পর্ব-৪
মিরিক পাহাড় থেকে চোখে পড়লো আলো ঝলমলে আরেকটি শহর। পার্থ জানালেন, ওটাই দার্জিলিং। দূর থেকে দার্জিলিং শহর দেখে মন ভরে গেলো। আহা স্বপ্নের দার্জিলিং! কত সুন্দর! মন ভরে দেখছিলাম জিপের জানালা দিয়ে। পাহাড়ি কোনো শহর দেখতে হলে পাশের কোনো উঁচু জায়গা থেকে দেখাই ভালো। ওই শহরে গিয়ে ওর সৌন্দর্য কিছুই বোঝা যায় না। এটুকু অন্তত বোঝলাম, দার্জিলিং মোটেও সমতল কোনো শহর নয়। বিশাল পাহাড়ের গায়ে শত শত বাড়ি ঘর।
চা-বাগান আর ঘন পাইন বন পেরিয়ে যাচ্ছিলাম সামনে। পাইন বনের ভেতর দিয়ে সাজানো গোছানো রাস্তা। লোভ হচ্ছিলো নেমে ছবি তোলার। কিন্তু রাত! আহা, একা যদি এমন বনে থাকার সৌভাগ্য হতো!
বলা ছিলো, শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং ৩ ঘন্টার পথ। আমাদের লেগে গেলো ৫ ঘন্টা। সে যাই হোক, ২৪ ঘন্টার জার্নিতো শেষ হলো। রাত পৌনে ন’টার দিকে পৌঁছলাম স্বপ্নের দার্জিলিং।
দার্জিলিংয়ের পিস প্যাগোডা, রক গার্ডেন
রাতের দার্জিলিং! সত্যিই অপরূপ! দেখেছিলাম আগের রাতে। মিরিকের দূর পাহাড় থেকে। যেন আঁধার রাতে হাজারো জোনাকির নাচন। আরও কাছ থেকে মনে হয়েছিল পাহাড়ের গায়ে আলোর দেয়ালি। সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। দূর থেকে শুধু উপভোগ করা যায়। তার কোনো ভাষা নেই। অবর্ণনীয়।
দার্জিলিং দেখার তৃষ্ণা বাড়িয়েছিল সে দৃশ্য। উঁচু পাহাড়ের ঢালে অগুনতি চায়ের গাছ। সবুজের সমারোহ। মসৃণ পাইন গাছের সারি। পাহাড়ের শরীরে ছোট ছোট বাড়ি। আহা এমন দৃশ্য! তর সইছিল না।
শহরের রাস্তাগুলো সরু। সারাদিন একটা দুটো গাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশ সাহেবরা যাওয়া-আসা করতো। এখন সেখানে শত শত গাড়ি। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পরিকল্পনা করে কিছু হয়নি। তাই, নামের মধ্যে যতটা আভিজাত্য, চেহারায় এখন সেটা কিঞ্চিত বেমানান।
সরু পাহাড়ি রাস্তায় জ্যাম ঠেলে ঢুকলাম দার্জিলিং শহরে। বেজায় ঘিঞ্চি শহর। একটার গায়ে আরেকটা বিল্ডিং লেগে। পাহাড়ের গায়ে বাড়ি ঘর। মূল রাস্তা থেকে ওপরের দিকে উঠছিল জিপ। জিপ ছাড়া অন্য গাড়ি পাহাড়ে ওঠার উপযোগী নয়। তারপরও কিছুদূর গিয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো। রাস্তা খাঁড়া। বিপজ্জনক, গাড়ি উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা। বাকিটা পথ হাঁটতে হবে। মেঘলা রাত, কুয়াশা, শীত; তার ওপর অচেনা পথ।
যার যার ব্যাগপত্তর কাঁধে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম সবাই। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠছিলাম। ওপরে ওঠা কতটা কঠিন বুঝছিলাম। হোটেল লবিতে গিয়ে ঠাস করে বসে পড়লাম। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আবার ওপরে। লিফট নেই। আমার রুম মেট হলেন জাহিদ হাসান। মিনিট পাঁচেক পরেই ডিনার।
গ্রীষ্মকাল ছিল। ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি অবদি বেশ গরম ছিল। কিন্তু দার্জিলিংয়ে অনুভব করলাম শীত। খাবার পরিবেশন করা হলো গরম জল সহযোগে। তারচেয়েও বেশি গরম ছিল পেট। দেরি না করে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম।
তুলছিলাম আমরাও। বাঁধানো পথ আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলাম। ঝরনার একপাশ থেকে আরেকপাশে যেতে ছোট ছোট সেতু। তার ওপরে নানান পোঁজে ছবি তুলছিলেন তারা। তারা কারা? ওই যে তিন জনের নাম বলছিলাম।
রাতের খাবার শেষ করে হোটেলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ শীত। কুয়াশায় চারদিকে ঢাকা। তার মাঝ দিয়ে মিটিমিটি তারার মতো জ্বলছিল শহরের উজ্জ্বল বাতিগুলো। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ভবনের ম্রীয়মান আলোয় দেখলাম একটা পুরনো বুড়ো শহর; শীতে জুবুথুবু। শরীর ক্লান্ত। দেরি না করে বিছানায়।
সকাল বেলা বিপদে পড়লাম। গোসল করা ছাড়া বেরুতে পারি না আমি। এতো ঠাণ্ডা, অথচ গরম পানি নেই। কী আর করা। ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল করে রেডি হলাম। গরম লুচি, আলোর দম খেয়ে সোজা গাড়িতে। ঘড়িতে তখন সাড়ে ৯ টা। ১৫ জন দুই জিপে। গাইড পার্থ বাসনেত জানালেন দিনের কর্মসূচি।
প্রথমে পিস প্যাগোডা। যার আরেক নাম জাপানিজ টেম্পল। বৌদ্ধ উপাসনালয়। উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই শান্তির উপাসনালয়ে হাজির। এশিয়ার ট্যুর অপারেটরদের একটা কমন বিষয় আছে, তারা মন্দিরে নিয়ে যাবেই। মন্দির উপাসনালয়। সেখানে ট্যুরিস্টদের নেওয়ার কী দরকার! ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা…সব একই।
পিস প্যাগোডার প্রবেশ পথটা সুন্দর। চারদিক নীরব। শান্তি শান্তি ভাব। অনেকটা বাংলাদেশের নেত্রকোনার সুসং দূর্পাপুরের রানিক্ষ্যং চার্চের মতো। যার পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুমেশ্বরী নদী। এখানে অবশ্য কোনো নদী নেই। নেই আশেপাশেও। তবে প্যাগোডায় প্রবেশের প্রথম ভবনটা আমার কাছে রানিক্ষ্যং-এর প্রথম ভবনের মতো মনে হলো। ছোট্ট দোতলা ভবন। পরিপাটি। সামনে কিছু শোভা গাছ। দুটি সিংহের মূর্তি। ওপরে পিংক কালার। মূল ভবন সাদা। প্রশাসনিক ভবন এটি। এর ডান পাশে ছোট্ট একটি ফুলের বাগান। ছোট-বড় নানান জাতের ফুল ফুটে ছিল।
প্যাগোডায় ঢুকে আমি মগ্ন এর সৌন্দর্যে। তখন ফিরোজ, মামুন, মিল্টন ব্যস্ত ক্যামেরা নিয়ে। কোনো ট্যুরে গেলে এই তিন জনের মাথায় কেবল ছবি, ক্লিক, লোকেশন, পোজ এইসব। আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। এরা যে লোকেশনইে যাবে মিনিমাম তিন চারটা টি শার্ট-গেঞ্জি নিয়ে যাবে। লোকেশন কিংবা ব্যাক গ্রাউন্ড পাল্টে গেলে ড্রেসও চেঞ্জ করে ফেলে। তিন জনে ৩টা করে নিলেও এরা সেটা ৯টা বানিয়ে ফেলে। কিভাবে? এরটা ও পড়ে, ওর টা এ।
খেয়াল করলাম একটা লোকেশন ওরা মিস করেছিল। বাগানের বর্ণিল ফুলগুলোকে ফোরগ্রাউন্ডে রেখে, ব্যাক গ্রাউন্ডে চমৎকার কয়েকটি পাইন গাছ। ইংরেজরা এর উচ্চারণ করে ফাইন-ট্রি। সত্যিকার অর্থেই ফাইন দেখাচ্ছে। মামুনকে ইয়ার্কির মতো ধমক দিয়ে আমার দিকে ক্যামেরা তাক করতে বাধ্য করলাম। পরে দেখলাম ছবিটা সত্যিই দুর্দান্ত হয়েছিল। ধন্যবাদ মামুন।
ওদিকে আমি যখন আশেপাশের খাদ, ঘরবাড়ি আর গিরিখাদ দেখতে ব্যস্ত; টিমের অন্যরা তখন সেলফি নিয়ে ব্যস্ত। কিছু বলার নেই। এরা সেলফি জেনারেশন। সেলফি ফোবিয়ায় আক্রান্ত।
খানিকটা দূর থেকে দেখছিলাম পিস প্যাগেডার মূল গম্বুজ। পুরোটা শান্তির রঙ সাদায় মোড়া। সামনের চত্বর, সিড়ি শ্বেত পাথরের। বড় একটা পাহাড়ের ওপর এই প্যাগোডা। চারদিকে শোভা বাড়িয়েছে শোভা বৃক্ষ।
দার্জিলিংয়ে গিয়ে একটা জিনিসের প্রেমে পড়ে গেলাম। সেটা হলো ওই পাইন গাছ। অনেক কবির লেখাতেও এই হ্যান্ডসাম গাছটির বর্ণনা শুনেছি। ইউরোপে গিয়েও দেখেছি। কিন্তু দার্জিলিংয়ে এসে যেন নতুন এক স্মার্ট ট্রি দেখতে পাচ্ছি। ওই যে শ্বেত পাথরের সিঁড়ির কথা বলছিলাম, ওর পাশেই বয়সী পাইন গাছের সুন্দর উপস্থিতি।
দেখতে দেখতে আকাশ মেঘে ঢেকে গেলো। চোখের সামনে উড়ে এসে জুড়ে বসলো মেঘ। কুয়াশার মতো দ্রুত ঢেকে দিয়ে গেলো প্যাগোডার দৃশ্যপট। ছবিও তোলা যাচ্ছিল না। এটাই প্রকৃতির শক্তি। তার কাছে আধুনিক বিশ্বও অসহায়। সময় কম, কেটে পড়লাম ঝটপট।
দার্জিলিংয়ের পাহাড়গুলো একটু বেশিই উঁচু। যতটা ভেবেছিলাম তারচেয়ে বেশি। ভয়ঙ্কর সেই রাস্তা ধরে উঠছিলাম, নামছিলাম, বিপদজনক বাঁক নিচ্ছিলাম। আধা ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছলাম রক গার্ডেনে। এটা মনে হলো শহরের উত্তর প্রান্তে। পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নিচের রক গার্ডেন দেখতে ভারি সুন্দর!
উত্তরের সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলো ঝরনা। কলধ্বনি শোনা যাচ্ছিল দূর থেকে। পাথুরে পথ বেয়ে নেমে আসা ওই ঝরনাই স্পটটির মূল আকর্ষণ। পাশ দিয়ে বাঁধানো পথ, সিঁড়ি আর সেতু। ওসব ধরেই ওপরে উঠতে হয়। অনেক পর্যটক আসেন এখানে। বিশেষ করে, প্যাকেজ ট্যুরে যারা আসেন তাদের তালিকায় এটা থাকবেই।
লোকজন ঝরনার সামনে ছবি তুলছিল। তুলছিলাম আমরাও। বাঁধানো পথ আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলাম। ঝরনার একপাশ থেকে আরেকপাশে যেতে ছোট ছোট সেতু। তার ওপরে নানান পোঁজে ছবি তুলছিলেন তারা। তারা কারা? ওই যে তিন জনের নাম বলছিলাম।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-৩॥ উদয় হাকিম