(পর্ব-১০)
ঐতিহাসিক ঘুম রেল স্টেশন
গোসল সেরে নাস্তা। আইটেম ছিল রুটি আর পাস্তা। পাস্তা-পোস্তা ভাল্লাগে না। লাইক করি না। রুটি ডাল খেয়ে সোজা রুমে। ব্যাগ গোছানো ছিল আগেই। চেকআউট করে জিপে। দার্জিলিং ছেড়ে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য লামাহাট্টা হয়ে কালিম্পং।
একটা স্পট আমরা মিস করছিলাম। সেটি হলো ঘুম রেল স্টেশন, ঘুম মিউজিয়াম। আসলে যে কদিন ধরে দার্জিলিংয়ে ছিলাম, প্রতিদিনই কয়েকবার করে ঘুম রেল স্টেশন দেখছিলাম। একা একা একবার গিয়ে দেখেও এসেছিলাম। কিন্তু স্পট আইটেনারিতে ছিল বলে মনে হচ্ছিল ওটা মিস করছিলাম। হোটেল থেকে বের হতে না হতেই বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি।
পাহাড়ের উঁচু মাথা শর্টকার্ট রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছিলাম। ঠিক যখন মেইন রোডে উঠলাম তখনই দেখলাম রেল স্টেশন। গাইড পার্থকে বললাম, সুযোগ থাকলে আরেকবার রেল স্টেশনে যেতে চাই। ছবি তুলতে চাই। পার্থ বললেন, দ্রুত নেমে পড়ুন।
বৃষ্টি হচ্ছিল। ব্যাগ থেকে একটা গামছা বের করে সেটা মাথায় নিলাম। জিপ ঢুকলো পার্কিংয়ে। গাড়ি থেকে নেমেই দিলাম দৌড়। ভিজতে ভিজতে রেল স্টেশনের ছাউনির নিচে। স্টেশনের বেঞ্চিত যারা বসে ছিলেন সবাই শীতে জড়োসড়ো। কিছু গরিব মানুষ মলিন কাপড় নিয়ে অনিশ্চিত বসে। বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে পড়ছিল মাঝের বেঞ্চিগুলোতেও। টানা বৃষ্টিতে তারা আটকে পড়েছেন।
রেল লাইনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলাম একটা ট্রেন এসে থামলো হুইসেল বাজাতে বাজাতে। যাত্রীরা নেমে গেলেন। উঠার যাত্রী তেমন নেই বললেই চলে। সব কামড়া প্রায় ফাঁকা। চালক ও তার সহকারী ইঞ্জিনরুম থেকে নেমে এলেন। তাদের সঙ্গে ছবি তুললাম। অনুরোধ করলাম আমাদের ছবিও তুলে দিতে।
ঘুম রেল স্টেশনটি দার্জিলিং শহরের কেন্দ্র থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। যদিও এখন এটি শহরের অংশই হয়ে গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৭৪০৭ ফুট। ঘুম ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন। এ লাইন কিন্তু টয় ট্রেন লাইন। দার্জিলিং হিমালয়ান রেল কর্তৃপক্ষ (ডিএইচআর) এই ট্রেন পরিচালনা করছে।১৯৯৯ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে এই রেল পথ নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৮৬ কিলোমিটার। দুই জেলা দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ির মধ্যে যাতায়াত করে এই ট্রেন। এটি দুই ফুট ন্যারো গেজ রেল পরিষেবা। আজও ওই ট্রেন বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে চলে। তবে দার্জিলিংয়ে মেল ট্রেনের জন্য ডিজেলচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
এর হেডকোয়ার্টার কার্শিয়ং-এ। কার্শিয়ং হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার একটি আলাদা শহর, পৌর এলাকা। ফ্র্যাংকলিন প্রিস্টেজ নামে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির জনৈক এজেন্ট সরকারের কাছে বাষ্পচালিত ট্রামওয়ের মাধ্যমে শিলিগুড়িকে দার্জিলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব রাখেন। বাংলার লেফটেনেন্ট গভর্নর স্যার অ্যাশলে ইডেন এই প্রস্তাব ইতিবাচক মনে করলে এটি গৃহীত হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৭৮ সালে। রেলপথটি নির্মাণ করে গিলেন্ডারস আরবাথনট অ্যান্ড কোম্পানি। শিলিগুড়ি-কার্শিয়ং রেলপথ চালু হয় ১৮৮০ সালের ২৩ আগস্ট।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথ কর্তৃপক্ষ এটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৫৮ সালে এই পথ উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলের অংশে পরিণত হয়। ১৯৬২ সালে শিলিগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ৪ মাইল (৬ কিলোমিটার) পথ নতুন ব্রড গেজ লাইনের মাধ্যমে যুক্ত হয়। এই রেলের জন্য ১৭টি স্টেশন ও ১৫টি হল্ট স্টেশন রয়েছে। ১৯৩৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৪ সালে পুনর্নির্মিত হয়। রেললাইনকে ঘিরে পর্যটকদের জন্য রয়েছে নানান দর্শনীয় স্থান। যেমন ঘুম রেলওয়ে মিউজিয়াম, কার্শিয়ং-এ ডিএইচআর আর্কাইভ, এলিসিয়া প্লেস মিউজিয়াম এবং সুকনা রেলওয়ে স্টেশন ফটো গ্যালারি ইত্যাদি।
কেন মানুষ ডিএইচআর ভ্রমণে আসে? এর কয়েকটি কারনের মধ্যে রয়েছে এটি হিমালয় দর্শনের জন্য একটি গেটওয়ে। বিগত দশকের বাষ্পীয় ইঞ্জিনে চড়ে ভ্রমণের সাধ নিতে সুযোগ করে দেয় বর্তমান প্রজন্মকে। ভারতবর্ষের মানুষের কাছে ঘুম একটি ঐতিহাসিক স্টেশন। ইউরোপের অনেক পর্যটক ঘুম দেখতে আসেন।
আরও কিছু তথ্য দিই। পণ্য পরিবহন এবং যাত্রী সেবার জন্য এই রেলপথ তৈরি হয়। যদিও এখন এটি শুধু পর্যটকদের জন্যই চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংলগ্ন সেনা ক্যাম্পগুলোতে রসদ সরবরাহের জন্য এই ট্রেন লাইন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেবার আগে মাত্র একটি রেলওয়ে স্টেশনকে তারা ওই মর্যাদা দিয়েছিল। সেটি হচ্ছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার সেমারিং রেলওয়ে। ঠিক এর আগের বছর ইউনেস্কোর ওই বিশেষ মর্যাদা পায় সেমারিং।
সেমারিং কেন বিখ্যাত জানেন? উঁচু পার্বত্য এলাকায় অনেক দৃষ্টিনন্দন ওই রেলপথ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে সুরম্য অট্রালিকার মতো স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে স্থাপন হয় রেল লাইন। যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ১৮৮৪ থেকে ১৮৫৪ সালের মধ্যে ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই দুরূহ পথটি তৈরি হয়।
২০০৫ সালে নীলগিরি পার্বত্য রেলওয়েকেও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। যেটি ভারতের তামিলনাড়ুতে অবস্থিত। এর একটা কাহিনী ইন্টারেস্টিং। যে বছর অস্ট্রিয়ার সেমারিং রেল চালু হয় সেই ১৮৫৪ সালে নীলগিরি রেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায় তা আলোর মুখ দেখে ১৮৯৯ সালে!
আগের দিন বিকেলে রেল স্টেশন আর মিউজিয়ামের বাইরের দিকটা দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম পার্থকে নিয়ে গেলে আরও কিছু জানতে পারব। সে সুযোগ আর হলো না। রেল লাইন পার হয়ে সেদিন ঘুম জাদুঘরে গিয়েছিলাম। রেল স্টেশনের সঙ্গেই সেটি। একই চত্বরে। কিভাবে এই রেল লাইন তৈরি হলো, কেন তৈরি হলো ইত্যাদি ইতিহাস সেখানে লেখা ছিল। মিউজিয়ামের বাইরে পুরনো একটি ইঞ্জিন রাখা। কিছু ফুলের গাছ ছিল। দেয়ালে রেলওয়ে ম্যাপ আঁকা। রেলের ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ রয়েছে তারা সেখানে যান।
ওই যে বলছিলাম পুরনো ইঞ্জিন, যাকে প্রাচীনতম ইঞ্জিন বলা হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বেবি সিভক’। রেলগাড়ির পুরোনো কলকব্জা ছাড়াও বেশ কিছু বিরল ছবি রয়েছে ওই জাদুঘরে। এই মিউজিয়ামটি ডিএইচআর কর্তৃপক্ষের তিনটি মিউজিয়ামের একটি। ডিএইচআরের অন্যদুটি মিউজিয়াম যথাক্রমে কার্শিয়ং এবং শুকনাতে। ২০০০ সালে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে কয়েকশ বছরের পুরনো টয় ট্রেন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ডিএইচআর’র ঐতিহ্য বা ইতিহাস এবং অন্য তথ্যাদি সংরক্ষিত আছে এখানে। বেরি সিভক নামের এই ইঞ্জিন নিয়ে ১৮৮১ সালে পার্বত্য এলাকায় যাত্রা শুরু করে টয় ট্রেন। জাদুঘরটি ছোট পরিসরের হলেও এটি তথ্যবহুল। রেল স্টেশনের কাছেই সামটেন চোলি বৌদ্ধমঠ। একে অনেকে ঘুমমঠ বলেন। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি। এর জনপ্রিয় নাম ইগা চোলিং মঠ। ১৮৭৫ সালে লামা শেরাব গ্যাতসো এই মঠ স্থাপন করেন। গেলুগ নামে একটি বৌদ্ধ ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। এটি ঘুম শহরের তিনটি মঠের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম মঠ। এখানে রয়েছে মৈত্রেয় বুদ্ধের দৃষ্টিনন্দন বিগ্রহ বা মূর্তি।
প্রাচীন লুপ্তপ্রায় বেশ কিছু বৌদ্ধ পুঁথি এখানে সংরক্ষিত আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের তিব্বতি অনুবাদ করা পুঁথিও এই মঠে পাওয়া যায়। মঠটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,০০০ ফুট উচ্চতায়। মৈত্রেয় বুদ্ধের একটি ১৫ ফুট লম্বা মুর্তি আছে ওখানে। এছাড়া বুদ্ধের শিষ্য চেনরেজি ও চোঙ্গাপার ছবিও রয়েছে।
ও, আরেকটা কথা। এই যে এতবার ঘুম নামটি উচ্চারণ করছি, এই ঘুম আসলে কী? ঘুম আসলে একটি পাহাড়ের নাম। নজরুলের একটা গান আছে, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। নীরব নিথর হয়ে পাহাড়ের ওই ঘুম দেখেই তিনি হয়তো ওই কথা লিখেছিলেন। দার্জিলিং মূল শহরের পাশের একটি পাহাড়ের নাম হচ্ছে ঘুম। মূল শহর থেকে ৭ কিলো দূরে ছিল আগে। বলা চলে আলাদা শহর ছিল। তবে এখন আর আলাদা নয়। মাঝের জায়গাটুকুও শহর হয়ে একীভূত হয়ে গেছে। ঘুম শহরের উত্তরে দার্জিলিং, দক্ষিণে কার্সিয়াং, পূবে তিস্তা নদী এবং কালিম্পং, পশ্চিমে সুখিয়াপোখরি। হয়তো আগেও বলেছি, ঘুম রেল স্টেশন হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্টেশন।
ঘুমের আশে পাশেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট রয়েছে। সেগুলো হলো মিরিক, সান্দাকফু (এটি নেপাল সীমান্তবর্তী, অনেকেই সেখানে বেড়াতে গিয়ে নেপালও ঘুরে আসেন), বিজনবাড়ি ইত্যাদি।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-৯॥ উদয় হাকিম