॥পর্ব-১॥
মিলি, ব্যারেজের উজান এবং ভাটিতে তাকাও, দেখ বালুতে রোদ পড়ে কেমন চিকচিক করছে।
হুম, নদীতে পানির বদলে বালুর আয়োজন। তিস্তার অবস্থা যে এমন হতে পারে ব্যারেজ তৈরির সময় হয়তো কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। তুমি কি বলো শাহরিয়ার?
পরিকল্পনা নেওয়ার সময় ভেবেছিল নদী ও মানুষের উপকার হবে। আব্বুর কাছে শুনেছি তিস্তা সেচ প্রকল্প হয়েছে যাতে আবাদের উন্নতি হয়। বেকার মানুষ কাজ পায়। বিধবা আর যাদের জমি নাই তারা যাতে কাজ করে খেতে পায়। ব্যারেজ তৈরির সময় সাময়িকভাবে কাজও পেয়েছিল। এখন অনেকেই কর্মহীন। পানি না পাওয়ার কারণে কৃষির উন্নয়ন বাড়ছে না। ব্যারেজের আশেপাশে বসবাস করা মানুষ তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। তিস্তা এখন নদী নয়, হয়েছে খাল। মিলি, ব্যারেজে আসার সময় তোমার কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
না। ব্যারেজেই হাঁটবে না অন্য কোথাও যাবে?
দোয়ানি বাজারে যাওয়া যেতে পারে।
ঠিক আছে। চলো, আমরা আগাই।
০২ .
শাহরিয়ার, এটাই দোয়ানি বাজার?
হুম।
বাজারটা তো বেশ বড়, তাই না?
বড় হওয়ার কারণও আছে। এখানে ব্যারেজের আশেপাশের মানুষ ছাড়াও চর থেকে অনেকেই আসে। কেনাই যে তাদের লক্ষ্য তা কিন্তু নয়। নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত জিনিসও বিক্রি করতে আসে। সংসারের প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এখানে পাওয়া যায়।
শাহরিয়ার, দ্যাখো বাজারের এক পাশে অনেক মানুষ। কিছু হয়েছে? যাবে ওদিকটায়?
চলো যাই।
লোকটা কি যেন বলছে।
মিলি, চলো আমরাও দর্শক হয়ে যাই; শুনি কী বলতে চাচ্ছেন।
চলো ওই ফাঁকাটায় বসি।
হামরা যে ব্যারেজ দিয়া চলাচল করি ইয়ার হেস্টোরি কবার পাইমেন কায়ো?
না, না ভাই, তোমরা কন। (দর্শকের সম্মিলিত স্বর)
শোনেন, এই এলাকাটায় খরা বেশি বলি বিটিশ সরকার ভাবিল হামাক ভিজি থুইবে সব সময়। যাতে করি গোটা অংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া জেলার অনাবাদী ভুইয়ত সেচ সুবিধা দিয়া আবাদ বাড়া যায়। এইজন্যে ১৯৩৭ সালত ওমরা পরিকল্পনা নেইল যে, এ্যাটে ব্যারেজ করবে, কিন্তু হইল না। ইয়ার পর ’৪৫ সালত কইরবার চাইল, হইল না। ’৪৭ সালত ভারত আর পাকিস্তান ভাঙি গেইল, ওই সময় ওমরা কইল হামরা দুই দেশ দুইটা পরিকল্পনা নেমো আর বাস্তবায়ন করমো; কইরবার পাইল না। ’৫৩ সালত, ভাষা সংগ্রামের পরের বছরত, আরো শক্ত করি পরিকল্পনা নেইল, এবারো কাম হইল না। ’৫৭ সালত আবার পরিকল্পনা করিল, হইল না। ’৬০ সালত এইটা নিয়া পরথম সম্ভাবনা সমীক্ষা যাচাই হয়। ’৬৯ থাকি ’৭০ সালত সমীক্ষা শ্যাষ হইলে ইপোর্ট জমা হয়, এবারো কাম হইল না। পাকিস্তানিঘর হামার দেশত ম্যালা আউলা-ঝাউলা বাজাইল, বাতিল হইল। তারপর ১৯৭৯ সালত আষ্ট্রপতি জিয়াউর অহমান তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করি গেইল। কাম শুরু হইল তিস্তা নদীর উপরত ৬১৫ মিটার নম্বা তিস্তা ব্যারেজ, নালমনিরহাট আর নীলফামারী সিমান্তত। ট্যাকা-পয়সা দেইল সৌদি উন্নয়ন তহবিল, ইসলামিক ডেভেল্যাপম্যান্ট আর আবুধাবি উন্নয়ন তহবিল। এই ট্যাকায় তিস্তা ব্যারেজসহ সেচযোগ্য আবাদি জমি আর জলকাঠামো তৈয়র করিল। কাম শ্যাষ হইল ১৯৯০ সালত। ’৯০ এর ৫ আগস্ট উদ্বোধন করিল আষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ। বাইপাস ক্যানেলের উপরত তৈয়র হওয়া গেটমিলি ব্যারেজের গেট হইল ৫২খান। কয়টা গেট হইল?
৫২খান। (দর্শকের সম্মিলিত স্বর)
ইয়ার মাঝত ৪৪খান হইল য়েডিয়াল গেট। ব্যারেজত থাকিল ১১০ খান ক্যানেল হেড য়েগুলেটর, ৭০৮ কিলোমিটার সেচ খাল, ৩৮০ কিলোমিটার সেচ নালা, আর ৮০ কিলোমিটার বান আটকাবার আস্তা। ব্যারেজের কাম শুরু হয় দুইটা পর্যায়ত। তিস্তা ব্যারেজের কাম যেইটা উদ্বোধন হয় ১৯৯০ সালত, ওইটা আবারো সংস্কার হয় ’৯৩ সালত। ’৯৮ সালত পরথম পর্যায় শ্যাষ হয়। পরথম পর্যায়ত তৈয়র করে ৩০৭ কিলোমিটার আসল সেচ খাল, ১৪৫০ কিলোমিটার দ্বিতীয় আবর্তের খাল। ২৩৫ কিলোমিটার তৃতীয় আবর্তের খাল, ৮ হাজার ফিলড আউটলেট। পরথম পর্যায়ত প্রকল্প ১ নাখ ১১ হাজার ৪০৬ হেক্টর ভুই বষ্যাকালসহ সেচ সুবিধায় নিয়া আইসে। ক্যানেল থাকি ভুইয়ত পানি যাওয়ার ব্যবস্থা কি, কবার পান?
ক্যা কবার পাবার নই। হামরা তো ম্যালাদিন আবাদ করছি ক্যানেলের পানি দিয়া। পানি মেইন ক্যানেল থাকি শাখাক্যানেলত যাইবে। মেইন ক্যানেলত যেইদোন চাকা আছে, ওইদোন শাখা ক্যানেলতও আছে। দরকার হইলে ক্যানেলের চাকা তুলি দিয়া পানি নিবে। তখন পানি সারাবাড়ি যাইবে। (দর্শক-১)
ভালো। হামরা জানি, এই ব্যারেজ পানির মাঝত হয় নাই, হইছে শুক্যানোত। এ্যাটে গ্রাম আছিল। গ্রামের নাম তোমরা কায়ো কবার পাইমেন?
হয়, পামো। এ্যাটে আছিল দোয়ানি গ্রাম। (সম্মিলিত স্বর)
সাব্বাশ। এই জমি ম্যাপে পড়ি গেইল, মাটি টেস্ট করিল, দেখিল মাটি ভালো আর শক্ত, পরে বাড়ি-ঘর তুলি দিয়া ব্যারেজ করিল। মাটি কাটছে, ডাইট করছে, সিটপেন ডাবাইছে, তারপর ঢালাই করি ব্যারেজ খাঁড়া করিল। যারা এ্যাটে আছিল, তারা কোটে গেইছে?
কারো বাইরে জমিন আছিল, অটে গেইছে। আবার কারো কারো জমা-জমি নাই, পাঁচ-দশ হাজার যায় পাইছে নিয়া হাতিবান্দা, পাটগ্রাম, ডিমলা, ডালিয়া, জলঢাকায় জমিজমা কিনি চলি গেইছে। কায়ো কায়ো থাকি গেইছে ব্যারেজের আশপাশত। (দর্শক-২)
আরো যেইগল্যা জাগাত ক্যানেল হওয়ার কথা আছিল, হইছে?
যে কার্যক্রম হওয়ার কথা আছিল ওইটা হামরা কই দেইখপার পাইনো। (দর্শক-৩)
ব্যারেজটা হইল সেচ প্রকল্প, নাম তো এইট্যায় দিছে। এই ক্যানেল যেমন করি আছে ইয়ার বাইরেও হাতিবান্দা, তুষভা-ার এলাকায় ক্যানেল হওয়ার কথা আছিল, হয় নাই। ম্যাপ থাকি কাটি দিছে। ওদি যে ক্যানেল করছে, ভারত পানি না দিলে পানির অভাবত থাকা নাগে। (দর্শক-৪)
দোয়ানিত আবাদ হয়? পানি পান?
এ্যালা এটে আবাদ হয় না, যেটে ক্যানেল আছে সেজেনের সময় পানি আইসে না। (দর্শক-৫)
ব্যারেজে সমস্যা হইছে তাইলে?
ব্যারেজ হওয়াতে হামার এ জাগাত সমস্যায়ে। বষ্যায় পানি আটকি থাকে। বান হয়। বাড়িঘর সোগে তলে যায়। ব্যারেজ যদি এটে না হইল হয়, তাইলে পাচ-সাত হাজার পরিবার ধ্বংস হইল না হয়। ভারত এইদোন সময় পানি ছাড়ে তখন হামার এ্যাটেও উপচিপড়া পানি থাকে। ব্যারেজ কুলাবার না পাইলে পানি এদি-ওদি বেরে যায়। (দর্শক-৬)
এই যে দোয়ানি বাজারটা; বাজারটায় হামরা ক্ষতিগ্রস্ত। বাজারের নামে জমিন আছিল অটে, জমিনের ট্যাকাটা হামরা এ্যালাও ভূমি অফিস থাকি তুলি নাই। বাজারটা পানি উন্নয়ন বোডের জমির উপরত। ওমরা দেখিল বাজারটা যাইবে কোটে, তায় এ্যাটে দেইল। মাঝত মাঝত দেখা যায়, ওমরা বাজার ভাঙি দিবার নাগছে। হামরা থাইকপার পাই না, সুবিধা হামার এ্যাটেও নাই। ব্যারেজের আশপাশত হামরা যারা আছি অবস্থা সুবিধাজনক নোয়ায়। (দর্শক-৭)
যদি তিস্তা ব্যারেজ না করিল হয় তাইলে হামার জমি-জমা ভাঙিল না হয়। ভাঙলেও একবার ভাঙি আরেকবার উঠিল হয়। নদী এইপার থাকি ওইপার যাইল হয়, এইপার আসিল হয়। ব্যারেজ হওয়ার আগত ম্যালা পানি আছিল। নদী ভরি থাকছিল সব সময়। এইবার আষাঢ় মাস আসিল তাও নদী শুক্যান। কালে কালে হয়তো নদী এটে থাইকপারে নয়। সারা বছর কম পানি থাকলেও এইদোন শুক্যান আছিল না। (দর্শক-৮)
ব্যারেজ হামার জন্যে যম। (দর্শক-৯)
ক্যামন করি?
মোর পাচ পাইসা উপকার হয় নাই। দুই এ্যাক শতক যা আছিলো ব্যারেজে নিয়া গেইছে। এ্যালা এ্যাটে থাইকপারও দেয় না। (দর্শক-৯)
এ্যাটে যুক্তি আছে। হামার পাচ হাজার পরিবারের অসুবিধা হইলেও যাতে নাখ নাখ পরিবার উপকার পায় ওইজন্যে হামরা জমি দিছি। (দর্শক-১০)
এইজন্যে মুই এ্যালা দুই শতক ভুইয়ত ঘর তুলি আছং। নাখ নাখ মানুষ বাচপার যায়া হামরা হাজার হাজার মানুষ আছি বেকায়দায়। (দর্শক-৯)
এইগল্যা কথা কয়া নাভ নাই। হামার উচিত আছিলো ট্যাকা পাইসা পাওয়ার পর এ্যাট থাকি সরি যাওয়া। ব্যারেজের আশপাশত থাকি হামরা ভুল করছি। ওমার যদি প্রয়োজন হয় তাইলে বাজার এ্যালায় ভাঙি দিবার পারে। কারণ জমিনটা ওমার। (দর্শক-১০)
কাম কইরবার সময় কইছে, সরকারি কাম হইবে; দেশের স্বার্থে কাম হইবে; হামারও একটা সুবিধা আসপে। এ্যালা কোনো সুখ-সুবিধায়ে পাবার নাগছি না। পানিও পাই না। থাইকপারও পাই না। (দর্শক-১১)
ওমার কথা আছিল পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে, কথা কামত য়ুপ পায় নাই। হামরা এইটা কবার পারি। ওমার জমিনের উপর হামরা কিছু কইরবার পাবার নই। সরকারের জমিন, মোক এ্যালা যদি কয় এই ঘরটা ভাঙি ফেলা নাগবে। মোক ভাঙি ফেলা নাগবে। ওমাক দোষ দিবার পাবার নই। (দর্শক-১২)
হামরা জমি ছাইড়বার চাই নাই। ডিসি সাব কইলেন, ‘আপনাদের ব্যবস্থা করবো। আমরা একটা কিছু করবো।’ সম্পত্তি গেইল, হামরা ভোগ করি শান্তি পাবার নাগছি না। হামরা সচিবালয় যায়া বিচার দেমো, এই ক্ষ্যামতাও তো নাই। (দর্শক-১৩)
ব্যারেজের কাম শুরু কইরবার সময় তোমরা ডিসিসাইবক কইনেন, এ্যাতো বড় সম্পদ দিয়া, সাড়ে সাত শ’ বাড়ি উঠায়া নিয়া হামরা কুটে যামো? তখন ডিসি সাব জবাব দিনেন, ‘আপনারা কাজ করতে দেন দেশের স্বার্থে। আপনাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। যেখানে সরকারের বৃহত্তর সম্পদ আছে, সেখানে আপনাদের নিয়া যাবো।’ এ ভরসায় তোমরা দেশের স্বার্থে ভুই ছাড়ি দিনেন। কায়ো যদি কয়, ‘একটা কিছু কইরা দিবো, আমার সাথে একমত থাকো। অনেক ভালো হবে।’ ওই সাব ঢাকা চলি গেইল, আর আসিল না, তোমার কি করার থাকে? বিষয়টা এইদোন। (দর্শক-১৪)
যখন পুনর্বাসন কইরবার চায়া বাস্তবায়ন করিল না, তোমরা কিছু কন নাই?
না। (দর্শক-১৫)
আন্দোলনও করেন নাই?
না। না। আন্দোলন করি নাই। যেইটা করি নাই ওইটা কয়া নাভ নাই। এই জন্যে এ্যালা এইদোন পরিস্থিতি হইছে। (দর্শক-১৬)
নিরীহ থাকিয়ায় আইজক্যা বাড়ি যাও। ম্যালা আইত হয়া গেইছে। আরেক হাটত আবার আলাপ হইবে।
আহসান ভাই, কেমন আছো?
শাহরিয়ার তুই এখানে? কি উদ্দেশ্যে?
উদ্দেশ্য নিশ্চয় আছে। বলছি। আলাপ করিয়ে দেই। ওর নাম মিলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়ছে। আমার ভালো বন্ধু।
আসসালামু আলাইকুম ভাই।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছো?
জ্বী। আপনি?
এই আছি। চলো আমরা চা খেতে খেতে কথা বলি।
দাদা, এটা মন্দ হয় না।
খলিল চা, ইপাকে তিইনটা দুদ চা দ্যাও। শাহরিয়ার কী যেন উদ্দেশ্য আছে বলছিলি?
আমি পিএইচডি করছি ‘পানি সংকট ও তিস্তাবাসীর বিপর্যস্ত জীবন’ শিরোনামে।
তুই তো খুব ভালো বিষয় নির্বাচন করেছিস।
ভাইটা যে তোমার, সে কি আর মন্দ বিষয়ে কাজ করতে পারে! এজন্য কিন্তু তোমার সহযোগিতা খুব বেশি দরকার।
কোনো অসুবিধা তো দেখছি না। সহযোগিতা পাবি।
ইতোমধ্যে তুমি কিছু সহযোগিতা করে ফেলেছো।
কিভাবে?
তোমার আলোচনা থেকে ব্যারেজ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেলাম।
আচ্ছা! তুই যে কয়দিন থাকিস, আসিস হাটের দিন। কেবল আমার আলাপ শোনার জন্য যে তোকে আসতে বলছি তা নয়। এ দিনে এখানে সব স্থান থেকে মানুষ আসে। তাদের সঙ্গে কথা বললে আশা করি দরকারি তথ্য পেয়ে যাবি।
দাদা, আমি অবশ্যই আসবো। তুমি ভালো থেকো! আজ তাহলে আমরা আসি।
ঠিক আছে।
০৩.
শাহরিয়ার, আমরা সেদিন বাজারে যার সঙ্গে আলাপ করলাম; তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে, জানাবে?
মিলি, অবশ্যই জানাবো।
তাহলে বলো।
তার পুরো নাম রিয়াজুল আহসান। তার অনেক সম্পত্তি ছিল। সব হারিয়ে সে এখন সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করে অর্থ সঞ্চয় করে। আর বাকি দুই দিন দোয়ানি বাজারে আয়োজন করে আগত লোকদের সঙ্গে কথা বলে। পাঁচ দিনে যা আয় করলো, তার কিছু অংশ খরচ করে আলাপে অংশ নেওয়া দর্শকদের জন্য। তিনি তাদের নাস্তা খাওয়ান। নাস্তা খাওয়ানোর কারণ হলো, যেন মানুষ বেশি হয়। বেশি মানুষের কাছে তার কথা পৌঁছায়। এখন তো মানুষকে জড়ো করা কিংবা একটি আলোচনায় দর্শক হিসেবে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সবাই যার যার ব্যস্ততা নিয়ে আছে। আবার অনেকেই অযথা সময় কাটাবে, কিন্তু আলোচনা শুনবে না। অন্যের কথা শোনার মতো ধৈর্য কিংবা মন-মানসিকতা রাখে না। মিলি, তোমার মনে প্রশ্ন আসতে পারে তিনি দর্শকদের অনেক ইনফরমেশন দিয়ে থাকেন, এগুলো তিনি পেয়েছেন কোথায়?
হুম, সেদিন তার কথা শোনার পর প্রশ্ন তো জাগেই। বলো এ বিষয়ে।
তিনি ব্যারেজ, চুক্তি সম্পর্কে দেশ ও দেশের বাইরের পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, ব্লগ, বই পড়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যেন দর্শকরা সঠিক তথ্য পায়। সেগুলোই না কি তিনি বলবেন একেকদিন।
একথা তুমি জানলে কেমন করে?
সেদিন রাতে তার সঙ্গে আরও আলাপ হয়েছিল, সেই আলাপ থেকেই জেনেছি।
তার আগের জীবন সম্পর্কে নিশ্চয় জানো?
জানি। ছোটবেলা থেকেই তো তাকে আমি চিনি। অনেক কথাই জানি। ওই সময় দেখেছি আহসান ভাই অন্যের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতো। এ কাজেই সে সুখ খুঁজে পেত। আমরা প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় তিস্তা নদীতে যেতাম। সময়ের কথা বললে ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে। গিয়ে দেখতাম নদী ভাঙা মানুষদের খাদ্যের ব্যবস্থা করছে, ছাপরা তুলে দিচ্ছে। তুমি বলতে পারো বিনিময়ে সে কি পাচ্ছে? সরাসরি উত্তরে বলা যায় সে তেমন কিছুই পাচ্ছে না। সে যা পাচ্ছে হয়তো তার অর্থমূল্য নেই কিন্তু মানবিক মূল্য আছে। সে পাচ্ছে বিপদগ্রস্তের সেবা করার আনন্দ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়াতে বিজয় দিবসে নাটকের আয়োজন করতো। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে তার বন্ধু এবং ছোটদের নিয়ে নাটকের রিহার্সেল করতো। নিজের খরচেই সে এ নাটক মঞ্চায়ন করতো। বাঁশ ও কাঁঠ দিয়ে বন্দুক তৈরি করতো। আমাদের স্কুলে একটি কদম গাছ ছিল তার নিচেই নাটকটি মঞ্চস্থ হতো। গ্রামের প্রায় সবাই যেতো, আমরাও যেতাম। আহসান ভাই পাকসেনার চরিত্রে অভিনয় করেতো। এ চরিত্রে অভিনয়ের কারণ হলো ঠিকঠাকভাবে উপস্থিত সবাই যেন বুঝতে পারে, পাকসেনাদের বীভৎস কর্মের কথা। অন্য কেউ অভিনয় করলে যদি ভুল-ভাল কিছু প্রদর্শন করে, এটা এড়াতেই সে এ চরিত্র বেছে নিতো। তাদের অভিনয় দেখে কষ্ট পেতাম। নাটকের রেশ আমরা কয়েকদিন ধরেই মস্তিষ্কে বয়ে বেড়াতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বই কিনতে হিসেবের থেকে বেশি টাকা লাগলে পূরণের জন্য তাকে ফোন দিতাম। ফোন রাখার অল্প কিছু সময় পরেই দেখতাম তিনি টাকা পাঠিয়েছেন। পরে বাসা থেকে টাকা আসলে তাকে ফেরত দিতাম। তখন তো তিনি ব্যাংকের বড় পোস্টে চাকরি করতেন। সংস্কৃতিমনা আর পরোপকারী মন তো, শহর তাকে বেশিদিন ধরে রাখতে পায়নি; গ্রামে ফিরলেন। তিনি ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার তাগাদা অনুভব করতেন। প্রতিষ্ঠা করেন ভাওয়াইয়া গানের দল। তারপর তার জীবনে ঘটে বেদনার অধ্যায়।
কেমন সেই অধ্যায়?
মিলি, এ বিষয়ে পরে একদিন বলব। আজ বরং মোখলেস ও আইনুদ্দিন চাচার জীবন-অধ্যায় শোনো।
০৪.
চাচা, ও আইনুদ্দিন চা, কুটে যান?
কায় বাহে?
মুই মোখলেস।
ও। চোখে এ্যাকনা কম দেখোং। বয়স হইছে জানিস তো। ক, কি জন্যে ডাইকপার নাগছিস?
দামি কিছু নোয়ায়, তোমাক দেখনু যাবার নাগছেন, তাই ভাবনু এ্যাকনা কথা কং। হাটত যাবার নাগছেন?
যাং, এ্যাকনা হাঁটি বেড়ে আইসং, বাড়িত বসি থাকি কি করং।
চাচা, গাছের ছায়াত বইসেন।
ই গাছটার যত বয়স, তোর বয়সও তত। তুই যেদিন জন্মিলু, সেদিন তোর বাপে এ্যাটে গাছটা নাগায়। এ্যালা তো গাছে নাই। খালি কাটে আর কাটে। নাগাবার নাম নাই। যাও নাগায় তাও আবার ইউকিলেকটার। কয়দিন গেইলে ট্যাকা আসপে, এই চিইন্তাত সবায় বাঁচি থাকে। এবার আবাদ-সাবাদ করলু কিছু?
বাহে, আবাদ করা আর না করা এ্যাকে কতা। ক্যানলত পানি থাকে না, স্যালোর পানিত আবাদ করা নাগে। খালি পাইসা খরচ।
হয় রে মোখলেস, এইদোন হইলে কী আর আবাদ করা যায়? পানিয়ে নাই।
চাচা, আগত ষোল সতের ফিট বডিং করলেই পানি পাছনো। এ্যালা পানি যে কোটে সোন্দাইছে, উইয়ার টিকিখানও না দেখা যায়। আগত ভুইয়ের আবাদ বাড়িত আনতে একবার-দুইবার পানি দিলেই হইছে। অট্টে আইজো পানি দেও, কাইলো পানি দেও। হামার কি সেই ক্ষ্যামতা আছে, কন তো। চাউল কেনা নাগে, নুন কেনা নাগে, এইগল্যা করতে তো পকেটে কুলায় না, ধার-করজ করা নাগে। ভুইয়ত ঘন ঘন পানি ক্যামন করি দেও, কন তো?
একঘণ্টা পানি দিলে ট্যাকা নাগে একশ পঞ্চাশ। এক বিঘা ভিজাইলে নাগে চাইর ঘণ্টা। তাইলে কত ট্যাকা নাগে একবার ভিজাইলে? নাগে ছয় শ’ ট্যাকা। আট থাকি দশবার পানি দিলে কত নাগবে?
চাচা, তাইলে আটবারে আটচল্লিশ; দশবারে ছয় হাজার ট্যাকা নাগবে।
মোখলেস, এ্যালা যে উঠা নাগে, শ্যাষবেলা পড়ি গেইছে। দোয়ানির বাজার থাকি তো আবার আসা নাগবে। তুই বাড়িত আসিস কথা কওয়া যাইবে। মুই হাঁইটপার ধরং।
ঠিক আছে চাচা, তোমরা আগান। সময় করি যাইম তোমার বাড়ি।
চলবে…