পর্ব-৩॥ ব্রাত্য বসুর নাটক: অনুশোচনা
ব্রাত্য বসুর ‘অনুশোচনা’ নাটকটিও একটি বড় ধরনের কাজ। এটি ঐতিহাসিক নাটক বলা যায়, আবার পৌরাণিকও বলতে পারি। তবে ভারতীয় পুরাণের গ্রন্থগুলোতে বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গগুলোর অনুপস্থিতি —বিশেষ করে পৌরাণিক অভিধানে—এটিকে পৌরাণিকতার বহিঃস্থ বলে ধারণা দেয় এবং ঐতিহাসিকতার দিকে ঠেলে দেয়। আর হিন্দুধর্মীয় অনুষঙ্গগুলো সন-তারিখ দ্বারা চিহ্নিত নয়, কিন্তু বৌদ্ধধর্মীয় অনুষঙ্গগুলো চিহ্নিত বলে এগুলোকে ঐতিহাসিক বলাই ভালো। তাছড়া এ নাটকে ধর্মীয় প্রসঙ্গ এবং অনুষঙ্গের সাথে সমকালীন রাজনীতিও জড়িত। রাজা বিম্বিসার, রানী ক্ষেমা এবং তাঁদের পুত্র অজাতশত্রুর নানা ঘটনা জড়িয়ে আছে। মহামতি বুদ্ধের ঘনিষ্ঠ এগারো জন শিষ্যের মধ্যে অন্যতম প্রিয় শিষ্য দেবদত্তের বিদ্রোহ ও শত্রুতামূলক আচরণের ঘটনাগুলো নাট্যরূপ পেয়েছে এ নাটকে। শুধু নাট্যরূপ নয়, বাস্তবিক রূপ লাভ করেছে বলা যায়।
দেবদত্ত সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ৪৯৭— ৫০৪ পৃষ্ঠায় শ্রী সুজিতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রবন্ধ ‘বুদ্ধের বিদ্রোহী শিষ্য দেবদত্ত’ রচনাটি পড়ার মধ্য দিয়ে। সেখানে লেখকের পক্ষপাত দেখেছি দেবদত্তের প্রতি। হয়তো তিনি বুদ্ধের প্রতি অনীহ ছিলেন অথবা ছিলেন দেবদত্তের প্রতি অনুরাগী। তিনি রচনাটিতে দেবদত্তকে নিরপরাধ প্রমাণে তৎপর ছিলেন। সেদিক দিয়ে নাট্যকার ব্রাত্য বসু ঠিক বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বর্ণনামূলকভাবে দেবদত্তের একের পর এক অপরাধ তুলে ধরেছেন।
দেবদত্ত বুদ্ধের শুধু বিদ্রোহী শিষ্য ছিলেন, তাই না, তিনি শক্তিশালী শত্রুও ছিলেন। তিনি বুদ্ধকে হত্যা করে নেতৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন কয়েকবার। এ নাটকে এ সকল অপচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরে বুদ্ধের কাছে অনুশোচনা করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে দেখা যায়। এ ঘটনাটি সমপর্যায়ের আরো দুটি ধর্মীয়-ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। যিশু খ্রিস্টের বারোজন ঘনিষ্ঠ শিষ্যের মধ্যে একজন ছিলেন যিহুদা ইস্কারিয়োত, যিনি অতি সামান্য কিছু অর্থের লোভে খ্রিস্টকে ধরিয়ে শত্রুদের হাতে তুলে দেন। যার পরিণতিতে খ্রিস্টকে ক্রুশে হত্যা করা হয়। বুদ্ধের ঘটনার পাঁচ শতাব্দীকাল পরে ঘটে খ্রিস্টের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির ঐ বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা। তারও পাঁচ শতাব্দী পরে ঘটে আরেকটি ঘটনা। আরবের নবি হজরত মুহাম্মদকে খায়বরের এক অভিজাত নারী জয়নাব বিনতে হারিস নিমন্ত্রণ করে খাবারে বিষ মিশিয়ে খেতে দেন। মুহাম্মদের ঘনিষ্ঠ এক সাহাবি সেই বিষাক্ত মাংস খেয়ে নিহত হন। মুহাম্মদ মাংস মুখে দিয়েই সন্দিগ্ধ হয়ে বলেন, ‘এ খাবারে বিষ আছে’, সতর্কতার কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
এবারও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। এরপরে পিতৃহত্যাকারী তরুণ রাজা অজাতশত্রুর নালাগিরি নামক মত্তহস্তীকে বুদ্ধের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়; এবার মত্তহস্তী নালাগিরিও বুদ্ধের নিকট সমর্পিত হয়। একের পর এক হত্যাপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় দেবদত্তের।
এ তিনটি ঘটনা বিশ্বের মর্যাদাবান তিনজন মহাপুরুষের ছদ্মবেশী শত্রুর হত্যাপ্রচেষ্টা। তিনজনের মধ্যে কালগত দিক থেকে প্রথম এবং শেষোক্ত জন ব্যর্থ হন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে মাঝখানের জন সফল হন। তারই প্রতীক আজ খ্রিস্টান বিশ্বের ক্রুশ। এই তিনজনের শত্রুর মধ্যে কেউ ক্ষমা পান নাই। প্রথমোক্ত ঘটনাদুটির অভিযুক্তের আত্মহত্যা এবং শেষের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি বলেই প্রমাণিত। ব্রাত্য বসুর ‘অনুশোচনা’ নাটকটি দেখার পরে অন্য দুটি ঘটনাও মনে পড়ে যায়। জানা থাকলে চোখের সামনে কাল্পনিক নাট্যমঞ্চে ঘটনাগুলো ঘটে যেতে থাকে। উঁচুমানের শিল্পের একটা বড় গুণ হলো, তা রসগ্রাহী ব্যক্তির মনের মধ্যে সমান্তরাল নতুন শিল্প সৃষ্টি করে যায়। এই যে, ব্রাত্য বসু তাঁর নাটকের মাধ্যমে আরো ঘটনাকে কল্পমঞ্চে নাট্যরূপ দিতে সমর্থ হন, এখানেই তাঁর নাটকের সাফল্য। নাট্যসাহিত্যের যে কত শক্তি তা এ নাটকের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়। হয়তো এই তিনজনের বাইরে অন্য কোনো মহাপুরুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাও জানা-দর্শকের কাছে নাট্যরূপ লাভ করে। আমাদের মনে পড়ে যায় মোহাম্মদি বেগের কথা, নবাব সিরাজের পরিবারে খেয়ে-পরে বড় হয়ে সামান্য কিছু পুরস্কারের লোভে মিরনের নির্দেশে নিজহাতে সিরাজকে হত্যা করেন। নেত্র সেনের কথা মনে পড়ে, পুলিশের কাছ থেকে পুরস্কারের লোভে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়েও সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেন। দর্শকদের এমন অনেক ঘটনাই মনে গতে পারে। নাটকের সংক্রমণ ক্ষমতা এমনই!
ব্রাত্য বসুর এ নাটকের মঞ্চে পাহাড়-পর্বত সাজিয়ে কুশী নগরীর ভৌগোলিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ভিক্ষুদের চীবরের রঙ দিয়ে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। প্রথমে কিছুক্ষণ পাহাড়-পর্বত, গিরিপথ-গিরিখাতের ভেতর দিয়ে ভিক্ষুদের চলাচলের দৃশ্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে দর্শকদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। দর্শক এভাবে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে অবস্থান নেয় বুদ্ধের সময়ে এবং তাঁর অবস্থিত শহরে ও সংঘে। এরপর ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে যেতে থাকে। দর্শক নিজেকে সেখানেই আবিষ্কার করে।
‘অনুশোচনা’ নাটকের প্রধান চরিত্র দেবদত্ত। তার চরিত্রে দুইজন অভিনেতা অভিনয় করেছেন। তরুণ দেবদত্তের চরিত্রে রাজর্ষি মুখোপাধ্যায় এবং প্রবীণ দেবদত্তের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। তুলনামূলক বিচারে দুজনের মধ্যে কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ভালো হয়েছে। দেবদত্ত চরিত্রটির অভিনয় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মঞ্চজুড়ে অবস্থান নিয়েছে। চরিত্রটি দর্শকদের টানটান পরিস্থিতিতে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। কিছু ঘটনা দৃশ্যায়নের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে সংলাপের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, বুদ্ধকে বিষপ্রয়োগ, মত্তহাতি লেলিয়ে দেওয়া, অজাতশত্রুকে তাঁর পিতা রাজা বিম্বিসারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে পুত্রকে দিয়ে পিতাকে হত্যা করানো। পিতৃহত্যাকারী তরুণ রাজা অজাতশত্রুকে বুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলার দৃশ্যে অজাতশত্রু চরিত্রে কেশব ভট্টাচার্যের অভিনয়ও ভালো হয়েছে।
দেবদত্ত ছিলেন বুদ্ধের এগারো জন ঘনিষ্ঠ শিষ্যের অন্যতম। তিনি আনন্দ, ভগু, শাক্যরাজ ভদ্দিয়, তার বন্ধু অনুরুদ্ধ, কিম্বিল, উপালি প্রমুখ একসাথে বুদ্ধের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করে সংঘে প্রবেশ করেছিলেন। শ্রম ও নিষ্ঠার কারণে তিনি বুদ্ধের নিকট অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধের মাতৃপক্ষীয় আত্মীয়। তিনি বুদ্ধের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন। প্রথমে তিনি সংঘের ভিক্ষুদের মধ্যে নতুন পাঁচটি মতবাদ প্রচার করে বুদ্ধের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হন। তার কথায় মুগ্ধ হয়ে অনেকেই সংঘ ত্যাগ করে দেবদত্ত প্রতিষ্ঠিত নতুন সংঘে যোগদান করেন। কিন্তু বুদ্ধের প্রবীণ দুই শিষ্য সারিপুত্র এবং মৌদগল্যায়ন দেবদত্তের সংঘে গিয়ে বিপথগামী ভিক্ষুদের বোঝাতে সক্ষম হন বলে তাঁরা ফিরে আসেন।
এরপর দেবদত্ত কোকালিক নামে একজন কুচক্রীকে আনয়ন করেন, এবং তার মাধ্যমে চম্পানগর থেকে একজন অব্যর্থ ধনুর্বিদকে নিযুক্ত করান বুদ্ধকে বিষাক্ত শরে বিদ্ধ করে হত্যা করার জন্য। সে ঘটনায় ধনুর্বিদ বুদ্ধের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। এরপর গৃধ্রকূট পর্বত থেকে বিশাল প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করে বুদ্ধকে হত্যাপ্রচেষ্টা চালান দেবদত্ত। এবারও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। এরপরে পিতৃহত্যাকারী তরুণ রাজা অজাতশত্রুর নালাগিরি নামক মত্তহস্তীকে বুদ্ধের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়; এবার মত্তহস্তী নালাগিরিও বুদ্ধের নিকট সমর্পিত হয়। একের পর এক হত্যাপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় দেবদত্তের।
তার উল্লেখযোগ্য সংলাপের মধ্যে একটি সংলাপ, ‘প্রতারণাই ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে’—তাকে দর্শকের কৃপাবঞ্চিত করে তোলে। দর্শক যে ধর্মের হোন, যে সম্প্রদায়ের হোন, তিনি বুদ্ধকে শ্রদ্ধা করেন অথবা না করেন, দেবদত্তকে ক্ষমা করতে পারেন না। কারণ, তিনি ক্ষমালাভের অযোগ্য।
কুশী নগরীতে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের রাতে দেবদত্ত বুদ্ধের কাছে গিয়ে অনুশোচনা প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়ার অধিকার চান, কিন্তু বুদ্ধের বিশ্বস্ত দুই শিষ্য সারিপুত্র এবং মৌদগল্যায়ন তাকে বুদ্ধের নিকটে যাওয়ার অধিকার দেন না। দেবদত্ত কি জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে প্রবল অনুশোচনা প্রকাশ করে ক্ষমা পেতে পারেন না? একবার বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেতে পারেন না? তিনি বারবার অনুতপ্ত হয়ে এ প্রশ্ন রাখেন। কিন্তু বুদ্ধের নিকটবর্তী শিষ্যগণ তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ দেবদত্ত শেষ সময়েও কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারেন।
নাটকের শেষপ্রান্তে দেবদত্তের মৃত্যু ঘটে, বুদ্ধের সেই মহাপরিনির্বাণের রাতে। কিন্তু তাঁর হাতে একটা ছুরি দেখা যায়। সেই লুকানো ছুরির প্রকাশ পাওয়াতে বাইবেলের খ্রিষ্টের বিশ্বাসঘাতক যিহুদা ইস্কারিয়োতের আত্মহত্যার ঘটনা মনে পড়ে যায়। মাত্র তিরিশটি রৌপ্যমুদ্রার লোভে যিহুদা ধরিয়ে দিয়েছিলেন খ্রিষ্টকে। ক্রিস্টের বিচার শেষ হওয়ার আগেই যিহুদা সেই তিরিশ টাকা ফেরত দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই নাটকে কি ক্ষমালাভে ব্যর্থ হয়ে দেবদত্ত সেই একই পরিণতি লাভ করলেন?
এখানে উল্লেখ্য, নাট্যকার এ নাটকে দেবদত্তের সেই নতুন পাঁচটি বাণীর সঙ্গে ব্যক্তি দেবদত্তের অসততা, চাতুর্য এবং কপটতার দিকটি খুলে ধরেছেন। দেবদত্ত এখানে হত্যাপ্রচেষ্টাকারী, রাজানুগ্রহলাভকারী বিলাসী, মহামূল্যবান মসলিনের চীবর পরিধানকারী, ইন্দ্রিয়জ কামনা-বাসনাপূর্ণ, বিশ্বাসঘাতক এবং উৎপলবর্ণার সম্ভ্রমহানিকারীরূপে চিহ্নিত হয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য সংলাপের মধ্যে একটি সংলাপ, ‘প্রতারণাই ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে’—তাকে দর্শকের কৃপাবঞ্চিত করে তোলে। দর্শক যে ধর্মের হোন, যে সম্প্রদায়ের হোন, তিনি বুদ্ধকে শ্রদ্ধা করেন অথবা না করেন, দেবদত্তকে ক্ষমা করতে পারেন না। কারণ, তিনি ক্ষমালাভের অযোগ্য।
এ নাটকের ভাষা নিয়ে একটি কথা আছে, খ্রিষ্টপূর্বকালের এ নাটকের ভাষায় পালি ও প্রাকৃত ভাষার একটা আবহ থাকলে ভালো হতো, বিশ্বস্ত মনে হতো। সেখানে আধুনিক যুগের ব্যবহারিক শব্দ বেমানান। একটি সংলাপে ‘বাদামি পোশাক’ কথাটি প্রযুক্ত হয়েছে। দুটি শব্দই ফারসি ভাষা থেকে বাংলায় আগত। এ নাটকে শব্দ দুটি খাপ খায় না; কানে শ্রুতিকটু লাগে।
নাটকটির নির্দেশক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অনেক নাটকই দর্শকের স্মৃতি থেকে, মন থেকে মুছে যায়, কিন্তু এ নাটকটি অনেকদিন স্মৃতিতে থাকবে বলে মনে হয়।
চলবে…