॥ পর্ব-২॥
০৫.
মিলি, আইনুদ্দিন চাচা চলে যাওয়ার পরও মোখলেস সেখানে অনেকক্ষণ বসে থাকে। তার বয়সী গাছের নিচে বসে শান্তি খুঁজে, চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে চায়। তার সংসার চলে আবাদের টাকা দিয়েই। ধান যখন ঘরে তুলে তখন দাম পায় না। মাচায় যখন ধান থাকে না তখন আবার দাম বাড়ে। এবার তিস্তার ক্যানেলেও পানি নেই। চিন্তায় চিন্তায় মোখলেসের বসে যাওয়া চোখ আরো বসে গেছে। সেখানেই যেন তৈরি হয়ে গেছে নদী।
শাহরিয়ার, তুমি মোখলেস আর আইনুদ্দিন চাচা সম্পর্কে জানলে কেমন করে?
আহসান ভাই বলেছিলো না, হাটবারে আসিস অনেক পেমার মানুষের সঙ্গেই তোর দেখা হবে।
হুম, বলেছিল।
হাটের দিনেই তাদের সঙ্গে পরিচয় ও আলাপ হয়; সেখান থেকে জেনেছি। ঠিকানা নিয়ে তাদের এলাকায় যাই।
কি নাম সেই এলাকার?
পাগলাপীর। সেখানে যাওয়ার পর মোখলেস এবং আইনুদ্দিন চাচা ছাড়াও অনেকের গল্প জানতে পেয়েছি; যা আমার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ছিলো। মজার ব্যাপার হলো, এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন কাজ করছে, অথচ কৃষিই তাদের মূল পেশা। কেউ কেউ দেশের বাইরে যাচ্ছে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে। ধান, পাট, তামাক আবাদ করে। আলুর আবাদ চালু হওয়ার পর তামাক উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। পাগলাপীরে যাওয়ার সময় দেখলাম রাস্তার দুইপাশে অনেক গাছ। সবুজের পর সবুজ। সবুজের বিস্তার বুঝতেই দেয় না এ অঞ্চলের মানুষের সংকটাপন্ন জীবন।
আচ্ছা! ফেসবুকে দেখলাম টাপুর চরে যাওয়ার ছবি ছাড়ছো?
পাগলাপীরে যাওয়ার কয়েকদিন পর আহসান ভাইয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম।
কী কী দেখলে?
দেখলাম তাদের বিচ্ছিন্ন জীবন।
ঠিক করে বলোনা।
টাপুর চরে যাওয়ার পর দেখতে পাই জমিতে বড় বড় গর্ত। জানতে পেলাম বন্যার সময় ভেঙেছে এমন করে। এ অঞ্চলের মানুষ খরা মৌসুমে মরুভূমিত থাকে। আর বর্ষাকালে পানিতে হাবুডুবু খায়। এখানে কোনো মিডিয়ার লোক যায় না। যাবে কেমন করে? যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট রাস্তা নেই। রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে হয় ক্ষেত এবং আইল। বাইক কিংবা নৌকা করে তাদের মূল শহরে যোগাযোগ রাখতে হয়। বাইক ভাড়ায় চালায়। জন প্রতি বিশ কিংবা ত্রিশ টাকা। প্রসূতি নারীর জন্যও একই ব্যবস্থা। বাইকের পেছনে একজন বসবে তার কোলে ওই রোগী বসবে। ক্ষেতের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় ঝাঁকি খেয়ে রাস্তাতেই অনেকের ডেলিভারি হয়ে যায়।
এ তো দেখছি আদিম যুগের মতো?
এটা হিসাবে রাখতে পারো। তারা তো সংকটের কথাগুলো বলতে পারে না। বর্ষায় বুক সমান পানিতে তলিয়ে থেকে চরবাসী শরীর পরিস্কার করতে পারে। না চাইলেও পানি এসে তাদের এ কাজটুকু করতে বাধ্য করে। মাঝে মধ্যে পানিও মহান হয়ে ওঠে, বিশেষত বর্ষায়। এখানে চরের পর চর আছে। পল্লীবিদুৎ না থাকায় ঘরে ঘরে সৌরবিদুৎ। ছোট ছোট ফ্যান, লাইট জ্বালায়। খুব দরকার না হলে মূল শহরে তাদের যাওয়া হয় না। যারা মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে তাদের সকাল ৬ টায় প্রাইভেটে যেতে হলে ফজরের আযানের সময় উঠে প্রস্তুতি নিতে হয়। ছেলেমেয়েকে বিয়ে করাতে গিয়ে তাদের পড়তে হয় অনেক যন্ত্রণায়। রাস্তা না থাকায় আত্মীয়তায় রাজি হয় না শহরের মানুষ। অপরিচিত একজন গ্রামে ঢুকলে তাকে দেখার জন্য মানুষ জড়ো হয়। টিনের ঘর, টিনের বেড়া। রাস্তায় ঝাঁকি খেয়ে আমার মানিব্যাগ পড়ে যায়, বাইক চালক পেয়ে আমায় ফেরত দিলে জড়ো হওয়া মানুষ চালক এবং আমার কাছে বারবার জানতে চাচ্ছিল কত টাকা ছিলো। এই জানতে চাওয়ার মাঝে দেখতে পেয়েছি দারিদ্র্যের নির্মমতা। নদী পারাপারে ঝামেলা থাকায় এখানে পুলিশ আসতে চায় না। মেম্বার, চেয়ারম্যান, মাতবর কিংবা যাদের টাকা-পয়সা আছে এ চরে তারাই পাওয়ার হোল্ড করে। এখানে কয়েকজন ভালো নেতা ছিল, তারা চেয়েছিল যেদিকে নদী ওইদিকেই যৌথ বাঁধ হোক। যাতে করে নদীর ক্ষতি থেকে তারা বাঁচতে পারে। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা বাঁধা দেয়। পরে তারা ভুল জায়গায় বাঁধ দেয়।
যৌথ বাঁধ মানে?
ভারত ও বাংলাদেশের অর্থায়নে হওয়া বাঁধ। তারা জানালো বাঁধটা যদি পুবে না হয়ে দক্ষিণ দিকে হতো তাহলে টাপুর চরের ক্ষতি হতো না। এখন এ অঞ্চলের মানুষেরা বালুর বাঁধ দিচ্ছে নিজেদের টাকা খরচ করে। তাদের সঙ্গে আলাপ করার সময় কান্নার শব্দ শুনতে পাই। পাশে থাকা একজনের কাছে এর কারণ জানতে চাইলাম। সে বললো সাইতুন নামে একজন অসুস্থ। যায় যায় দশা। তার সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে সঙ্গে থাকা মানুষেরা আমায় তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে নতুন কিছু জানতে পাই, যা আমার গবেষণার জন্য সহায়ক মনে হলো।
কী এমন জানলে?
জানলাম সাইতুন নামের একজনের সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে।
কার কাছ থেকে জানলে?
সমীরণের কাছ থেকে। সাইতুন ঢাকায় যাওয়ার পর তার কাছেই আশ্রয় পেয়েছিলো। সমীরণ বাসে জিনিসপত্র বিক্রি করে। অসুস্থ সাইতুনকে সেই ঢাকা থেকে টাপুর চরে নিয়ে আসে।
শাহরিয়ার, সাইতুনের গল্প কেমন ছিল?
সাইতুনের সঙ্গে সমীরণের দেখা হওয়া, কেন তাকে ঢাকায় যেতে হলো, ঢাকায় গিয়ে সাইতুন কী কাজ করতো, শিল্পী নামে তার স্কুলবান্ধবীর সঙ্গে দেখা হওয়া, সাইতুনের প্রেম, পরে মুর্মূষু অবস্থা, এগুলোই।
খুলে বলোনা?
শোনো, তার বাবার নাম নিয়ামত আলী। তাদের বাড়িতে বসে মানুষ কত গল্প করেছে। সেসব গল্পে রস ছিলো। সাইতুনের মা মরিয়ম পান বানিয়ে দিতো; খেতে খেতে গল্প জমতো। সাইতুনের বাবা চরে আবাদ করতো, অবসরে নদীতে মাছ ধরতো। তাদের সংসারে ছিল দুই ছেলে, দুই মেয়ে। অর্থ-সম্পদ বেশি না থাকলেও সুখ ধরার জন্য যতটুকু দরকার ছিলো, তাদের তা ছিলো। সুখ, অসুখে রূপ পেয়ে গভীর হয় তিস্তার পানি বেড়ে গিয়ে চর ভাঙলে। পানি এত বেশি হতো না। ভারত গজলডোবার গেট খুলে দিলে পানির গতি বাড়ে। আর তিস্তা ব্যারেজের কারণে সেই পানি আটকে যায়। পানি বেশ কদিন জমে থাকলে মাটি নরম হয়ে ভাঙন সহজ হয়। সাইতুনের বাবা মারা যায় দুঃখ সহ্য করে। সে স্বপ্ন দেখে চর জেগে উঠবে। আবার আবাদ করতে পারবে। নদীতে মাছ ধরবে। এ স্বপ্ন নিয়েই চোখের পাতা বন্ধ করে। পরের জীবনে ঘুম থেকে উঠে হয়তো এর ব্যাখা জানতে চাইবে অপরিচিতের কাছে। তারা কি জবাব দেবে সেটা তাদের খেয়াল-খুশি। দুনিয়ায় তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে ঠিকানা খুঁজে পায় অন্যের দয়ায়। তার বউ মরিয়ম বয়সের ভারে পথ চলতে না পেয়ে ঘরে বসে ঝিমায়। দেখতে পায় দুছেলের মরার দৃশ্য। তারা মারা যায় অসুখ-বিসুখে। কেবল কাজি মরা হয়ে টিকে আছে সাইতুন এবং তার বোন। বোনের বিয়ে হয়েছে, জামাই বাড়িতে থাকে। সংসার চালানোর জন্য অর্থের সংস্থান করতে সাইতুন ঢাকায় যায়। অপরিচিত শহর। কাউকেই চিনে না। শহরের নির্মমতা তাকে চেপে ধরে। পড়ে থাকে সাভারে অন্ধ মার্কেটের গলিতে। নিঃশ্বাস আর মুখের কথা সমানতালে চলতে থাকলে কেউই বুঝতে পায় না সে যা বলছে। দুদিন পড়ে থাকার পর সমীরণের নজরে আসে। সে নিঃশ্বাসের শব্দ থেকে কথা উদ্ধার করে বুঝতে পারে তার বাড়ি নীলফামারীর টাপুর চরে। তাকে নিয়ে যায় নিজের বাসায়। তারও বাড়ি নীলফামারী। দেশির কষ্ট তো দেশিই বুঝবে।
০৬.
ক্যা বাহে, তোমরা ক্যামন আছেন?
গরীবের ভালো থাকা, আর না থাকার মাঝত তফাৎ নাই। তোমরা আলাপ শুরু করো আহসান ভাই। (দর্শকের সম্মিলিত স্বর)
আচ্ছা! ব্যারেজ যখন করিল তখন তো জমিবাবদ ট্যাকা দিছিল?
দর্শক-১
হয়, ট্যাকা দিছিল। একশ শতক, মানে অ্যাক একর জমির দাম দিছে সতেরো হাজার ট্যাকা। তাও একবারে দেয় নাই। তিনবারে দিছে। মোর মতো মানুষের জমিই আর কত কুইনা থাইকপার পারে? সোগমিলি দেড় থাকি দুই একর। ভাই-বোন আছে, সবায় মিলি ভাগ করি নিছি। কত আর পাওয়া যায় ভাগত? একবার দেইল সাত হাজার। আরেকবার দেইল তিন হাজার। আরেকবার দিছে সাত হাজার। এই জমিগুইলা ’৪০ সালে আর ’৬২ সালের ফাইনালত নেখা আছে ডাঙা, বালু, দোলা তিনটা ভাগ। ডাঙার দাম বেশি, বালুর দাম কম, দোলার দাম আরো কম। ফাইনালে আছে, মোর বাপের দুই একর জমি। ৫০ শতক ডাঙা আর বালুর। ডাঙার দাম একটা, বালুর দাম গেইছে আরেকটা। দাম-দর হইছে সিলপিকার হিসাবে। সিলপিকারে তো জমির দাম কম নেখা আছিল। দেখা গেইছে ৫ বিঘা জমিনের কত দলিল করছেন? আগের মানুষ ১২০০ ট্যাকা দিয়া জমি কিনলে ৮০০ ট্যাকার দলিল করছে। বিশ্বাস আছিলো। টেনশন করার ভয় আছিলো না। তোমার জমি কিনি নিছং মুই ১২০০ ট্যাকায়, দলিল করছং ৮০০ ট্যাকা। ৮০০ ট্যাকার দেড় করলে ১২০০ ট্যাকা আইসে। ইয়ারপর সিলপিকার আইসে নাই। যার ফলে য়েট পাই নাই। অ্যালাও তো এই অবস্থা। যা য়েট আছে, তাক তিনভাগ করে গভমেন্টী কায়দায়। ডাঙা, বালু আর দোলা। ডাঙা যদি চল্লিশ ট্যাকা হয়, বালু হইল সাড়ে বারো ট্যাকা। দোলা সাড়ে আট ট্যাকা। বারো শতক বালু, চৌদ্দ শতক দোলা, চব্বিশ শতক ডাঙা। তিন ভাগের জন্যে পামো তিন য়েট। সিলপিকারে যতকুইনা পাছি ওইখনায়ে দিছে। বালু জমির দাম পাছি সাড়ো বারো ট্যাকা শতক। ডাঙা পাইছি বাহান্ন ট্যাকা শতক। ওই সময় য়েট অ্যাকনা বেশি আছিল। য়েট বেশি হয়া নাভ হয় নাই। সিলপিকার আছিল আরো দশ বছর আগের। এইজন্যে য়েট পাইছি দশ বছর আগের। ’৬০-’৬১-’৬২-’৬৩ সালের সিলপিকার দিয়া আশি সালের জমি বেচা-কেনা হইছে। অ্যালাও যদি সরকারি হিসাবে কোনো জমি বেচা-কেনা হয়, তাইলে ওই জমি দশ বছর আগের সিলপিকার দিয়া বেচা-কেনা হইবে।
মানে, বর্তমান দাম পাবার নন?
(দর্শক-১)
না। মুই যদি একখান জমি এক নাখ ট্যাকা দিয়া কিনি দুই নাখ ট্যাকা দলিল করং তাইলে দুই নাখ ট্যাকার করসত মুই পাইম। আর যদি এক নাখ ট্যাকা দিয়া কিনি আশি হাজার ট্যাকা দলিল করং, আশি হাজার ট্যাকার ফল পাইম। ট্যাকা নিয়া কায়ো এদিক-সেদিক গেইছে, আড়াই-দুই বিঘা কিনছে। মোর জমি আছিল দ্যাড় একর। হামরা চাইর বোন, দুই ভাই। বোনেরঘরক ট্যাকা দিছি আট শ’ করি। ৩২ শ’ ট্যাকা শ্যাষ। ট্যাকা পাছনো ১৮ হাজার। ফাইভ পারসেন্ট ট্যাকা গেইছে মোর খরচা। খাজনা-খারিজে ২ হাজার চলি গেইল। দুই-তিনদিন ভরতুক দেওয়ানির খরচা-খরচ। ট্যাকা তুইলবার যায়া মোট খরচ হইছে তখনকার সময়ে ৩৮ শ’ ট্যাকা। অটে গেইল ৩২ শ’, এটে গেইল ৩৮ শ’। দুই ভাই, শোয়ার জাগা করছে, মোর মরার জাগাও নাই। ব্যারেজ হওয়ার পর কিছু জমি আছিলো, সরকারের কোনো কামে নাগে নাই। শেখ হাসিনা যখন পরথম প্রধানমন্ত্রি হইলেন, তখন আসি দেখনেন হামার সোগে ভাঙি গেইছে। হামরা পানিত হাবুডুবু খাবার নাগছি। হামাক কইল ওই জাগাত বাড়ি কইরবার জন্যে। ওইটা পানি উন্নয়নের জমিন। পানি উন্নয়নের কোনো কামত নাগে না, হামরা অটে বাড়ি করনো। কইনেন, ‘তোমরা বাড়ি কইরা আপাতত রেস্ট নাও।’ অ্যালাও য়েস্টেই আছি। ওই জমি কোন কোম্পানি নাকি নিবে। খুটি পোতাইছে? কি নাকি বানাইবে।
দর্শক-২
শুনছং, ওই জমিনত নাকি পুলিশ ক্যাম্প করবে।
দর্শক-১
করুক! এই ভিটাত হামার পুরান গাছ-গাছালি আছে। ছাওয়ার মতো করি গাছগুইলাক বড় করছি। চ্যাংরাগুইলা বাইরে ফলনা করি টইসকা করি খাবার নাগছে। এই জমিখান হামাক দিলে তো হয়। প্যান্ট পিন্দি আসি ওমরা হামার গোয়ার ফুটা দেখে। জনগণ যদি না থাকে সরকার থাকি লাভটা কি? কি বাজান? য়েলগাড়ি যদি না থাকে তুমি কোথা দিয়া আসবা? য়েলগাড়ি তোমার দরকার। য়েলও দরকার। আর যাত্রীও দরকার। যাত্রী না হইলে আমি কীভাবে যাবো? যাত্রীই তো আসল। অ্যাট থাকি হামাক তুলি দিলে হামরা কুটে যামো? হামরা কি দেশের নাগরিক নোয়ায়?
দর্শক-৩
মোর ট্যাকাটা অ্যালাও ক্লিয়ার করে নাই। ট্যাকা দিবার চায়াও দ্যায় নাই। ৪৬-৪৭ শতক জমির ট্যাকা অ্যালাও পাং নাই। বিরিজের পাড়ত অ্যাকনা দোকান দেখছেন না, অ্যালা ওই দোকানের উপরতেই সংসার চলে। চিনি, কলা, বিড়ি, চা এইগল্যা বেচং। মেম্বারক দশ ট্যাকার চাউলের একখান কাড দিবার কইছোং। কই, দেইল না। অমজানত বড় কাড আসছে। ওইটাও দেইল না। ওযা আসছে অ্যাকনা মসুরির ডাউল পাক করি খাছি। ইফতারত অ্যাক পোয়া চিড়া ভিজি আখি দোকানত কলা আছিল, মাখি খাইছং। আল্লা যে কয়দিন হায়াৎ দিছে ওই কয়দিন তো কাম করি খাওয়া নাগবেয়ে।
দর্শক-৪
৩০-৪০ ট্যাকা হাজির্যায় ব্যারেজত কাম করছি। ঘাস নাগাইছি দিনমনে। মনে করছিনো ব্যারেজ হইলে সুখ আসপে, কই আসিল? আগত যে কষ্ট আছিল, অ্যালাও অই কষ্টয়ে।
০৭.
শাহরিয়ার, তারপর সাইতুনের কি হলো?
মিলি, আমি যার কাছ থেকে সাইতুন সম্পর্কে জেনেছি তার কণ্ঠেই শোনো। রেকর্ড অন করলাম:
সাইতুনের কাছত জাইনবার চাছনু ঢাকা শহরত কেমন করি আসছিস? কয়, সমীরণ আপা, আছলাম টাপুর চরো। রোযার ইদের পনরো দিন আগে পানি ডুকলো, হেই পানি আর বারোয় না। এইনদা-ওইনদা বাঙা শুরু অইলো। জাগায় জাগায় গাতা অইয়া খুইড়া গেলো। নিচদা মাডি নামতে থাহে। খাড়োইয়া খায়ুন লাগছে। এত পানি! আমরা অ্যার মইধ্যেই জানটা আতো লইয়া আছলাম। বইয়া থাকতে থাকতে দেখলাম গরের মাইজ্জাল খুইল্লা যাইতাছে। গর ডাইব্বা যাইবার লইলে নাউ বাড়া হইরা গর টানো আনলাম। নাউ বাড়া লাগলো ছয় আজার ট্যাহা। নাউয়ো অ্যাকটা গরই আনুন যায়। আর একটা জিনিসও আনবার পাইছি না। কত কিছু যে আনবার বাহি আছিন। দারের মদ্দে জিনিস কি তুলুন যায়? আত থাইক্কা পিছলায়া গ্যালেই ওইডা আর পায়ুন গেছে না। মানুষসহ পইরা গেছে। অদ্দেক জিনিস আনবার পাইছি, অদ্দেক পানিত বাইস্যা গেছে। পাইল্লা-ডহি আনবার পাইলেও আস-মুরগি আনবার পাইছি না। কত্তুগুলা দরবার পাইছি, কত্তুগুলা উড়াল দ্যা পানিত পড়ছে। গরু-ছাগল চোক্ষের সামনো বাইস্যা গেলো। পানির বিতরে কতক্ষণ আর খাড়োইয়া থাহুন যায়? মরছে কত্তুগুলা। খুব জড়-জাপ্টা গেছে আঙ্গোর উপর দ্যা। আঙ্গোর জীবনো এইডাই পরথম। বান কিরুম অয়। কিরুম হইরা বাঙে, এইবার দেখলাম। পানি এইনদ্যা ঠ্যালা দিছে ওইনদ্যা কাছারিত গেছে। ওইনদ্যা কাছারিত ঠেলা দিছে এইনদ্যা কাছারিত আইছে। আঙ্গোর দ্যাশো শান্তি জিনিসটা নাই। চেষ্টা হরলো ময়নুল। রাস্তাডা যদি অয় তাইলে আবার যাইবার পায়াম। এই আশায় কত দিন কাডাইলাম। বান আইলে বাল-বাচ্চা লইয়্যা কি সমস্যা। বাচ্চাগরে পানির বিতরেই আগান, মুতান লাগছে। দইরা থাহুন লাগছে। চহির উপরে বওয়ায়া বাচ্চার জাগাডা দিয়ুন লাগছে। এইরহম বিপদ আইছিন। বুহের উপরে পানি উঠছিন। হুদা চিড়া পানির মইধ্যে বিজায়া খাইছি। ছুডুবেলা দেখছি, সহালে পানি আইলে বৈহালে নাইম্মা গেছে। পানি আঙ্গোর বাড়ির চাইরেবুগুলো আছিন, কিন্তু বাড়িত উঠছে না। চিল্লাচিল্লি, কান্দাকান্দি হইরা আওয়া মানুষ আমি কুনুদিন দেহি নাই। একবার নাউয়ো চইড়া কত লা ইলাহা কয়ুন লাগছে। আল্লারে কত কত ডাহুন লাগছে। যে দার আছিন ওইদারো নাউ আনুন যায়? গর আনুন যায়? এই নদীত নাউ কুনু সময়ের লাইগ্যা পাহো পরে নাই, হেই নাউ পাহো পরছে। কত খুডি-মুডি দ্যা নাউ আটকান লাগছে। নাউ আটক অইবারই চায় না। মানুষের লাইগ্যা আমরা গর আনবার পাই না। বাপরে বাপ মানুষ! আঙ্গোর আছিন দুঃখু, আর মাইনষের আছিন সুখ। কেউ আয়া কান্দে। কতজুন আয়া আঙ্গোর বৃক্ষপাতা দেইহা দুঃখী অয়া কত কিছু দ্যা গেছে। কতজুন আঙ্গোর এইত্তা দেইখ্যা আইস্যা উড়ায়া দিছে। হেরা সুখী। আমরা দুঃখে পইড়া গেছি। কিন্তু যারা দুঃখুর মর্যাদা হরছে, তারা বুঝে দুঃখু কি জিনিস। যারা মর্যাদা হরছে না, তারা বুজে নাই দুঃখু কি। তারা মনে হরছে আঙ্গোর যেদুন সুখ, তাগোরও হেদুন সুখ। আপা কইন, কেউ কুনুদিন নিজেরগর জমা-জমি ফালায়া অ্যাক দ্যাশ থাইহা আরেক দ্যাশো আয়ে?
মুই কনু, হয় রে সাইতুন, তা কি আর আইসে! অয় আবার কওয়া শুরু করিল।
আপা, বানডা অ্যাতো অইতো না। নদীডা তো ম্যালা বড় অইয়া আয়ে। আইতে আইতে ব্যারেজো চিপায়া যায়। এত বড় নদী মাত্র ৪৪ গেডো আটকায়া রাখছে। অ্যাতো পানি কি আর ওইনো আটকায়া রাহুন যায়? উজানো পানি ফিইক্যা উডে। উঠতে উঠতে আঙ্গোর গরো হান্দাইলো। এই যে হান্দাইলো আর বাইর অয় না। কমেও না। ইটটু কমলে আরেকটু বাড়ে। থমথমা পানি। লাগাতার পানি আছিন পনরো-বিশ দিন। বানের সময় বইনের জামাইয়ের বাইত আছলাম। আঙ্গোর বাড়ির লগেই অগোর বাড়ি। আঙ্গোর নিয়ম আছে, চরের ছেরি চরেই নেয়। চরে যারা আছে কেউ কইবার পাইতো না যে শান্তিত আছিলাম। নদী তো খালি দিনেই বাঙে না, রাইতেও বাঙে। বাদাম, মইচ, তরমুজ আবাদ হরছিলাম। সব ডুইব্যা গেলো। সব আরায়া ঠাই পাইলাম খাস জমিন সিলটাপো। নিজেগর জমিন থাইহাও হোহির সাজুন লাগছে। অ্যাহন সরহার থাকপার দিছে আমরা আছি। কবে কইবো যাও গা। যাওন লাগবো গা। যুদি আজকা তুইল্যা দেয়, তাইলে কই যায়াম, কই না যায়াম? নিজের প্যাটটা চালায়াম, না বাড়ি-গর হরাম? না জাগা-জমিন হরাম? বিরিজ থাইহ্যা এইবা-ওইবা তাহাইলে বুজা যায় কত জমি নষ্ট। আমরা যে এইনো গর খাড়া হরছি, হেইডা কি সহজে হরবার পাইছি? পাই নাই। পুরান বিডার মানুষ একটা খুডিও গারবার দিছে না। ময়নুল সামনে খাড়া। একটা মিসকল দেওয়ার লগে লগে ব্যাক হরছে। ম্যাগ থাক, তুফান থাক, অয় হাজির আছিন। অয় না থাকলে গর খাড়াই হরবার পাইতাম না। পাওঅ গাও অইছিন। গাও লইয়াই তিনদিনবরা বালুর মইধ্যে আডছি। বানের সময় অ্যাকদিন রাইন্ধা তিনদিন-চাইরদিন খাইছি। আমরা পিছাই, নদী আঙ্গোয়াইতে থাহে। নদী একটু বাঙে, বাড়িও একটু পিছাই। আরেকটু বাঙে আবার পিছাই। পিছাইতে পিছাইতে অ্যাহন সিলটাপো।
চলবে…
তিস্তা: পর্ব-১॥ হারুন পাশা