্রতিটি চরণ, প্রতিটি স্তবক একেকটি অভিনব চিত্রকল্প। আবার সব চিত্রকল্প মিলে একাকার হয়ে সৃষ্টি করেছে ইসলামি জগতের ও জাগরণের একটি অনন্যসুন্দর অখণ্ড চিত্রকল্প। প্রতিটি খণ্ড খণ্ড চিত্রকল্প এক একটি ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে যেখানে তথ্যের চেয়ে সংকেত, ইঙ্গিৎ ও ব্যঞ্জনার অবদান অনেক বেশি। আবার একাধিক চিত্রকল্পের সমন্বয়ে সৃষ্ট গানটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছবি এঁকে সেই ছবির শরীরপ্রাণে রঙে-রূপে-রসে-ইঙ্গিতে-সংকেতে জুড়ে দিয়েছে আত্মস্মৃতির অধ্যায়, আত্মবিশ্বাসের শক্তি এবং আত্মজাগণের উন্মাদনা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছবি সোচ্চার হয়ে উঠেছে প্রেরণাগর্ভ প্রণোদনায়। ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রচ্ছদে পরিণত হয়েছে এবং মুখ্য ছবি হয়ে উঠেছে জাগরণী-বার্তা। অর্থাৎ শাব্দিক অর্থ ছাড়িয়ে বড় সত্য হয়ে উঠেছে মর্মার্থ বা ব্যঞ্জনা। এখানেই চিত্রকল্পের চূড়ান্ত সাফল্য।
বাজলো কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে
শুনছি আজান গগন-তলে আঁধার-রাতের মিনার-চূড়ে॥
সরাইখানার যাত্রীরা কি
‘বন্ধু জাগো’ উঠলো হাঁকি’ ?
নীড় ছেড়ে ঐ প্রভাত-পাখি
গুলিস্তানে চললো উড়ে॥তীর্থ-পথিক দেশে-বিদেশের
আরাফাতে আজ জুটলো কি ফের,
‘লা শরীক আল্লাহু ’ মন্ত্রের
নামলো কি বান পাহাড় ‘তুরে’॥আজকে আবার কাবা’র পথে
ভিড় জমেছে প্রভাত হতে
নামলো কি বান ফের হাজার স্রোতে
‘হেরার’ জ্যোতি জগৎ জুড়ে॥আবার ‘খালেদ’ ‘তারেক’ ‘মুসা’
আনলো কি খুন-রঙীন ভূষা,
আসলো ছুটে হাসীন উষা
নও-বেলালের শিরীন-সুরে॥
কাজী নজরুল ইসলাম সংগ্রামী গান রচনায় অতুলনীয় কৃতিত্বের অধিকারী। এক্ষেত্রে তাঁর কোনো জুড়ি নেই। অগ্নিগর্ভ বাণী আর বারুদমাখা সুরে রচিত গানগুলি শোনামাত্র উত্তেজনায় টানটান হয়ে ওঠে আবেগ। এসব গানেও নজরুলের মূল অস্ত্র বারুদগর্ভ শব্দ আর উত্তেজক কল্পচিত্র সহযোগে নির্মিত অভূতপূবরূপে সুন্দর চিত্রকল্পবলী। উদাহরণস্বরূপ তাঁর ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পরাবার ‘ শীর্ষক গানটির কথা বলা যায়। গানটির প্রতিটি স্তবক এক একটি অগ্নিগর্ভ চিত্রকল্প। ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ / কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ’ অথবা ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ও রে জিজ্ঞাসে কোন্ জন? / কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর।’ চিত্রকল্পসমূহ একেবারেই আনকোরা নতুন । আর এসকল চিত্রকল্পের মধ্যেই জাতির বিপদের ভয়াবহতা, গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা এবং তা থেকে উত্তরণে যে সাহস, শৌর্যবীর্য, ঐকবদ্ধ সংগ্রাম ও দুরদর্শী নেতৃত্বের প্রয়োজন, তা চমৎকার ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
একথা কারও অজানা নয় যে নজরুল বাংলা গানের জগতে গজলের প্রবর্তন করেন এবং তাঁর রচিত গজল অভাবণীয় জরপ্রিয়তা অর্জন করে যা আজও সমানভাবে সত্য হয়ে রয়েছে। গজল মূলত পারস্য দেশের গান। নজরুল বাংলা ভাষায় গজল রচনা করেছেন। তাঁর গজলের মূল বৈশিষ্ট্য পারস্যের কাঠামো এবং বাংলার প্রাণ। আবার তাঁর অনেকে গজলে পারস্যেও গজলের আবহ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ সুন্দর এবং অভিনব চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। শিরাজী, সাকি, প্রেম-দেওয়ানা, আনারকলি, গুল-বাগিচা, লাল শারাব, বুলবুল, আঙুরলতা প্রভৃতি শব্দচিত্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ব্যবহার ঘটিয়ে তিনি সেসব গজল রচনা করেছেন। নজরুলের হাতে রচিত প্রায় সব গজলই বিখ্যাত এবং জনপ্রিয়। সেখান থেকে একটি গজলের উদ্ধৃতি দিচ্ছি যাতে পরসিয়ান খোশবুযুক্ত একাধিক চিত্রকল্পের ব্যবহার গজলটিকে আদি গজলের অনুরূপ সৃষ্টির শৈল্পিক মহিমা দান করেছে।
গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি রঙিন প্রেমের গাই গজল।
অনুরাগের লাল শারাব মোর আঁখি ঝলে ঝলমল ( হায়)॥
আমার গানের মদির ছোঁয়ায়
গোলাপ কুঁড়ির ঘুম টুটে যায়,
সে গান শুনে প্রেমে-দীওয়ানা কবির আঁখি ছলছল (হায়)॥লাল শিরাজির গেলাস হাতে তন্বী সাকি পড়ে ঢুলে,
আমার গানের মিঠা পানির লহর বহে নহর-কূলে।
ফুটে ওঠে আনারকলি নাচে ভ্রমর রঙ-পাগল(হয়)॥
সে-সুর শুনে দিশেহারা
ঝিমায় গগন ঝিমায় তারা
চন্দ্র জাগে তন্দ্রাহারা বনের চোখে শিশির জল॥
অনুরূপভাবে আরবি সুরে রচিত তাঁর বিখ্যাত গান ‘রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম খেজুর পাতার নূপুর বাজায়’ সূচক গানটিতে ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক আবহ বজায় রেখে রচিত হয়েছে। গানের সুর যেমন তার মধ্যপ্রাচ্যীয় চারিত্রকে প্রকাশ করে, তেমনি গানের বাণীও। নজরুল গানের বিষয় অনুসারে বাণীর ঐশ্বর্য এবং সুরের সৌকর্য নির্ধারণ করেছেন। এক্ষেত্রে চিত্রকল্প তাঁকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে।
আরবি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে, বাদশাজাদা বুঝি
সাহারাতে ফেরে সেই মরীচিকা খুঁজি
কত তরুণ মুসাফির পথ হারালো, হায়!
কত বনের হরিণ মরে তারি-রূপ তৃষায়॥
আরবি ঘোড়া, বাদশাজাদী, মুসাফির, সাহারা, মরীচিকা, হরিণ প্রভৃতি অনুষঙ্গ চিত্রকল্পটিকে এমন এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করে যে গানটি শোনামাত্র কিংবা গানের বাণী পড়ার পরপরই মধ্যপ্রাচ্যের ছবি মানসচোখে ভেসে ওঠে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ নজরুলকে চিত্রকল্পের সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন, আলোচিত চিত্রকল্পসমূহ তাঁর সেকথার যথার্থতা প্রতিষ্ঠিতকরণে যথেষ্ট। নজরুলের গানের বাণীর বৈশিষ্ট্য এবং বৈভব সৃষ্টিতে চিত্রকল্প পালন করেছে সিদ্ধান্তসূচক ভূমিকা। অন্যান্য কবিগীতিকারের গানের বাণীর সাথে নজরুলের গানের বাণীর পার্থক্য রচে দিয়েছে চিত্রকল্পের ব্যবহার। এসকল চিত্রকল্প নজরুলের গানের বাণীর বৈচিত্র্য ও বৈভব, সৌকর্য ও স্বাতন্ত্র্য, সৌন্দর্য ও শৈল্পিকতা বাড়িয়ে দিয়েছে অপরিমেয় মাত্রায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চিত্রকল্পসমূহ নজরুলের গানে বাণীতে এনে দিয়েছে সংযম, চারুতা ও সংহতি।
সহায়ক গ্রন্থালবি
১. রশিদুন নবী সম্পাদিত ‘নজরুল সঙ্গীত সমগ্র’ , নজরুল ইন্সটিটিউট, প্রকাশকাল ২০০৬।
২.শিখা দত্ত : আধুনিক বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প চর্চা, পুস্তক বিপণী, কোলকাতা, মে ২০০২।
৩. যূথিকা বসু: ‘বাংলা গানের আঙিনায়’, পুস্তক বিপণী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০৪।
৪. মোবারক হোসেন খান সম্পাদিত: ‘নজরুল -সংগীতের বিচিত্র ধারা’, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০০৫।
৫. সফিকুন্নবী সামাদী:‘ নজরুলের গান: কবিতার স্বাদ’, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশ কাল ২০০১।
৬. শফি চাকলাদার:‘নজরুলের উপমায় চাঁদ’, বইপত্র, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০০৪।
৭.আবদুশ শাকুর: ‘বাঙালির মুক্তির গান’, মাওলা ব্রাদার্স, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০০৭।
৮. মোহাম্মদ আবুল খায়ের: ‘নজরুল সংগীতে নান্দনিকতা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, প্রকাশকাল ২০১৪।
৯. কল্যাণী কাজী সম্পাদিত: ‘শতকথায় নজরুল ’, সাহিত্যম, ১৮ বি, শ্যামাচরণ স্ট্রিট, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৪০৫ বঙ্গাব্দ।
(শেষ)