[পর্ব-১৩]
তারেক মাসুদ যখন সুলতানকে নিয়ে ছবি করতে শুরু করেন, তখন নাগরিক জীবনে সুলতান কিংবদন্তির মতো। তার অতীত, এমনকী বর্তমান জীবন নিয়ে অতিমানবীয় গল্পের শেষ নেই। তিনি শাড়ি পরে, নূপুর পায়ে থাকেন। তিনি গোখরা সাপের সঙ্গে ঘুমান, বাঘকে বশ করতে পারেন ইত্যাদি। এই মিথের মিথ্যা এড়িয়ে, বর্ণাঢ্য অতিপ্রাকৃতিক ভাবমূর্তি ছাড়িয়ে শিল্পীর বাস্তব জীবন ও শিল্প অন্বেষণের সিরিয়াস দিকটার প্রতি নজর দিতে চেয়েছেন।
তারেক মাসুদ সুলতানের জীবনী তুলে ধরবেন না এ চলচ্চিত্রে এটা মাথায় রেখেই কাজ শুরু করেন তিনি। সুলতান কী ছিলেন, পিকাসোর সঙ্গে এক্সিবিশন করেছেন, আমেরিকায় গিয়েছিলেন এইসব তারেক মাসুদের বিষয় ছিল না। এগুলো নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। তারেক মাসুদের বিষয় ছিল, একজন শিল্পের সকাল, তার বিকেল, সন্ধ্যা, রাত। তিনি কোথায় যান, কী করেন, তার চোখ দিয়ে গ্রামবাংলার রূপ। সে কারনে সুলতানের সম্পর্কে জীবনীমূলক যে তথ্য, সেটি দেড় মিনিটেই তারেক মাসুদ সেরে ফেলেছেন কিছু সাদাকালো ছবি আর ধারাভাষ্য দিয়ে। বাকিটা তারেক মাসুদের আত্মকথনের মতো করার ইচ্ছে ছিল, যতটা আত্মকথন করতে চেয়েছিলেন, কিছু সমস্যার কারণে তার পুরোটা পারেননি। তাই মাঝে ধারাভাষ্যের ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে Sync Sound ক্যামেরা ছিল না তখন। যিনি কথা বলছেন, তাকে আবার দেখাও যাচ্ছে, এটা তারেক মাসুদের ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু তারেক মাসুদ ভাগ্যক্রমে দারুণ একটা সুযোগ পেয়ে যান। একটি বিদেশি টিম (BBC) কিছু কাজ করতে বাংলাদেশে এসেছিল, তাদের সঙ্গে তারেক মাসুদ এক মাস কাজ করেছিলেন।
তারেক মাসুদের ভাষায় ‘কামলার মতো’। BBC-এর টিম তারেক মাসুদকে বলল, তোমাকে কত টাকা দিতে হবে? তুমি তো আমাদের সঙ্গে এক মাস কাজ করলে, এত চমৎকার! তখন তারেক মাসুদ বললেন, আমি টাকা চাই না। তোমরা যে Sync Sound ক্যামেরাটা নিয়ে এসেছ ১৬ মি. মি.-এর; ওই ক্যামেরা দিয়ে আমি যে একজনকে নিয়ে ছবি করছি, তার কিছু Sync Sound ইন্টারভিউ শ্যুট করবো।
BBC টিম অবাক হয়ে গেলো তারেক মাসুদের ছবি করার কথা শুনে। ওরা কিছুই জানতো না এ ব্যাপারে। তারা তখন তারেক মাসুদকে শুধু ক্যামেরাই দিলো না, সঙ্গে ফিল্ম স্টকটাও দিয়ে দিলো। তারেক মাসুদ এই প্রথম ৪০০ ফিটের একটা রোল দেখলেন। এতদিন ১০০ ফিট ১০০ ফিট করে ছবি শ্যুট করেছেন, একসঙ্গে ৪০০ ফিটের একটা রোল যা দিয়ে টানা শ্যুটিং করা যায়, অবাক হয়ে দেখলেন। সুলতানকে তারেক মাসুদ ঢাকায় নিয়ে এলেন। কারণ BBC-এর টিমকে তো আর সুলতানের বাড়ি নিতে পারবেন না। ঢাকায় একটা বাড়ির ছাদে সুলতানকে বসানো হলো, পেছনে সবুজ- যেন দেখে মনে হয় গ্রামে বসে আছে। তিনি ইচ্ছে করেই Wide frame এ গেলেন না। Tight frame এ ইন্টারভিউ নিলেন। কারণ
Wide frame-এ ইন্টারভিউ নিলে বোঝা যেতো এটা ঢাকা শহরে শ্যুটিং করা হয়েছে। তারেক মাসুদ অনেক দুঃখের সঙ্গে বলেন, ‘পরে কিন্তু আর ওই ভালো স্টকও পাইনি, অনেক কিছুই পাইনি। টাকাও ফুরিয়ে আসতে থাকলো, একটা এক্সপায়ার ফিল্ম স্টক নিয়ে শ্যুট করেছি, কখনো Agfa, কখনো Fuji। একটা সিনের মধ্যে যখন তিনটা চারটা স্টক, কালার চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, তারপর প্রসেসিং করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে Base fog,ডেভেলপ করার সময় ভুল করে এটা এক্সপোজ করে ফেলেছে, আলোতে নিয়ে ফেলেছে DEP-তে কাজ করতাম।’
তারেক মাসুদ দুঃখ নিয়ে বলতেন যে বাংলাদেশে কেউ যদি ছবি বানাতে চায়, তাহলে তাকে শুধু ডিরেক্টর হলে হবে না। তাকে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই শিখতে হবে, জানতে হবে। তারেক মাসুদ কাজ করতে গিয়ে হয়তো বলেছেন এটা এভাবে প্রসেস করেন, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এসেছে, না না এটা এভাবে হবে না। সাউন্ড নিয়ে কিছু বলতে গেলে বলতেন, না না এটা এভাবে হবে না। তখন তারেক মাসুদ অনুভব করলেন, তিনি যদি কাজ জানতেন, তাহলে তাকে কেউ এভাবে বলতে পারতো না। তার তিনি এসব কারণেই টেকনিক্যাল দিকের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। তিনি বিশ্বাস করতেন টেকনিক্যাল বিষয় হচ্ছে সিনেমার প্রকৃত কারিগর। কারিগরি দিকই হচ্ছে প্রধান কারিগর, সিনেমার যে নান্দনিকতা, তা কারিগরি দিকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারেক মাসুদের একজন বিদেশি বন্ধু ছিল জন রাইবার (John Riber)। এখানে একটি অডিও ভিজুয়াল NGO-এর প্রধান ছিলেন। ওয়ার্ল্ড ভিউ ফাউন্ডেশন। জন একদিন তারেক মাসুদকে বললেন, ‘আমি তো ব্যাংকক যাচ্ছি, আমার ছবিগুলো প্রসেস করতে দাও, তোমার ফিল্মগুলো দাও।’ তারেক মাসুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ফিল্মগুলো দিয়ে দিলেন বন্ধু জন রাইবার এর কাছে। ফিল্মগুলো প্রসেস হয়ে ফিরে এলো। ১৬ মি.মি. এ জন রাইবার এর প্রজেক্টরে এবং তার ফাউন্ডেশনেই ছবিটা সবাই দেখলেন।
আদম সুরত বা কালপুরুষ অর্থাৎ যে নাবিক পথ হারিয়েছে সে নাবিক যে কালপুরুষকে দেখে আবার তার দিক নির্দেশনা ফিরে পায়। সুলতানের জীবন, শিল্প দর্শনের মধ্যে তারেক মাসুদ সে নির্দেশনা খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তাই এ চলচ্চিত্রের নাম সুলতানের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে ‘আদম সুরত’
সুলতানের যেসব ছবি তিনি ধারণ করতে পেরেছিলেন তা নিয়ে তার বক্তব্য এমন ছিল—‘ছবি হিসেবে কতটা করতে পেরেছি, তা জানি না। কতটা প্রামাণ্যকরণ সুলতানের হয়েছে তাও জানি না। তবে, আজ যতটা শিখেছি, সিনেমা বানানো, জীবনকে বোঝা অথবা আমার কৃষিপ্রধান গ্রামবাংলাকে নতুন করে আবিষ্কার করা—সবই ৭ বছরে সুলতানের চোখ দিয়ে দেখেছি, বুঝেছি।’
ছবির শুরুতে তারেক মাসুদের একটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে, সুলতানকে তিনি বোঝেন। কিন্তু ৭ বছর পরে বুঝতে পারলেন, তিনি যে আসলে সুলতানের একটি কণাও বুঝতেন না। তবে ছবির শেষে অনেকটাই বুঝতে পেরেছিলেন। সুলতানের শিল্পের উৎস কতটা গভীরে, তার শেকড় কতটা প্রোথিত এই গ্রামবাংলায়, সেটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। একজন শিল্পী তার দেশকে, সমাজকে কতটা ভালোবাসলে বিদেশের সমস্ত আরাম আয়েশের জীবন ফেলে নিজ গ্রামে ফিরে আসতে পারে। কাটাতে পারে মানবেতর জীবন।
গ্রামীণ জীবন একজন বিখ্যাত শিল্পীকে কী করে মহৎ শিল্পীতে রূপান্তরিত করেছে, এটাই মূল বাক্য। গ্রামীণ জীবনের জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে যুগের পর যুগ সহাবস্থান করেন। একজন শিল্পীকে আমূল বদলে দেয়। স্বেচ্ছায় নির্বাসিত একজন শিল্পী, যিনি পণ ধরেছিলেন যুগের পর যুগ ছবি আঁকবেন না, এই অভিমানী শিল্পীকে আবার শিল্পী হিসেবে ফেরত নিয়ে এসেছে ৬৯,৭০,৭১-এর বিশাল গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ। মূলত মুক্তিযুদ্ধই সুলতানের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ছবি দিয়েই তিনি ৭২ সালে ছবি আঁকতে শুরু করেন। সুলতান যেমন বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দ্বারা নিজে বদলে গেছেন, তেমনি কাউকে বদলানোর চেষ্টা করেননি। তিনি কাউকে বলেননি, বদলে যাও। তিনি নিজে বদলে গেছেন। এই বদলে যাওয়াটা মানুষের সংস্পর্শে এসে। সুলতানের দর্শনকে অণুসরণ করার চেষ্টা করেছেন তারেক মাসুদ।
আদম সুরত বা কালপুরুষ অর্থাৎ যে নাবিক পথ হারিয়েছে সে নাবিক যে কালপুরুষকে দেখে আবার তার দিক নির্দেশনা ফিরে পায়। সুলতানের জীবন, শিল্প দর্শনের মধ্যে তারেক মাসুদ সে নির্দেশনা খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তাই এ চলচ্চিত্রের নাম সুলতানের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে ‘আদম সুরত’।
তারেক মাসুদ যে গভীরভাবে দেশকে বুঝতেন এবং সুক্ষ্ণভাবে নিজের দেশকে দেখতেন, তা সুলতানের সান্নিধ্যে থাকার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তারেক মাসুদ অনেকবার বলেছেন, ‘আমার শিল্পসত্তার যে উন্মেষ ঘটেছে, তা সুলতান করার কারণে। সুলতানের ছায়া আমার কাজে, জীবনে,মৃত্যুতে।’
আদম সুরত
প্রযোজনা: ডকুমেন্টাল
মূল চিত্রগ্রহণ: মিশুক মুনির
চিত্রনাট্য: তারেক মাসুদ
সম্পাদনা: নজরুল ইসলাম
নির্বাহী প্রযোজক: ক্যাথরিন মাসুদ
ইংরেজি ধারা বর্ণনা: আলমগীর কবির
বাংলা ধারা বর্ণনা: জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
নির্মাণকাল: ১৯৮২-১৯৮৯
দৈর্ঘ্য: ৪৭ মিনিট
ফরম্যাট: ১৬ মি. মি রঙিন
ধরন: প্রামাণ্যচিত্র
সংগীত: পুলক গুপ্তচলবে…
তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিঅলা-পর্ব: ১২॥ শারমিন রহমান