(পর্ব-৬)
দার্জিলিংয়ে অবশ্য একটা বিষয় খুব উপভোগ করছিলাম। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্গা, অন্নপূর্না এসবের চূড়ায় যারা উঠতে চান, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মনে রাখা দরকার, ওইসব উঁচু ও বরফঢাকা বৈরী পর্বতে উঠতে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। নাম শুনেছিলাম আগেই। জানতাম না সেটা এই পার্ক বা চিড়িয়াখানার ভেতরে।
পার্কের দক্ষিনে নিরিবিলি এক প্রান্তে এই ইনস্টিটিউট। সামনে একজন পর্বতারোহীর ভাস্কর্য। যেটির উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। এর পেছনেই পর্বতারোহনের আধুনিক পদ্ধতির একটি বিশাল দেয়ালচিত্র। মূল ক্যাম্পাসে প্রবেশের পরই খোলা চত্বরে সবার নজর কাড়ে রশি দিয়ে পর্বতে ওঠার আরেকটি দেয়ালচিত্র। সবগুলোর সামনেই ছবি তুললাম। বিশেষ করে রশি বেয়ে ওঠার দেয়ালচিত্রে এমনভাবে দাঁড়ালাম, যা দেখে মনে হচ্ছিল আমিই রশি বেয়ে ওপরে উঠছিলাম। প্রিন্সিপালের কক্ষ, অফিস কক্ষ সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
অন্যরা চলে গেলো উত্তরে। দক্ষিণে ছুটলাম একা। কারণ দক্ষিণের শেষ কোনো একটা অসাধারণ ছবি ছিল। দূর থেকে দেখা লাইন ধরে পর্বতারোহনের ছবি। কিছুটা দূরে ক্যামেরা হাতে মামুনকে দেখলাম। আসতে বললাম। চলে গেলাম পেছনের শেষ অংশে। ক্লাস রুম, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম সামনের দিকটায়। পেছনের অংশে ছেলে ও মেয়েদের হোস্টেল। এখানকার পরিবেশ একেবারেই শান্ত। পর্বতের মতোই নিরিবিলি, নিস্তব্ধ।
ছেলেদের হোস্টেলের দেয়ালে একটি চিত্র নজর কাড়লো। মোবাইলে ছবি নিলাম। পরে যখন মামুন এলেন, বললাম, ভালো করে ছবিটা নিতে। যেখানে নয়জন পর্বতারোহী সার বেঁধে হেঁটে চলছিলেন। ছবিটার মধ্যে অন্যরকম রিদম, প্যাসন আর মোটিভ খুঁজে পেলাম। মানুষের জীবনের সঙ্গেও এর অনেক মিল। জীবন মানেই সংগ্রাম। জীবন মানেই লড়াই। জীবন মানেই অনবরত চলা-জীবনের কথা বলা।
এরপর গেলাম মিউজিয়ামে। দোতলা মিউজিয়ামের বিশাল খোলা চত্বরে রয়েছে বেশকিছু ভাস্কর্য। এরমধ্যে আছেন প্রথম এভারেস্টজয়ী স্যার অ্যাডমন্ড হিলারি ও শেরপা তেনজিং নরগে। সময় কম। সবাই চলে গিয়েছিল। রয়ে গেলাম একা। তাই বলে কি মিউজিয়াম হবে না দেখা? দৌড়ে চলে গেলাম দোতলা মিউজিয়ামের নিচ তলায়। সেখানে পর্বতারোহনের নানা রকমের পোশাক ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী। প্রদর্শন করা হয়েছে পর্বতে ওঠার, সারভাইব করার কলাকৌশল। উঠে গেলাম দোতলায়। সেখানে স্কাল্পচারের মাধ্যমে হিমালয় পর্বত শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য সব চূড়া দেখানো হয়েছে। মনে পড়লো আমিও একবার এভারেস্ট দেখেছিলাম। কাঠমান্ডু থেকে ছোট বিমানে করে। এভারেস্ট দেখার পর ওরা একটা সার্টিফিকেট দিয়েছিল। একশ ডলার দিয়ে একটা বই কিনেছিলাম বিমানের ভেতর থেকেই। সেখানে এই চূড়াগুলো নাম এবং উচ্চতা দেখানো হয়েছিল। সব উচুঁ চূড়া প্রায় একই লাইনে। পশ্চিম থেকে পুবে বিস্তৃত। এই স্কাল্পচার দেখে হিমালয়ের বিশালত্ব বোঝা যায়। দেখানো হয়েছে এভারেস্টের বিভিন্ন দিক। ডেমোনেস্ট্রেশন রয়েছে সামিট বিষয়ে।
মাউন্টেনেয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকের কাছে অন্যরা বসে ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। সবাই মিলে চললাম মূল গেটের দিকে। সামনের উত্তর দিকটাতেই ছিল পাখি আর বানরের খাঁচা। সেদিকে চলে গেলাম সবাই। ওখানকার ঢালু রাস্তায় গ্রুপ সেলফি নেওয়া হলো।
গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবো, এমন সময় দেখলাম তিনটি মেয়ে অদ্ভূত সুন্দর পোশাকে ছবি তুলছে। একজন ত্রিশোর্ধ্ব। বাকি দুজন টিনএজার। চিড়িয়াখানার ভেতর থেকে তারা ওই পোশাক ভাড়া করেছিলেন। ছবি তোলার জন্য। চায়ের ‘পাতা তুলনী’র সাজ। রঙিন পোশাক। সঙ্গে পাতা রাখার ঝুড়ি। এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলতে চাইলাম। রাজি হলেন।
এরমধ্যে মিল্টন এসে বললেন, এদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যান। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি। ফিরোজ আলমের দিকে তাকালাম। হাসে, বয়সী মহিলা সরে গেলেন পাশে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মিল্টনের ক্যামেরায় ক্লিক, ক্লিক। মিল্টন বললেন, পাশে না, আপনি মাঝখানে দাঁড়ান। টিনএজার দুজন মডেলদের মতো পোঁজ নিয়ে আমার দুপাশে। শাকিল তখন ভেঙানোর মতো করে কাশে, আমার দিকে তাকিয়ে গ্রুপের অন্যরা তখন হাসে।
জুলজিক্যাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আবার উঠলাম জিপে। খানিকটা সামনে গিয়েই গাড়ি থামে। পার্থ বললেন, এটাও আইটেনারির একটি স্পট। নাম তেনজিং রক। রাস্তার পাশে বড় আকারের একটি পাথর। এভারেস্টজয়ী প্রথম শেরপার নামানুসারে পাথরটির নাম, তেনজিং রক; সব ঠক।
আরেকটু সামনে টি-গার্ডেন ভিউতে চলে গেলাম। এখানে পর্যটকদের প্রচুর গাড়ি। পার্কি পাওয়াই মুশকিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা। রাস্তার ঢালুতেই মাথাছাঁটা চায়ের গাছ। পূর্ব দিকে কোনো বাড়ি ঘর নেই। অনেকটা দূরে পাহাড়। চা বাগানের দীর্ঘ ঢাল নেমে গেছে তিন দিকে, সামনে, ডানে, বাঁয়ে। চোখের সামনে সুখজাগানিয়া সবুজ। সেখান থেকে চা বাগানের ভিউ চমৎকার। জনি আর সাইফুলের ছবি তোলে দিলাম। একটু পর মিল্টন আসলে মোবাইলটা তুলে দিলাম তার হাতে। ছবি তোলার যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল পুরো টিমকে। ঢাল বেয়ে নিচে নেমে বাগান দেখলাম। সাইনবোর্ডে সতর্কবাণী। চা পাতা ছেঁড়া যাবে না, ছিঁড়লে জরিমানা।
রাস্তার পাশে বাগানের ঠিক ওপরে কয়েকটি দোকান। যেখান থেকে বিনে পয়সায় চা খাওয়ানো হচ্ছিল। কেন? বিনে পয়সায় কেন? চা পান করে সেখান থেকেই চা পাতা কিনবেন সেই আশায়। ব্যবসার পলিসি হিসেবে এটা বেশ কাজে দিচ্ছিল। চা সাধলো আমাকেও। কিন্তু আমি চা, কফি, পান, সিগারেট খাই না। দোকানি বলছিলেন, এটা অর্গানিক টি দাদা। কোনো কেমিক্যাল নেই। বাইরে দাম অনেক বেশি। এখানকার চা-ও পিওর, দামও কম শিউর।
কেজি দুয়েক চা নিলাম। আমার কেনা দেখে যেন হামলে পড়লো হুজুগে বাঙালি। টিমের প্রায় সবাই চা কেনা শুরু করলেন। দোকানি মেপে, প্যাকেট করে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। অবশেষে দোকানের প্রায় সব চা শেষ। দোকানি খুশি বেশ!
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-৫॥ উদয় হাকিম