[পর্ব-৫:জন্ম ও শৈশব]
তারেক বিভিন্ন সময়ে ওই সময়ের মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। ওই সময় কওমি মাদ্রাসায় সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কাউকে পড়তে পাঠানো হতো না। সেখানে পাঠানো হতো গরিব ও এতিম ছেলেমেয়েদের। যাদের পড়াশুনা তো দূরের কথা, খাওয়া-পরারও কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। এমন ছেলেমেয়েদের কাছে মাদ্রাসা ছিল দুই বেলা পেট পুরে ভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা। তাই তাদের কাছে মাদ্রাসা ভালো লাগার জায়গা হলেও তারেকের কাছে তা ছিল যন্ত্রণার।
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে চারপাশে। থমথমে অবস্থা। নিরাপদ মনে না করে তারেক মাসুদকে ফিরিয়ে আনা হলো মাদ্রাসা থেকে। ওই সময় তারেকের মামা (দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, দুলু মামা) তারেকদের বাড়ি থাকতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের কিছু সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকায় প্রায়-ই অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতেন। তারেকের বাবা-মা দুজনেই তারেকের মামাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। খাবার নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। বাবা-মায়ের চিন্তিত মুখ, মামার অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা, চারপাশের থমথমে পরিবেশ ভাবিয়ে তোলে তারেকের কিশোর মনকে। নানা প্রশ্নের জন্ম হতে থাকে তার মনে। ব্যাকুল হয়ে জানতে চান মামার কাছে দেশের পরিস্থিতি, মামার কাজ, ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাগসহ অনেক কিছু। মামার সঙ্গে তারেক মাসুদের ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব। তারেকের জানার আগ্রহ দেখে খুব খুশি হন মামা। সব বিষয় খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন তাকে। এই প্রসঙ্গে মামা দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ওর অদম্য ইচ্ছা ছিল মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুল কলেজে লেখাপড়া করার। আর ইতিহাসের প্রতি ছিল তারেকের আগ্রহ ছিল খুব।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারেকের মামা তারেকদের বাড়ি থেকে যান। তারেকের পরিবারের সবাই তারেকের নানা বাড়ি চলে যায়। সেখানে তারেকের দুলু মামার বন্ধুদের একটি গ্রুপ ছিল। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন বড় আবু, তারেকের মামার বন্ধু। তারেকের নানা বাড়ির কাচারি ঘরেই তাদের ঘাঁটি ছিল। তারেক মাসুদ মামার কাছে আবদার করে বসেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকবেন। তিনি একটি রাইফেল পেতেও বায়না ধরেন। দুলু মামা তার বন্ধুদের বলে দেন, তারেক কে সঙ্গে রাখতে। মামার বন্ধুরা তখন ভাগ্নেকে ভালোবেসে দলে টেনে নেন। তখন তারেক কাঁধে রাইফেল নিয়ে কাচারির সামনে দিয়ে পাইচারী শুরু করলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ। জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। তারেক মামাকে বললেন, ‘মামা আমি তো মাদ্রাসা লাইনে পড়ব না, আমি জেনারেল লাইনে পড়ব।’ তারেকের আগ্রহ দেখে সবাই মিলে তারেকের বাবাকে বোঝাতে শুরু করলেন। অবশেষে তিনি রাজি হলেন তারেককে জেনারেল লাইনে পড়ানোর জন্য।
১৯৭৩ সাল। বাবার উদ্যোগেই তারেক ম্যাট্রিক পরিক্ষা দেন এবং ভালো নম্বর নিয়ে পাস করেন। এ সময় তিনি ভাঙ্গা পাইলট স্কুলে কৃষ্ণ স্যারের (তারেকের বাবার ছাত্র) কাছে প্রাইভেট পড়েন। মাত্র দুই মাস পড়ার পর কৃষ্ণ স্যার তারেকের বাবাকে বলেন, ‘তারেক ম্যাট্রিক পরিক্ষা দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’
এভাবেই তারেক মাসুদের মাদ্রাসার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।, জন্ম হয় স্বাধীন তারেকের। তারেক মাসুদের ভাষায়, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার মাকে যেমন বৃহত্তর সন্ধান দিয়েছে, আমার বাবাকেও কিন্তু আমার দলে আসতে হয়েছে। তিনি যখন দেখেছেন ইসলামের নামে তার পিয়ারে পাকিস্তানের আর্মি নৃশংস কাজ করছে , তার চোখের সামনে দিয়ে লাশগুলো নদীতে ভেসে যাচ্ছে, তখন আমার বাবার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে শুনেছি, আহা, পাকিস্তানকে আর টিকিয়ে রাখা গেলো না। তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন এই গণহত্যা করার পর তার সাধের পাকিস্তানকে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। এখন এই যে অভিজ্ঞতাটা আমার বাবার মতো মানুষের মধ্যেও একটা মৌলিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আগে আমি যে মানুষটা ছিলাম, ৯ মাস পরে আমি অনেক বদলে গেছি।’
চলবে…