[পর্ব-৮]
সব ছবির মত সুলতানকে নিয়ে তৈরি ছবিরো একটা ফ্রেম ওয়ার্ক ছিল। তবে সুলতান ক্যামেরার সামনে কিছুতেই আসতে রাজি হতেন না। শেষ পর্যন্ত যে শর্তে তিনি রাজি হলেন, তা হলো, তিনি যেন ছবির প্রধান বিষয়বস্তু না হন। তিনি বললেন, ‘আমি বরঞ্চ নিমিত্ত, আমাকে উপলক্ষ করে আপনারা বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান। আমি আপনাদের মঙ্গে ক্যাটালিস্ট হয়ে থাকব। তাঁর এই নির্দেশনা তারেকদের জন্য এক পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। তারা সিদ্ধান্ত নেন, সুলতানের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবেন এবং গ্রাম বাংলাকে দেখবেন। ফলে যেখানেই তারা যাচ্ছেন সবই প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। সবই তারা ধারণ করছেন ক্যামেরায়। যদিও চূড়ান্ত পর্যায়ে ছবিটায় এত বেশি লোকসংস্কৃতি রাখা হয়নি। তারেক মাসুদ বলেন, ‘এই ছবির উপস্থাপনায় আমাদের প্রাইমারি ধারণা ছিল—সুলতানের সকাল, দুপুর, রাত আর বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষিজীবন উঠে আসবে। শ্যুটিং করার সময় আমাদের স্ক্রিপ্ট এত উদার বা লুজ ছিল যে, অনেক কিছুই আনপ্রাকটিক্যাল, কিছুটা খামখেয়ালি ছিল। এই খামখেয়ালির জন্যই ছবিটা অনেক বেশি এক্সপেনসিভ ও দীর্ঘমেয়াদি হতে লাগলো।’
তারেক মাসুদ ৮২ সালে সুলতানের ওপর শ্যুটিং শুরু করার পর মোরশেদুল ইসলাম ‘আগামী’ ও তানভীর মোকাম্মেল ‘হুলিয়া’র কাজ শুরু করলেন। যথাসময়ে নির্মাণকাজ শেষ করে ছবিগুলোর প্রদর্শনও চলতে লাগল। ‘আগামী’ ১৯৮৪ সালে এবং ‘হুলিয়া’ ১৯৮৫ সালে মুক্তি পেলো। কিন্তু তারেক মাসুদের ছবি আর শেষ হচ্ছিল না। ছবি শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় তারেককে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা শুরু হলো। তখন তারেকের খুব খারাপ অবস্থা। রাতে কোথায় ঘুমাবেন, দিনে কোথায় খাবেন, তার কোনো ঠিক নেই। এমন খারাপ অবস্থায় তারেক মাসুদকে চলতে হয়েছে—তিনি ঢাকা শহরের বেশ কিছু এলাকা এড়িয়ে চলতেন। কারণ ওসব এলাকায় তার পাওনাদার ছিল। এ সবই বুঝতে পেরেছিলেন এস এম সুলতান। তিনি নিজেই ছবি নিয়ে ঠাট্টা করতেন। আবার অনেকেই ঠাট্টা করে বলতেন, এস এম সুলতান মারা যাওয়ার জন্য পরিচালক অপেক্ষা করছেন। তবে তারেক মাসুদ এই ছবিটা বানাতে গিয়ে যতই ইম-প্রাকটিক্যাল কাজ করেন না কেন, এমন এক আলোকপ্রাপ্ত মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার ও চলার ফলে তারেক মাসুদের একটা আত্ম-উন্নয়ন ঘটে।
শুধু গ্রামবাংলা নয়, শিল্প সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণাও তার মধ্যে বিকশিত হয়। তারেকের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস এবং ভেঙে না পড়ার শক্তি জন্মে। এছাড়া এসএম সুলতানের সংস্পর্শে আসার ফলে খুব দ্রুত ফিল্মমেকার হওয়া এবং নাম বা যশের পেছনে দৌড়ানোর যে মানসিকতা, সেটা থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন তারেক। তিন বছর একটা করে ছবি বানানোতে বিশ্বাসি ছিলেন না বরং তার উপলব্ধিতে যে বিষয়টি নাড়া দেয়, সেই বিষয়টির ওপর সময় নিয়ে শুদ্ধভাবে ফিল্মটি বানানোর চেষ্টা করেন। একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে তিনি নিজের মাইন্ড-সেট তৈরি করেছিলেন, যা তুলনামূলক পজিটিভ। তারেক মাসুদ আমৃত্যু পজিটিভ ছিলেন। নিজে যা বিশ্বাস করতেন তা থেকে একচুলও নড়তেন না।
যখন শিল্পী সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মানের কাজ শুরু করেন তখন অনেক গুণীজন প্রশ্ন করেছেন, জীবিত- মৃত আরও এত খ্যাতিমান শিল্পী থাকতে কেন সুলতান? অনেকটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির মতো তাকে উত্তর দিতে হয়েছে সে সবের। উত্তরও দিয়েছেন হাসিমুখে। বলেছেন, ‘সুলতানকে নিয়ে ছবি করতে চাই এ কারণে নয় যে, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। বরং এ কারণে যে, তথাকথিত উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া কৃষিপ্রধান একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সুলতানের জীবন ও কর্ম প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার কৃষক সমাজ একজন বড় শিল্পীকে মহৎ শিল্পীতে পরিণত করেছে। একজন শিল্পী তার সমাজকে বদলানোর যে ক্ষমতা রাখেন, তার চেয়ে বরং সমাজ ও সময় একজন শিল্পীকে বদলে দেওয়ার ঢের শক্তি রাখে। সুলতান তার দৃষ্টান্ত।’ ‘আদমসুরত’, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘মাটির ময়না’সহ করেছেন আরও অনেক ছবি। শুধু ছবি করেই তিনি শান্ত হননি, সে ছবি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন। আর আনন্দ পেয়েছেন নিজেকে ছবির ফরিওয়ালা বলে পরিচয় দিতে।
আরও পড়ুন: তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিঅলা-পর্ব: ৭॥ শারমিন রহমান