॥পর্ব-২॥
চিত্রকল্প কখনো একটি দৃশ্য সৃষ্টি করে যার কাজ সৌন্দর্য সৃষ্টি; কখনো ছবির পেছনে ছবিকে উপস্থাপন করে। ‘আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী/চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরী ।’ এই চিত্রকল্পে বসন্তের আগমনে প্রকৃতির রেঙে ওঠা এবং তার প্রাঙ্গণ সুরে সুরে সঙ্গীতময় হয়ে ওঠার অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এটি একারণেই চিত্রকল্প যে এখানে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল আছে। বনভূমিকে মানবীরূপে কল্পনা করা হয়েছে যে সাজগোজ করে, পায়ে পরে নূপুর এবং তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অন্যপ্রান্তে বেজে ওঠে বাঁশি। সবটা মিলিয়ে এক মনোহর ছবি। নজরুল রক্তাক্ত হৃদয়ের প্রেমিক কবি। তিনি প্রকৃতিকে নিছক চোখ দিয়ে দেখেই ক্ষান্ত থাকেননি। সেই দেখার সঙ্গে মানুষের আবেগ-অনুভূতি-কামনা-বাসনা-হাসি-বেদনাকে মিলিয়ে নিয়েছেন। মানবজীবন আর প্রকৃতিকে একপাত্রে ঢেলে তার রূপ-রস-রঙ দেখে নিতে, চেখে নিতে, চিনে নিতে চেয়েছেন। নজরুলের একটি বিখ্যাত গজল ‘এলো ফুলের মরশুম শরাব ঢালো সাকি। ’ এই গানের বাণী খালি চোখে দেখলে চিত্ররূপময়। কিন্তু তার ভেতরে প্রবেশ করলে তা হয়ে ওঠে নিবিড় অনুভূতিময়। সেই অনুভূতির প্রকাশটাই মুখ্য।
এলো ফুলের মরশুম শরাব ঢালো সাকি
বকুল শাখে কোকিল ওঠে ডাকি॥
গেয়ে ওঠে বুলবুল আঙ্গুর-বাগে
নীল আঁখি লাল হলো রাঙা-অনুরাগে
আজি ফুল-বাসরে শিরাজির জলসা
বরবাদ হবে না-কি॥
চাঁপার গেলাস ভরি ভোমরা মধু পিয়ে
মহুয়া ফুলের বাসে আঁখি আসে ঝিমিয়ে।
পাপিয়া পিয়া পিয়া ডাকে বন-মাঝে
গোলাপ-কপোল রাঙে গোলাপী সাজে
হৃদয়-ব্যথার সুধা আছে তব কাছে
রেখো না তারে ঢাকি॥
এই গানে অনেক ক’টি চিত্রকল্প। বলা যায় অপরূপ সুন্দর একগুচ্ছ চিত্রকল্পের জীবন্ত উৎসব। সব চিত্রকল্পই বসন্তকালের মনোহর ছবি তুলে ধরেছে। ছবি একটিই। প্রকৃতিতে বসন্ত উৎসব লেগেছে। বসেছে শরাব পানের আসর। কোকিল, বুলবুল পাপিয়া গান ধরেছে। গোলাপ ফুল সেজেছে গোলাপি সাজে। সবার চোখে যৌবনের নেশা। সবার চোখে-মুখে আবেগ, উত্তেজনা ও রিরংসার রঙ। সবার প্রাণে প্রিয়মিলনের বাসনা। পরিবেশ রঙিন, মাদকতাময়। যে সাকি ঢেলে দিচ্ছে শরাব, তার বুকে ব্যথাভরা সুধা। সেটাও সমর্পণের মুহূর্ত এই। প্রকৃতি প্রস্তুত মিলনের মালা মন ও প্ররোচিত আবেগ নিয়ে। বাকিটা সম্পন্ন হওয়ার উত্তেজিত অপেক্ষা। সাকির বুকেও রোদনভরা বসন্ত। তার বেদনাও মিলতে চায় অন্য কারও বেদনার সাথে। কবি বলছেন, এটাই শুভ লগ্ন। এটাই উপযুক্ত সময়। এভাবেই গানটি যৌবনভরা গভীর প্রাণের মিলন-উন্মুখ মুহূর্তের মাদকতময় পরিবেশ ও রিরংসাময় দেহমনের প্রস্তুতিপর্ব রচনা করেছে অভাবনীয় সুন্দর চিত্রকল্পের কোলাজ সহযোগে। প্রকৃতি ও মানুষ একাকার রঙ ধারণ করেছে যৌবন-উছল পাত্রে। প্রকৃতি উন্নীত হয়েছে কামনাবাসনাময় সজীব সত্তায় এবং মানুষ মেখেছে বসন্ত প্রকৃতির রূপ-রস-উত্তেজনা।
নজরুলের বহুগানেই প্রকৃতিকে আবেগগর্ভ সজীব উত্তায় উন্নীতকারী অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকল্প রচনা করেছেন। কখনো পারসোনিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকৃতিকে সচলসজীব প্রাণীতে উন্নীত করে তা করেছেন। কখনোবা প্রকৃতির শরীরে জুড়ে দিয়েছেন মানবীয় আবেগ ও উত্তেজনা। অঙ্কিত ছবি কেবল ছবি হয়ে থাকেনি, সেসব অনুভব-আবেগ-উত্তেজনা-রিরংসা-বেদনার ব্যঞ্জনা নিয়ে মানুষের অনরূপ অথবা কাছাকাছি সত্তায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু কেবল জীবন্ত সত্তায় উন্নীতকরণই নয়, নজরুল এসকল চিত্রকল্পে অভাবনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন, অনিঃশেষ নান্দনিক রস সৃষ্টি করেছেন যা গানের বাণীকে অফুরন্ত উপভোগের শৈল্পিক আধারে পরিণত করেছে। নজরুলের বিখ্যাত গজল ‘কে বিদেশী বন-উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’ তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই গানের এক একটি অনুচ্ছেদ বা অন্তরা এক একটি অপূর্বসুন্দর চিত্রকল্প।
কে বিদেশী বন-উদাসী
বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে।
সুর-সোহাগে তন্দ্রা লাগে
কুসুম-বাগের গুল-বদনে॥ঝিমিয়ে আসে ভোমরা-পাখা
যূথীর চোখে আবেশ মাখা
কাতর ঘুমে চাঁদিমা রাকা
ভোর গগনের দর-দালানে
দর-দালানে ভোর গগনে॥লজ্জাবতীর লুলিত লতায়
শিহর লাগে পুলক-ব্যথায়
মালিকাসম বঁধুরে জড়ায়
বালিকা-বঁধু সুখ-স্বপনে॥
অচেনা এক বাঁশিওয়ালার বাঁশি শুনে যে প্রতিক্রিয়া জাগছে প্রকৃতির শরীর-প্রাণে, তার বর্ণনা উঠে এসেছে চিত্রকল্পসমূহে। সেকল বর্ণনা এতটাই অনুভব-আবেগ-কল্পনা নির্ভর যে ব্যাখা করতে গেলে ভাষায় কুলায় না। ‘লজ্জাবতীর লুলিত লতায় / শিহর লাগে পুলক-ব্যথায়’—এই চিত্রকল্পটি ব্যাখ্যাতীত দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। কবি তাঁর কল্পনার ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করেছেন এসব দৃশ্য যা হৃদয়ের ল্যাবরেটরীতে ডেভেলপ করে অনুভবের চোখ মেলে দেখে যেতে হয় আর আবেশে-উত্তেজনায়-মুগ্ধতায় উপভোগ করে যায় সংবেদনশীল মন। বাঁশির সুরের সোহাগে বনের ফুলের চোখে তন্দ্রা জড়িয়ে আসার শব্দছবি শুধু কল্পনার ব্যাপরই নয়, তা করতে গভীর-নিবিড় অনুভবক্ষমতারও প্রয়োজন। অথবা বাঁশির সুরে ভোমরের পাখার গতি কমে এসে তাতে ঘমু-ঘুম অলসতামাখা অনুভূতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠা অথবা যূথীফুলের চোখ সুরের আবেশে জড়িয়ে যাওয়া প্রভৃতি দৃশ্যকল্প বাংল কবিতাগানে নজরুলের আমদানি। নজরুল গভীরভাবে এবং নিবিড়ভাবে আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন বলে তাঁর পক্ষে প্রকৃতিতে ঘটা সূক্ষ্ন প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তন লক্ষ করা এবং সেসবকে কবিতার ভাষায় উপস্থাপন করা সম্ভব ছিল। এই গানের প্রতিটি অন্তরা এক একটি অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকল্প যা একত্রে পুরোগানটিকে একটি প্রকৃতি ও প্রাণের মেলায় পরিণত করেছে।
নজরুল দার্শনিক কবি-গীতিকার। সকল বিষয়েই তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর ঈশ্বভাবনা এবং প্রেমভাবনা অতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়’ সূচক গানটিতে। গানটির শেষ স্তবক একটি দারুণ সুন্দর এবং অবশ্যই অভিনব চিত্রকল্প:
আমারি রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া
সে-মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া
আপনারি গলে শোভা পায়॥
এই চমৎকার চিত্রকল্পটিতে স্রষ্টা আর সৃষ্টি একাকার হয়ে উঠেছে দুর্দান্ত নাটকীয়তায়। আবার এটিকে প্রিয়জন আর নিজের একাকার হয়ে যাওয়ার দৃশ্য হিসেবেও গ্রহণ করা যায়। অর্থাৎ চিত্রকল্পটি যে নাটকীয় দৃশ্যান্তরের সৃষ্টি করেছে তা সৃষ্টি করেছে বহুমাত্রিক অর্থব্যঞ্জনা।
একান্ত নিজস্ব অনুভূতি বা প্রাতিস্বিক ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে নজরুল ব্যবহার করেছেন নিজস্ব স্টাইলের অপূর্বসুন্দর চিত্রকল্প। সেসব চিত্রকল্পের সাথে অন্য কবি-গীতিকার ব্যবহৃত চিত্রকল্পের মিল নেই। নির্জনরাতে নিজের মনের মধ্যে আবির্ভূত অনুভব ও আইডিয়াকে গানের বাণীতে রূপ দিতে গিয়ে তিনি চমৎকার চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন। ‘ যাক্ না নিশি গানে গানে জাগরণে / আজকে গানের বান এসেছে আমার মনে।’ সূচক গানটির প্রথম অন্তরা রচিত হয়েছে একটি অভিনব চিত্রকল্প সহযোগে। পাতা, কুঁড়ি, দখিন হাওয়া, প্রভৃতি শব্দানুষঙ্গ ব্যবহার করে প্রকৃতিনিবিড় চিত্রকল্পটি রচিত হয়েছে এবং একজন সৃজনশীল মানুষের বিশেষ মুহূর্তকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে শৈল্পিক সাফল্যে নান্দনিক সুচারুতায়।
মন ছিল মোর পাতায় ছাওয়া
হঠাৎ এলো দখিন হাওয়া
পাতার কোলে কথার কুঁড়ি ফুটলো অধীর হরিষণে॥
মানুষের জীবনে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌবন, প্রেম, সুখ ইত্যাদি হাতছাড়া হয়ে যায় সময়ের ব্যবধানে। আর সময় গেলে যে সাধন হয় না, সেকথা তো বাউলসম্র্রাট লালনশাহ বলেই গেছেন। প্রেমহারা/যৌবনহারা মানুষের বেদনার ছবি আঁকতে গিয়ে নজরুল অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকল্প রচনা করেছেন এবং সেই চিত্রকল্প রচনায় সমস্ত উপকরণ নিয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে। অনাবয়নযোগ্য ফতুর প্রকৃতি সমান্তরাল দৃশ্য হয়েছে উদ্ধারহীন ফতুর মানুষের।
চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল
শুকনো পাতা মলিন ফুলদল
বৃথাই সেথা হায় তব আঁখিজল ছিটাও অবিরল দিবস-যামী॥
মনোদৈহিক আবেগ ও রিরংসানিবিড় বাসনার বহিঃপ্রকাশ রচতে গিয়ে নজরুল অচিন্তিতপূর্ব ও অপূর্বূসন্দর চিত্রকল্প রচনা করেছেন। চিত্রকল্পে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ অব্যর্থ সফলতায় কথা বলে উঠেছে কামনাবাসনার প্রকাশে। শব্দ যে এত আবেগ, এত শিহরণ, এত রিরংসা ধারণ ও প্রকাশ করতে পারে, তা নজরুলের গানের বাণী না পড়লে বা গান না শুনলে জানা হতো না।
তোমার দেবালয়ে কি সুখে কি জানি
দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি
আরতি নৃত্যের ভঙ্গিতে।
সঙ্গীতে সঙ্গীতে॥
পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
গন্ধে রূপে রসে করিছে টলমল॥
রাতে চুরি করে দেখা প্রেমিককে বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল এমন অভিনব চিত্রকল্প রচনা করেছেন যে গানের বাণী পাঠ করে বিস্মিত হতে হয়। লোলুপ বাতাস, চোর-জোছনা, ফুলের সুবাস প্রভৃতির সাথে তুলিত করেছেন চোরা প্রেমিককে। এসবের প্রকৃতির উপকরণ এবং কোনোটিই নিন্দনীয় চরিত্র নয় যদিও বিনা অনুমতিতে নানাবিধ অন্দরমহলে প্রবেশ করা তাদের সহজাত স্বভাব। প্রেমেও কোনো অপরাধ নেই তা সে চোরাপ্রেম হউক, অথবা প্রকাশ্য। আমরা সেই চিত্রকল্পটি পাঠ করতে পারি:
মনে কর, আমি লোলুপ বাতাস
চোর-জোছনা, ফুলের সুবাস
ভয় নাই, আমি চলে যাই ডাকি নিশীথিনী নিঃঝুম॥
মানুষ যৌবনে সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল থাকে। সে জীবন বাদ্যরত বীণার মতো, শ্রাবণের স্রোতেলা নদীর মতো। প্রাণপ্রাচুর্যময় সেই জীবন অকালে হারিয়ে গেলে একধরণের অচলাবস্থা নেমে আসে জীবনে। সেটা কঠিন অসুখে হতে পাওে, প্রেমে বিরহজনিত বেদনায় হতে পারে অথবা মানসিক বৈকল্যজনিত কারণেও হতে পারে। এ জীবন কারও কাম্য নয়। তবু কখনো কারও কারও ভাগ্যে এমনটি ঘটে যায়। নজরুল অকালে প্রাণ-উচ্ছলতা হারানো এমন একজন নারীর ছবি আঁকতে যে অপরূপ সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন যা তাঁর অতিবিখ্যাত ‘তুমি আমার সকাল বেলার সুর’ শীর্ষক গানটিতে বিধৃত হয়েছে।
অরুণ তুমি তরুণ তুমি করুণ তারো চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ-লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্রসভার মৌন বীণা নীরব নূপুর।
এই চিত্রকল্পের ভেতর গোপন উপমা আছে, উৎপ্রেক্ষা আছে এবং সবকিছু মিলিয়ে পূর্বনজিরবিহীন চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে। এখানে প্রকৃতি থেকে কোনো উপমা বা উপকরণ নেয়া হয়নি। শারীরিক-মানসিক অবস্থাজ্ঞাপক কতগুলো নির্বাচিত বিশেষণ এবং পৌরাণিক অনুষঙ্গ চিত্রকল্পটির শরীরপ্রাণ নির্মাণ করেছে। চিত্রকল্পটিতে একদিকে নারীর দৈহিক সৌন্দর্যের বিচিত্র দিক, অন্যদিকে মানসিক বিষাদ উপস্থাপিত হয়েছে শৈল্পিক সুচারুতায় যা অন্য কোথাও দৃষ্টিগোচর হয় না। চিত্রকল্পে সৃষ্ট অর্থব্যঞ্জনা সুদূর প্রসারিত এবং উদ্ভাসিত সৌন্দর্য করুণ-সুন্দর যা শিল্পীর কণ্ঠ সুরে সুরে ফুটিয়ে তোলে জীবন্ত ব্যঞ্জনায়।
নারীর পথ চাওয়া, মনের বেদনা, আকুলতা, মিলনাকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি ফুটে উঠেছে নজরুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে’ শীর্ষক গানটিতে। এ গানে একাধিক চমৎকার সুন্দর চিত্রকল্প নির্মিত হয়েছে। কোনোটিতে প্রকৃতির, কোনোটাতে মানসিক অবস্থা প্রতিরূপ প্রাধান্য পেয়েছে।
বিহগী ঘুমায় বিহগ-কোলে
ঘুমায়েছে ফুলমালা শ্রান্ত আঁচলে;
ঢুলিছে রাতের তারা চাঁদের পাশে।
রাতের এই ছবি মনোহর ও নিবিড়। তিনটি খন্ড দৃশ্য রয়েছে এখানে। তিনটিতেই ভালোবাসার আবেগ ও নৈকট্যের নিবিড়তা প্রকাশিত। প্রোষিতাভর্তৃকা নারীর মন বলছে যে জগতে সবখানেই জীব ও জড় সবাই প্রিয়জনের পাশাপাশি অবস্থান করছে। ভালোবাসায় ভরে রয়েছে তাদের ভালোবাসার উঠোন। আর বিপরীত অবস্থা সেই নারীর। তার উঠোন শূন্য। কাছে নেই প্রিয়জন। প্রকৃতি থেকে একাধিক মিলনদৃশ্য নিয়ে নারীর মনোবাসনার তীব্রতা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। প্রকৃতি শুধু প্রকৃতি থাকেনি। তা চলমান জীবনের সপ্রাণ ছবি হয়ে উঠেছে।
গানে পরের চিত্রকল্পটি আরও বেশি অনুভব-নিবিড়, আরও বেশি সংবেদশীলতায় ভরপুর। প্রকৃতিতে দৃশ্যমান মিলনদৃশ্যেও বিপরীতে প্রণয়ী নারীর প্রিয়শূন্য উঠোন; দিন যদিবা কাটে কোনোভাবে কাজের মাঝে ব্যস্ত থেকে, রাত কাটে না; সারারাত যায় নিদ্রাহীন চোখের পাতা ছুঁয়ে। অর্থাৎ প্রিয়হীন রাত না আনে ঘুমের বিশ্রাম না আনে মিলনের সুখ। ফলে অস্থিরতা, অশান্তি আর উৎকণ্ঠিত পথ চাওয়া।
ফুরায় দিনের কাজ, ফুরায় না রাতি,
শিয়রের দীপ হায় অভিমানে নিভে যায়
নিভিতে চাহে না নয়নের বাতি।
বিরহের বর্ণনা দিতে গিয়ে নজরুল কতভাবে যে কত ছবি এঁকেছেন, কত অভিনব চিত্রকল্প রচেছেন, তা লিখে শেষ করা যায় না। কখনো প্রকৃতির মাঝে পারসোনিফিকেশন আরোপ, কখনোবা প্রকৃতির সাথে তুলনা সৃষ্টি, কখনোবা উৎপ্রেক্ষা রচনা। প্রিয়জন বিদেশে আর গৃহবাসী নারী । সেই নারীর মনের অস্থির অবস্থা তুলে ধরতে নজরুল রচনা করেছেন উপমা-অলঙ্কার যোগে দারুণ সুন্দর চিত্রকল্প:
আমার বিদেশীরে খুঁজিতে অনুক্ষণ
বুনোহাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মন।
অথৈ জলে মা গো মাটঘাট থৈ থৈ
আমার মনের আগুন নিভিল কই?
লাইলী-মজনুর কালজয়ী অমর প্রেমের ছবি আঁকতে গিয়ে নজরুল স্বর্গ-মর্ত্য দুই ভুবন থেকে ছবি নিয়ে চিত্রকল্প এঁকেছেন । প্রথমত লাইলীর মজনুর জন্য লাইলীর মনে সৃষ্ট গভীর প্রেমবাসনার ছবি এঁকেছেন পার্থিব উপকরণ সহযোগে তুলনীয় পরিবেশ সৃৃষ্টি করে। মিলনের অনুকূল পরিবেশ চিত্র লাইরীর মনের প্রেমাকাক্সক্ষাকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে এবং একইসাথে তার যৌক্তিতকতা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আজি দখিনা বাতাস বহে অনুকূল
ফুটেছে গোলাপ নার্গিস ফুল
ওগো বুলবুল, ফুটন্ত সেইগুলবাগিচায় দোলো॥
পরের স্তবকে লাইলীর প্রেমের স্বর্গ-মর্ত্য বিস্তারী মহিমা এবং লাইলীর বিরহের গভীরতা উপস্থাপন করা হয়েছে একটি অতুলনীয় সুন্দর চিত্রকল্প সহযোগে। তার বিরহে কেঁদেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নিরীহ প্রাণী হরিণী , সমব্যথী হয়ে পথ দেখিয়েছে খুঁজে পেতে মজনুকে আর চাঁদের প্রদীপ হাতে নিয়ে হুর-পরীরা পথ দেখিয়েছে রাতের বেলায়। এ চিত্রকল্পের কোনো তুলনা নেই।
বনের হরিণ হরিণী কাঁদিয়া পথ দেখায়েছে মোরে
হুর ও পরীরা ঝুরিয়া ঝুরিয়া চাঁদের প্রদীপ ধরে।
প্রেমের বিরহকে , বিচ্ছেদের বেদনাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে এবং অস্তিত্বের ওপর বিরহের প্রভাব তুলে ধরতে নজরুল ব্যবহার করেছেন অপূর্বসুন্দর চিত্রকল্প:
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরিয়া যায়।
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী-জল করুণ বিষাদ ডাকে: ‘আয় ফিরে আয়’॥
বিরহ-বিচ্ছেদ পীড়িত মনে সৃষ্ট প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার বাসনার তীব্রতা বোঝাতে অনুরূপভাবে ব্যবহার করেছেন একেবারে অভিনব ও তুলনাহীনভাবে সুন্দর চিত্রকল্প। চিত্রকল্প ধারণ করেছে বিরহীমনের আকুলতা-ব্যাকুলতা এবং প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার দড়িছেঁড়া টানের প্রবলতা, তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতা।
গগনে মেলিয়া শত শত কর
খোঁজে তোরে তরু, ওরে সুন্দর!
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড় লুটায় লতা ধূলায়!
প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম নর-নারীর প্রেমকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন । প্রেমের এমন কোনো ক্ষেত্র বা দিক নেই যেখানে তাঁর সংবেদনশীল সন্ধানী দৃষ্টি পড়েনি। একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে নজরুল নর-নারীর সম্পর্ককে হৃদয়সর্বস্ব শুচবায়ুগ্রস্ততা থেকে মুক্ত করে তার শারীরিক কামনা-বাসনার বিষয়টিকে স্বাভাবিক মহিমায় উপস্থাপন করেন। একারণে নজরুলের কবিতাগান সকল শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে ছাড়িয়ে মানুষের স্বভাবিক জন্মগত মনোদৈহিক চাহিদার নান্দনিক শিল্পকর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে। আবার তিনি নর-নারীর শারীরিক কামনাবাসনার বিষয়টিও সকল স্থূলতার উর্ধ্বে নান্দনিক সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখে উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সহয়তা দিয়েছে অভিনব উপমা ও অপূর্বসুন্দর চিত্রকল্প। উদাহরণ দিতে গেলে অজস্র চিত্রকল্প এনে দেখানো যায়। নজরুলের সুবিখ্যাত ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা’ গানটির প্রতিটি অনুচ্ছেদ এক একটি শিল্পসুন্দর চিত্রকল্প। ঐ গানের ‘পাখায় পাখায় বাঁধা যবে রয় / বিহগ-মিথুন কথা নাহি কয়/ মধুকর যবে পুলে মধু খায় / রহে না চঞ্চলতা স্রোতে।’ এই চিত্রকল্পটি নর-নারীর মনোদৈহিক কামনা-বাসনাকে অত্যন্ত শিল্পসফলতায় ফুটিয়ে তুলেছে যার মধ্যে একাকার হয়ে উঠেছে শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং শারীরিক মিলন। এখানে হৃদয়সর্বস্ব রোমান্টিক শুচবায়ুগ্রস্ততা এবং দেহসর্বস্ব অশৈল্পিক স্থূলতা দুটোকেই পরিহার করা হয়েছে সুদক্ষ হাতে। আর একাজে সবচেয়ে সহায়ক হয়েছে শিল্পসুন্দর অভিনব চিত্রকল্প।
চলবে…