(পর্ব-১৫)
কালিম্পংয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা
কালিম্পং। সবুজ বনানীতে সাজানো সুউচ্চ পাহাড় আর তার ভাঁজে ভাঁজে মেঘের খেলা, এই হলো কালিম্পংয়ের আসল সৌন্দর্য। একে আরও মোহনীয় করেছে প্রবহমান তিস্তা। এত শান্ত, স্নিগ্ধ মনোলোভা স্থান পৃথিবীতে কম-ই আছে। বলা চলে কবি-সাহিত্যিকদের জন্য আদর্শ জায়গা।
কালিম্পংয়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা বলা চলে দেলো বাইও বোটানিক পার্ক। এর বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় চত্বর মন কাড়ে সবারই। নানা রকমের পাতাবাহার, ক্যাকটাস আর শত শত জাতের গাছগাছালিতে পরিপূর্ন। প্রকৃতিকে এখানে কোনো আঘাত করা হয়নি। লালন করা হয়েছে সযত্নে। উঁচু-নিচু জায়গাগুলোকে তার মতো রেখেই সাজানো হয়েছে।
গাইড পার্থ শুরুতেই আমাদের নিয়ে গেলেন পশ্চিম উত্তর কোনের একটি উঁচু জায়গায়। আঙুল তুলে দেখালেন, ওইটা কাঞ্চনজঙ্ঘা। পশ্চিম-উত্তর কোণে ধবধবে সাদা একটি চূড়া। পিরামিডের মতো মাথা বের করে আছে। দুই পাশে ঘন সাদা মেঘ। যে কারণে শুধু ওই সুশ্রী মুণ্ডুটুকুই দেখা যাচ্ছিল। এটা দেখার জন্য কত চেষ্টা করেছিলাম দার্জিলিংয়ে। পারিনি। যাক, অবশেষে এই ট্যুরে পরম আকাঙ্ক্ষিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলো। কী বিশাল শুভ্র সৌন্দর্য নিয়ে নিশ্চুপ, অবিচল দাঁড়িয়ে আছে।
দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর কাছে তিস্তা। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার ঠিক নিচ দিয়েই সর্পিল গতিতে বয়ে গেছে। দুপাশে ঘন বন। মাঝখানে রূপসী স্রোতস্বীনি। হিমালয় থেকে এর উৎপত্তি। লামো লেক থেকে। বলা হয়ে থাকে, যৌথভাবে লামো লেক এবং তিস্তা খাংচি হিমবাহ থেকে এই নদীর উৎপত্তি। ওই হিমবাহ ৭ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতায়। স্থানটি উত্তর সিকিমে পড়েছে। এই তিস্তা দিয়ে সিকিম এবং কালিম্পংয়ের সীমানা ভাগ করা।
আমি বললাম, গ্রুপ ছবিটা ওখানেই হয়ে যাক। সবাই জার্সি নিয়ে এসেছিলেন। সেটি গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছনে পাহাড়ের মাথায় আটকে থাকা মেঘ আর কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া নিয়ে ছবি হলো। প্রথমে ফিরোজ আলম, পরে মিল্টন ছবি তুললেন। এ দুজনের ফটোগ্রাফির হাত ভালো।
কিন্তু সবার ছবি তো হলো না। দুই ফটো থেকে দু’জন ফটোগ্রাফার বাদ গেলেন! তাহলে? স্থান বদল করলাম। জার্সিও চেঞ্জ হলো। ক্যামেরা চলে গেলো গাইড পার্থর হাতে। পার্থ অবশ্য ভালোই ছবি তোলেন। ক্লিক…ক্লিক…।
এবার একা একা ছবি তোলার পালা। একটা ক্যামেরা জনির হাতে দিয়ে আরেকটা নিয়ে গেলেন মিল্টন-মামুনরা। তারা কোথায় গেলেন, কে জানে। ছবি তোলার দুর্দান্ত নেশা তাদের। জনির ক্যামেরা নিয়ে কিছু ছবি তোললাম। জনি, সোহাগ, শাকিল, সাইফুল, কোচ জাহিদ, নারকেল জাহিদ, আরও কয়েকজনের সিঙ্গেল ছবি নিলাম। সোহাগ এসে বায়না ধরলো তার খালি গায়ে ছবি তুলতে হবে! পোলাপান! দিলাম তুলে। জনি বললো, ওভাবে তার ছবিও তুলতে। স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে তুললাম আমিও। রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মেঘে ভেসে যাওয়ার মতো করে পোঁজ দিলাম, ক্লিক। ছবি তোলা যেন শেষই হচ্ছিল না। শুয়ে-বসে যে যেভাবে পারে ছবি তুলছিল। কিছুক্ষণ পর মেমোরি কার্ড শেষ। এবার শুরু হলো মোবাইল ফোনে তোলা।
একদল বৌদ্ধ শিক্ষার্থী, ভিক্ষু হওয়ার ব্রত নিয়ে যারা দীক্ষা নিচ্ছেন, গেরুয়া বসন পরে এসেছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে ভাব জমিয়ে ফেললাম। তারপর ছবি তুলতে চাইলাম। সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। তাদের নিয়ে হলো আরেকটা গ্রুপ ছবি। এরপর গেলাম দক্ষিণ পূর্ব দিকে নিচু জায়গায়। ওখান থেকে প্যারাগ্লাইডিং দেখা যাচ্ছিল। অনেক উঁচুতে বেলুনের মতো কাপরে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন পর্যটকরা। দেখতে ভালো লাগছিল। কিন্তু নিজেকে চড়াতে ভয় লাগছিল। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে শূন্যে ভেসে যাচ্ছিল তারা। জগতের সুন্দর স্বপ্নিল দৃশ্যগুলোর একটি।
নূরুল আফসার চৌধুরী দেখলাম ফুল নিয়ে কসরত করছিলেন। ফুলের ছবি তোলার জন্য ঝুঁকে পড়ছিলেন, শুয়ে পড়ছিলেন। মনে হচ্ছিল ঢাকা ফিরে ফ্লাওয়ার ফটোগ্রাফির ওপর প্রদর্শনী করবেন। কিন্তু মামুনরা কোথায়? একবারে পশ্চিমে একটি টিলা আছে। এই পার্কের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সেখানে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, অফিস ঘর আর মন্দিরের পাশের রাস্তায় বসে পোঁজ দিচ্ছেন তারা, ক্যামেরা মিল্টনের হাতে।
জনি সাইফুলকে নিয়ে গেলাম উঁচু ওয়াচ টাউয়ারের নিচে। ওখান থেকে তিস্তা আর পার্শ্ববর্তী পাহাড়কে আরও রূপবতী মনে হচ্ছিল। কয়েকটা ছোট ছাউনি করা সেখানে। কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা বসে নিরালায় গল্প করছেন। ওদিকে না তাকানোই ভালো। কত দূর থেকে ওরা গেছে একটু আড়াল খুঁজতে। জগতের সব প্রেমিক-প্রেমিকা আড়াল খুঁজে বেড়ান। কেউ পান, কেউ পান না। কেউ আড়াল থেকে ‘বেড়াল’ হয়ে যান, কেউবা স্মৃতি হাতড়ান। সামনে উঁচু পাহাড়, তিস্তা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, পেছনে ছাউনির আড়াল, আধফোটা ঘাসফুল। প্রেম করার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কই?
খেয়াল করলাম, ওই দেলু পার্কটাও একটা মালভূমির মতো জায়গা। এর চারপাশে নিচু খাদ। খাদ পেরোলেই উঁচু পাহাড়। আর প্যারাগ্লাইডিং হচ্ছিল একটা উপত্যকার ওপর। ডেলু বা দেলু পার্ক ওই শহরের সবচেয়ে উচুঁ পয়েন্ট।
বেলা পড়ে এলো। মোবাইলে ছবি তোলা চলছিলই। পাশের ঘাসেমোড়া সবুজ কার্পেটের ওপর বাচ্চারা খেলছিল। শিশু আর তাদের মায়েদের হৈ হুল্লুড় চলছিল। বেরিয়ে গেলাম পার্ক থেকে। দুপাশের সবুজ মায়া পেরিয়ে পার্ক থেকে গেলাম বেরিয়ে।
যাওয়ার পথে খেয়াল করলাম অনেক উঁচু একটা সড়ক ধরে ফিরছিলাম আমরা। কালিম্পং শহরের দুপাশে অসংখ্য দোকান। টিপিক্যাল উপমহাদেশের আরেক চিত্র। রাস্তা থেকে এতটুকু জায়গা ছাড়েনি কেউ। পারলে রাস্তার ওপর গিয়ে পাকা ভবন তুলেছে। রাস্তা সরু। দুটো গাড়ি পাস হতে কষ্ট হয়। যা হওয়ার তাই হচ্ছিল, ট্রাফিক জ্যাম। তবে কালিম্পং শহর তেমন একটা ভালো লাগবে না। তার চেয়ে শহরতলী বেশি আকর্ষণীয়।
হোটেলে গিয়ে পড়লাম বিপদে। তখনো রুমে কিছুই দেওয়া হয়নি। যতবরাই ফোন করি এটা লাগবে, ওটা লাগবে, ততবারই উত্তর দিচ্ছিল দেখছি দাদা। কিন্তু দেখা আর হচ্ছিল না। একজন একজন করে লোক আসছিল, চলে যাচ্ছিল। কাজের কাজ হচ্ছিল না। টিভি নষ্ট, সেটি দেখতে একজন এসে বললেন, এটা তো ঠিকই ছিল। জানতে চাইলাম, সত্য করে বলেন তো কাহিনি কী? আমার তো মনে হচ্ছে এগুলো কখনোই ঠিক ছিল না। এসব বলা আপনাদের পলিসি। লোকটি ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
আসলে ঘটনা হচ্ছে এখানে এক রাতের বেশি সাধারণত কেউ থাকতে আসে না। তাই টিভি ঠিক করার দরকার হয় না। কেউ ঠিক করতে বললেও, দেখছি বলতে বলতেই সময় শেষ হয়ে যায়। সকালে চলে যায়। ঠিক করার দরকার হয় না। টাউয়েল, সাবান এগুলো? ওই একই ব্যাপার। ৫/৬ বারের বেশি একই বিষয় নিয়ে কেউ বলে না। সবাই নীরবে সহ্য করেই চলে যায়।
আমরা ছিলাম নাছোড়বান্দা। শেষে সাবান আর টাউয়েল এলো। ফিরোজ আলম প্রস্তাব করলেন, আপনারা মামুনদের রুমে চলে যান। তাই গেলাম, বেচারা মামুন আর আলভি চলে গেলেন আমাদের রুমে।
রাতের খাবার শেষ করে সবাই ঘুমিয়ে। আমি লিখতে বসলাম। লেখা শেষ হলে তখন অনেক রাত। নিচ থেকে গানের আওয়াজ আসছিল। এরা কারা? আমাদের টিমের, নাকি বাইরের শিল্পী। ভাবলাম গিয়ে দেখি। পড়ে মনে হলো টিমের ২ জন সিনিয়রের মধ্যে একজন আমি। নিচে গিয়ে কী না কী দেখব! মামুনের রুমে গিয়ে টোকা দিলাম। বেচারা কাঁচা ঘুম নিয়ে উঠে এলেন। বললাম স্যরি। না বলেন, সমস্যা নেই। নিচে গিয়ে দেখবেন গান গাইছে কারা। আমি যেতে চাই। যাওয়া ঠিক হবে কি না। ওকে আমি দেখছি।
কিছুক্ষণ পর মামুন এসে বললেন, আপনার যাওয়া ঠিক হবে না। পরে শুনলাম জুনিয়ররা মুরগী এনেছিল বাইরে থেকে। ছিল আরও কিছু খাওয়ার জিনিস। খাচ্ছিল আর ঘটি বাটি বাজিয়ে আধা বেহুঁশের মতো গান গাইছিল। আমি শিউর ইয়া চৌধুরী আর শাকিল ছিলেন মধ্যমণি।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-১৪॥ উদয় হাকিম