পর্ব-৪॥ ব্রাত্য বসুর নাটক: ইলা গূঢ়ৈষা
ব্রাত্য বসুর সবচেয়ে বিস্ময়কর নাটক ‘ইলা গূঢ়ৈষা’। এ নাটকের চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে দর্শক এতটাই হোঁচট খায়, যা সামলে উঠতে কয়েকদিন পর্যন্ত লাগে। নাটকটির প্রধান চরিত্র কোচবিহার রাজ্যের রাজা বীর নারায়ণ। তিনি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক। অত্যন্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ এই রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন গুণী শিল্পী গৌতম হালদার। নাটকটির শুরু থেকেই দ্বন্দ্বের বিকাশ চোখে পড়ে, রাজার সাথে পণ্ডিত নারায়ণ ত্রৈলোক্যদর্শীর।
রাজা বীর নারায়ণ পণ্ডিত ত্রৈলোক্যদর্শীর তরুণী কন্যা ব্রততীকে ভালো বাসেন, বিয়ে করতে চান এজন্য তিনি অপহরণ কিরে নিয়ে আসেন। ব্রবততীকে নিয়ে রাজার পাঁচজন কুমারীকে অপহরণ করার ঘটনা ঘটেছে। পণ্ডিত ত্রৈলোক্যদর্শী দুশ্চরিত্র রাজার কাছে কন্যা বিয়ে দিতে রাজি নন। তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য প্রদ্যোতের সাথে কন্যার বিয়ে দিতে চান। প্রদ্যোতও ব্রততীকে হৃদয় দিয়েই ভালোবাসে। কিন্তু পণ্ডিতের মেয়ে রাজার সাথেই বিয়েতে রাজি। ব্রততীকে বোঝানো হয়, রাজা বহুবল্লভা, ব্রততী তাতেই রাজি, সে কনিষ্ঠ হয়ে থাকতে চায়। তাকে বোঝানো হয় রাজার সাথে তার বয়সের ব্যবধান অনেক। যতই তাকে বোঝানো হোক, সে কোনো বুঝই বুঝতে রাজি না। সে রাজার ছোট রানী হয়ে থাকতে চায়, সতীনের সঙ্গে থাকতে তার অনিচ্ছা নাই। কিন্তু অপহৃত ব্রততী রাজার সঙ্গে বিয়ের আগেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে।
রানি পদ্মাবতী সে সংবাদ নিয়ে যান রাজার কাছে। ইন্দ্রিয়পরায়ণ রাজা ব্রততীর আত্মহননের ঘটনায় সাময়িকভাবে কিছুটা হোঁচট খেলেও স্বভাব যায় না মরলেও। তিনি রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্র। নিজেকে মনে করেন পিতার চেয়ে অধিক যোগ্য রাজা। তার মতে, তার পিতা শুধু বীর ছিলেন, কিন্তু তিনি বীরত্ব ছাড়াও সাহিত্যরসিক, সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পরসজ্ঞ এবং সবদিক দিয়ে উন্নত। এমনকি নারীলোলুপতায়ও তিনি পিতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তার পিতাও এমন ছিলেন। পিতার সাথে তাকে তুলনা করলে তিনি একজন মন্ত্রীকে চাবুক মারেন, প্রধানমন্ত্রীকে ভর্ৎসনা করেন।
রানী পদ্মাবতীর ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, তার অভিনয়কুশলতা অসাধারণ, তা স্বীকার করতেই হবে। গৌতম হালদারের অভিনয়ে ওভার অ্যাকটিংয়ের অভিযোগ অনেকইে করে থাকেন, এ নাটকে সে অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করা যায় না।
রাজার প্রথম রানী পদ্মাবতীর কন্যা ইলা রাজার চোখের আড়ালে বড় হতে থাকে। রানী কৌশলে রাজকন্যা ইলাকে দূরে অবস্থিত এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। রাজকন্যা ইলা সেখানেই বড় হয়। যেদিন ইলা ষোড়শী হয় সেদিন রানী তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন। মায়ের মনে আশা ছিল, মেয়ে ষোড়শী হলে সাতদিনের জন্য তাকে রাজপ্রাসাদে নেওয়া হবে। কন্যা রাজপ্রসাদ দেখে যেমন মুগ্ধ হয়ে যাবে, রাজাও কন্যাকে দেখে চমকে যাবেন। সত্যিই একদিন ইলা রাজপ্রাসাদে যায়, পিতার সাথে পরিচয়ের আগে সে প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। এসময় রাজা এই ষোড়শীকে দেখে মুগ্ধ হন। তিনি ভেবেছেন প্রধানমন্ত্রী এই মেয়েটিকে রাজার রাজভোগের জন্য নিয়ে এসেছেন। রাজা অচেনা মেয়েটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে যান চোখের আড়ালে। নিজ ঔরসজাত কন্যাকে রাজা ধর্ষণ করেন।
রক্তাক্ত রাজকন্যা ইলা মারাত্মক আহত অবস্থায় ফিরে এলে রানী ঘটনা জানতে পেরে রাজার কাছে তাদের সন্তানের পরিচয় ব্যক্ত করেন। এখানে এলে দর্শক যেন সুউচ্চ পর্বত থেকে নিচে নিক্ষিপ্ত হন, এমন একটি ভূমিধস ঝাঁকুনি অনুভব করবেন। রাজা সব জানতে পেরে স্বীয় পাপের প্রবল অনুশোচনায় প্রাসাদের ছাদ থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। রাজকন্যা ইলা তার আগেই সে পথে গিয়েছে। এই হলো ‘ইলা গূঢ়ৈষা’ নাটকের ঘটনাবস্তু।
এ নাটকে গৌতম হালদারের অভিনয় সবখানি জুড়ে রয়েছে। রাজা বীর নারায়ণের চরিত্রের লাম্পট্য ও শিল্প রসগ্রাহীতা একাকার করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর সুদক্ষ অভিনয়ে দর্শককে টানটান উত্তেজনায় আটকে থাকে। কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য ও রসনাবিলাসে নিমজ্জিত থাকেন রাজা। সর্বদাই তাঁর মুখে বিভিন্ন গানের কলি গীত হতে থাকে। নৃত্যের লীলায়িত ভঙ্গিতে তার চলাফেরা। দরবারি কবিকে ডেকে কাব্যসুধা পান করেন। বীভৎস্য রসের শ্রবণে তিনি খাদ্যগ্রহণ অসমাপ্ত রেখেই হাত ধুয়ে ওঠেন। এসব গুণের সাথে চরমভাবে মিলে গেছে গৌতম হালদারের চমৎকার অভিনয়।
নাটকটিতে মঞ্চে আসবাব এবং উপকরণের আতিশয্য নাই। অল্প উপকরণে, অধিক আয়াসে ফুটে উঠেছে এ নাটক। তবে তান্ত্রিকদের মঞ্চে রাখা অনাবশ্যক অধিকক্ষণ বলে মনে হয়। রানী পদ্মাবতীর ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, তার অভিনয়কুশলতা অসাধারণ, তা স্বীকার করতেই হবে। গৌতম হালদারের অভিনয়ে ওভার অ্যাকটিংয়ের অভিযোগ অনেকইে করে থাকেন, এ নাটকে সে অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। রাজাকে আরেকটু স্থির হলে ভালো মানাতো। অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় ভালো হয়েছে।
চলবে…
দূরের দর্শক-৩॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ