[পর্ব-১৫]
এই এক দীর্ঘ পথপরিক্রমা। কেউ টেলিফোন ধরে, কেউ ধরে না। তারা ক্লান্ত বোধ করেন কিন্তু আশা ছাড়েন না। আবার টেলিফোন ডিরেক্টরিতে চলে যান। আরেকজন লেয়ার লেভিনের নাম খোঁজেন। ডায়াল করতে থাকেন নির্দিষ্ট নম্বরে। অপেক্ষা করতে থাকেন লেয়ার লেভিনের উত্তরের আাশায়। রিং বাজতে বাজতে লাইন কেটে যায়, কেউ সাড়া দেয় না। এভাবেই একের পর এক ব্যর্থ দিন কাটতে থাকে তাদের। তারেক ও ক্যাথরিন একে অন্যকে আশার বাণী শোনান। সান্ত্বনা দেন নিজেদের। মনোবল না হারানোর প্রতিশ্রুতি বিনিময় করেন তারা।
এভাবে লিয়ার লেভিনের অনুসন্ধান চলছে তো চলছেই। অবশেষে একদিন তারেক ও ক্যাথরিনের দীর্ঘ সাধনার সফল ইতি ঘটে। ১৯৯০ সাল। টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে তাদের প্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সেই কণ্ঠ বলে, ‘হ্যাঁ, আমি লিয়ার লেভিন, সিনেমাটোগ্রাফার। একাত্তরে বাংলাদেশে গেছিলাম শ্যুটিং করতে।’ এরপর লিয়ার লেভিনের সঙ্গে তাদের অনেক কথা হয়, দেখা হয়, বন্ধুত্ব হয়। হৃদয়ের কাছাকাছি আসেন তারা। দীপ্ত চেহারার দৃঢ় লেয়ার লেভিন ভালোবাসা আর স্নেহে কাছে টেনে নেন তারেক মাসুদকে। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ তার অ্যাপার্টমেন্টে যান। সেখানে দেখতে পান বেজমেন্টে পরম যত্নে রাখা হাজার হাজার ফুট বাংলাদেশের হারনো ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য উপাদান। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ বিমোহিত হয়ে পড়েন। লেভিনের বিপুল ফুটেজের সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে করলেই স্পর্শ করতে পারেন মহান একাত্তরকে। এ অনুভূতির সত্যি কোনো ব্যাখ্যা হয় না।
১৯৯০-১৯৯৫ সাল—এই পাঁচ বছর তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ লেভিনের ফুটেজ পরিচর্যায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। যে বিপুল কষ্ট ও পরিশ্রম করে তারা এই ছবিটি তৈরি করেছেন, তার চেয়ে একটি আনকোরা নতুন ছবি তৈরি করা ছিল অনেক সহজ। কারণ, এটির কোনো কাঠামো ছিল না, কোনো গল্প ছিল না। তারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ফুটেজগুলো আদ্যোপান্ত বারবার করে দেখে সেখান থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি বের করে আনার চেষ্টা করেছেন৷ একটি গল্পের কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। এপর গল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এক ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি করে যখন যেখানে যতটুকু ফুটেজ পেয়েছেন, কেটে রেখেছেন। এরপর সেই টুকরোগুলোকে জোড়া দিয়ে একটু একটু করে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যখন গল্পের বা দৃশ্যের মাঝখানের সংযোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তার খোঁজে তারেক মাসুদ বিবিসি, চ্যানেল ফোর, গ্রানাডা টিভি, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্কাইভে ছুটে বেড়িয়েছেন। গীতা মেহতা একটি ছবি করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর। তারেক সেটিও খুঁজে বের করলেন একপর্যায়ে। একইভাবে তারেক মাসুদ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর লেখক অ্যালেন গিন্সবার্গ ও তার মতো আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এই ছবিটির প্রয়োজনে।
এছাড়া ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান যে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন, তার মূল ভাষ্যটিও তিনি উদ্ধার করে এনেছিলেন জার্মানি থেকে ডয়েচে ভ্যালেতে কর্মরত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আব্দুল্লাহ আল ফারুকের সহায়তায়।
এভাবেই শুরু হলো চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ। লিয়ার লেভিনের আনকাট ফুটেজ দেখতে থাকলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। এর পরিমাণও প্রায় ৩৬ হাজার ফুট। সেখান থেকে তারেক মাসুদ সেসব দৃশ্য বেছে নিলেন, যেগুলো লিয়ার লেভিন তার ছবিতে বাদ দিয়ে গেছেন। তারেক মাসুদ জোর দিয়েছিলেন গানের দলের ওপর। তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, রিফিউজি ক্যাম্পে। তাদের ক্যাম্প থেকে ফেরা, তাদের সংগ্রাম। সব চেয়ে বড় কথা তাদের গানে। তারেক মাসুদ ভেবে দেখলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দর্শকের কাছে পৌঁছানো যাবে। এ কারণেই তারেক মাসুদ এড়িয়ে যান লিয়ার লেভিনের সযত্নে তোলা সুন্দর সুন্দর অনেক দৃশ্য। ফসল তোলার দৃশ্য, নদীতে স্নান, হাটবাজার, গরুর গাড়ি, নদীঘাট ইত্যাদির অসংখ্য সুন্দর শট। এমনকী রিফিউজি ক্যাম্প জীবনের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুটেজ তারা অব্যবহৃত রেখে দেন। তারেক মাসুদ বলেন, নিশ্চয়ই সেসব দৃশ্যের ঐতিহাসিক ও মানবিক আবেদন আছে। আমাদের মনে হলো ওগুলো দিয়ে ভিন্ন আরেকটা ছবি হতে পারে। কিন্তু মুক্তির গান নয়।
একটি ছবি যে প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয়, ঠিক তার বিপরীত প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয়েছিল ‘মুক্তির গান’ ছবিটি। অর্থাৎ একটি ছবি নির্মিত হয় মূলত প্রথমে ভাবনায়, এরপর ভাবনা অনুযায়ী চিত্রনাট্য এবং এর পরবর্তী সময়ে শ্যুটিং। অথচ ‘মুক্তির গান’ ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে শ্যুটিং করা ফুটেজ থেকে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ যখন এই ফুটেজ হাতে পেলেন, তখন তাদের ভাবনা হলো, এই যে ১০-১২ জন শিল্পী, যাদের ট্রাকে ঘুরতে দেখা যায়, প্রথমে তাদের খুঁজে বের করবেন। তাদের খুঁজে বের করে সাক্ষাৎকার নেবেন। তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ড দেখাবেন। এই ভাবনা থেকে তারেক মাসুদ তাদের খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন কেউ আছেন বাংলাদেশ, কেউ লন্ডনে, কেউ আমেরিকায়। এই দলের দলনেতা লিড ভোকালিস্ট মাহমুদুর রহমান বেনু, যিনি তারেক মাসুদের চাচাতো ভাই, তিনি তখন লন্ডনে। তারেক আলী নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্রে। দেবু ভট্টাচার্য কানাডায়। লতা চৌধুরী কলকাতায়। শাহীন সামাদ, ড. নায়লা খান, লুবনা মরিয়াম, বিপুল ভট্টাচার্যসহ অনেকেই বাংলাদেশে। তাদের সবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে তারেক মাসুদ ভাবলেন, তাদের একটি প্রশ্ন করবেন। তা হলো—আপনারা মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছেন, আজ সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনাদের অনুভূতি কী? অথবা, সেই স্বাধীন করা দেশটার কী হলো? এ ধরনের প্রশ্ন করবেন। এতে অনেক আবেগ চলে আসবে। সেই সময় বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাও উঠে আসবে।
‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্র তৈরির প্রথম ভাবনা এমনই ছিল। পরে তারেক মাসুদ যখন তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করলেন, তখন তিনি তাদের মধ্যে যে বিষয়টা লক্ষ করলেন, তা হলো, তাদের মধ্যে যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের যে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, তাকে ছাপিয়ে ওই সময়ে তাদের মানসিক যে তিক্ততা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হতাশা, তা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তারেক মাসুদ তখন এই সাক্ষাৎকার পরিত্যাগ করলেন। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ এই ফুটেজকে কাজে লাগিয়ে এমন একটি ছবি বানাতে চাইলেন, তরুণ প্রজন্ম যা দেখে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহী হবে। তিনি দেখলেন ফুটেজে কিছু গান আছে, অসম্পূর্ণ। তখন তারেক মাসুদ ভাবলেন, গানগুলো রেকর্ড করবেন। যেহেতু তার চাচাতো ভাই মাহমুদুর রহমান বেনু ছিলেন ওই দলের দলনেতা, তারা কী গান গাইতেন, তারেক মাসুদের তা মুখস্ত ছিল। তারেক মাসুদ তাদের নিয়ে ১১টি গান রেকর্ড করলেন। গান রেকর্ড করে ছবিটি মিউজিক্যাল কাঠামোয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। এর সঙ্গে ‘রোড মুভি’ ধরনের অর্থাৎ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবে। এভাবে ছবিটি বানাবেন। আর এমনভাবে সম্পাদনা করবেন, যেন দেখে প্রামাণ্যচিত্র মনে না হয়। মনে হবে, এটি কাহিনীচিত্র। যদিও মূলত এটি প্রামাণ্যচিত্র। এটা কী করে সম্ভব? তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ পড়ে গেলেন আরেক ভাবনায়।
চলবে…
তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিঅলা-পর্ব: ১৪॥ শারমিন রহমান