সপ্তম পর্বের পর:
রাত বারোটায় ঝুমুরের স্টাডিরুমে রূপকথা চন্দ্রকথা ঈশান আর ঝুমুর। বাড়িটা এমনিতেই নির্জন শহরতলীতে। রাত ৮/৯ টা বাজতেই গাড়ি চলাচল বন্ধ। মানুষ ঘরে ঢুকে পড়ে। মধ্যরাতে দুই-একটা বেওয়ারিশ কুকুরের আর্তনাদ আর মাঝে মাঝে আরও অনেক দূরের কোনো বন থেকে শেয়ালের ডাক। কোলাহল বলতে এই। ঈশান ঘরে ঢুকে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখে। চারপাশে রাশি রাশি বই। সাজানো পরিচ্ছন্ন বিছানায় হালকা রংয়ের কভার। পর্দায় ও রংয়ের প্রাধান্য আড়াল করেনি ঘরটির আভিজাত্য। বরং আলোর অনেক বেশি ঔজ্জ্বল্য ধরেছে নিশ্চয়ই দিনের বেলায়। এক পাশে একটা ছোট রিডিং টেবিল তাতে স্পট লাইটের হালকা আলো জ্বলছে। ঈশান ঝুমুরের রুচির পরিচয় পেয়ে যায় এইটুকুতেই।
চন্দ্রকথা একটা ডেটলের বোতল কিছু তুলো আর একটা ধূপদানিতে ধূপ নিয়ে ঘরে ঢোকে। ধূপের গন্ধে সবাই ওদিকে তাকায়।
ধূপটা জ্বালিয়েই নিয়ে এসেছি।
ঠিক আছে। ওটার কাছ রাখো বলে দেয়ালে সাঁটানো লাইফ সাইজ আয়নাটা দেখায় ঈশান। তারপর তুলোয় ডেটল লাগিয়ে খুব যত্ন করে পুরো আয়নাটা মুছে নেয়। ধূপদানিটা রেখে দেয় তার পাশে। রূপকথা আগে থেকেই আয়নাটার সামনে মাটিতে পাতা কার্পেটে বসে। মা পেছনে ডিভানে বসেছেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। চন্দ্র রূপের পাশে বসে পড়ে। তার পাশে বসে ঈশান। পুরো ঘরটাতে কেমন একটা অস্পষ্ট ভৌতিক অবস্থা বিরাজ করে। ডেটল আর পোড়া ধূপের গন্ধ ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো এক মৃত নগরীতে আছে সবাই। স্পট লাইটটা কেউ একজন নিভিয়ে দেয়।
কেউ চোখ বন্ধ করবেন না। এ আয়নাটা একটা মাধ্যম। আমরা যার সঙ্গে কথা বলব, তার প্রকাশ সম্পূর্ণ নয়। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মাধ্যম সবসময়ই খুঁজছেন। এটা সেই। তিনি এ মাধ্যমটা পেলে কিছুটা নিজেকে প্রকাশিত করতে পারবেন আমাদের সামনে। আচ্ছা আপনারা বলুন, যেকোনো একজন বলুন কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক, যিনি পৃথিবীতে নেই।
কিছুক্ষণ নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলে না।
আন্টি আপনি কি বলবেন?
হুম।
তাহলে নাম বলুন। আপনি কার সঙ্গে কথা বলবেন। তার নাম বলুন। তারপর আমি তার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।
মা একটা নাম উচ্চারণ করে। বেশ কিছুক্ষণ পিনড্রপ সাইলেন্স ঘরটাতে। তীব্র অন্ধকারে বিভ্রম লাগে চন্দ্র আর রূপের। মা’র অবস্থা বুঝতে পারা যায় না। কতক্ষণ এভাবে। সেকেন্ড মিনিট নাকি ঘণ্টা? বিকট অন্ধকারে চন্দ্র দ্বিধান্বিত। বাড়িটা ক্রমেই যেন আরও ভুতুরে হয়ে উঠছে। হঠাৎ আয়নায় কয়েকটা পানির বুদ্বুদের মতো ভেসে ওঠে। বর্ণহীন। শুধু যেন অস্তিত্ব আছে। বাড়তে থাকে বুদ্বুদ্গুলো। দুটো তিনটে চারটে অসংখ্য। অসংখ্য।হঠাৎ একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। গুঞ্জনটা বাড়তে থাকে। যেন অনেক অনেক মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কী বলছে। বুদ্বুদ্গুলো থেকে যেন বের হয়ে আসছে অদ্ভুত এক আধিভৌতিক আবছা আলো। বুদ্বুদের আলোতে খানিকটা মুখ দেখা যায় ঝুমুরের খানিকটা ঈশানের আর খানিকটা রূপকথার। তারা সবাই নিমগ্ন। নীরবতা ভাঙে ঈশান।
আন্টি অসংখ্য মৃতের আত্মা তাদের পরিচিত কিংবা আত্মীয় খুঁজছেন। সবাই পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছেন। অপেক্ষায়। কেউ কি তাদের মনে করছে? আপনি আরও জোরে নামটা বলুন। কোন সময়ে তিনি জীবিত ছিলেন, সেই সালটা বলুন।
মা আরও জোরে একজন মানুষের নাম উচ্চারণ করেন যেটা রূপকথা কিংবা চন্দ্রকথার চেনা নয়। সালটা ২০১৪ বোঝা যায়। সঙ্গে-সঙ্গে সব বুদ্বুদ আয়নায় থেমে গিয়ে একটা সাদা আলোর স্ফুলিঙ্গের মতো কিছু ভেসে ওঠে।
আন্টি একজন আত্মা আপনার ডাক শুনেছেন। তিনিই কথা বলছেন। শুনুন।
সবাই কান পাতে। খুব সতর্ক। কথাগুলো ভেসে ভেসে আসছে যেন কোন সুদূর রূপকথার দেশ থেকে।
ঝুমুর? ঝুমুর?
মা কি কাঁদছিলেন? মা’র কণ্ঠটা যেন কেমন ভেজা শোনা যায়।
হ্যাঁ, আমিই ঝুমুর।
হ্যাঁ, তুমিই তো নাম ধরে ডাকলে আমাকে। তোমার কণ্ঠ আমি চিনব না? তুমি কেমন আছ? আর মেয়েরা? ভালো আছে তো?
এবার মৃত কণ্ঠটা আরও পরিষ্কার। চন্দ্র উৎকর্ণ। কোথায়? কোথায় যেন শুনেছে ? হ্যাঁ-হ্যাঁ। কখনো কোথাও। কখনো না কখনো শুনেছে এ কণ্ঠ সে? স্বপ্নে কোনোদিন শুনেছিল কি এই কণ্ঠ!
হ্যাঁ, আমরা সবাই ভালো আছি। তুমি ভালো আছ তো?
আমি খুব ভালো আছি।
ঝুমুর যেন কথায় গতি পায়।
শোনো, রূপকথা তো টাইমমেশিন বানাতে চলেছে। তুমি কী বলো?
রূপকথাও এবার বলতে শুরু করে।
লেখক আঙ্কেল। আমি অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ দুটোতেই ভ্রমণ করা যায়, এমন টাইমমেশিন তৈরির প্রায় শেষ পর্যায়ে আছি।
আত্মার কণ্ঠস্বর এবার স্পষ্ট শোনা যায়,
খুব ভালো কথা। খুব ভালো কথারে।
চন্দ্রর ঘোর লাগা নেশা। এই কণ্ঠ, লেখক আঙ্কেলের। কবে যেন শুনেছে খুব। কিন্তু কোথায়? হ্যাঁ। হ্যাঁ। এই তো সেই কণ্ঠ। তিনি প্রায়ই ফোনে কথা বলতেন। তখন চন্দ্রকথার বয়স কত? ৫ কি ৬? হ্যাঁ মনে পড়েছে। চন্দ্রর ঘোর ভাঙতে শুরু করে।
কিন্তু একটা কথা বলি তোকে মা।
হ্যাঁ, বলো আঙ্কেল।
ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভালো।
ঈশান মাঝ থেকে প্রশ্ন করে,
কেন আঙ্কেল?
কেন? একটা অমোঘ সত্যি কথা হলো আমরা প্রত্যেকেই আমাদের শেষ ভবিষ্যৎটুকু জানি। আর তা হলো মৃত্যু। সামনে যা যাই ঘটবে তারও পরে একমাত্র নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ। মৃত্যু। এ তো জানাই। ওখানে জানার আর বিশেষ কিছু নেই। আমি তো এখন সেই জায়গাটাতে অবস্থান করছি। আমার কথায় আস্থা রাখো। তোমরা অতীতে যাও। সুন্দর আর মনোরম কিছু খোঁজো। ভালোবাসো নিজেকে। আর নিজের গবেষণার সাফল্যকে মানুষের কাজে লাগাও।
কথা শেষ হতেই রূপকথা বলে,
লেখক আঙ্কেল।
বল্ মা। তুই আরও বড় হ। নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যা। আর মার দিকে খেয়াল রাখিস। কিরে চন্দ্র আমার কথা তোর মনে নেই, না?
চন্দ্র যেন জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করছে। তখন। হ্যাঁ। অনেক পরিচিত এই কণ্ঠ সে কবে শুনেছে? কোথায়? কই গত বাইশ বছরে তো নয়? তবে? এ কি তবে গত জন্মে? তার কি দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে তবে? কিন্তু দিদি মা তারা তো তাকে খুব ভালো জানে মনে হচ্ছে? এরই মাঝে ঝুমুর কথা বলে,
হ্যাঁ, ওর তখন বয়স ৫ বছর। তুমি চলে গেলে।
ঠিক আছে আজ এ পর্যন্তই। পরে কথা হবে। আত্মা কথা প্রলম্বিত করতে চায় না।
রূপকথার বুক ফেটে একটা আর্তনাদের মতো বেরিয়ে আসে,
লে-খ-ক আ-ঙ্কে-ললললল দাঁড়াও।
মা চোখের জল মোছেন।
কেঁদোনা। অত চিন্তা করবে না আমার জন্য। আমি খুব ভালো আছি। ঝুমুর তোমার সাথেও খুব দ্রুতই আমার দেখা হবে।
আয়নায় বুদ্বগুলো খুব দ্রুত মিলিয়ে যায়। তখনো বাতাসে পোড়া ধুপের গন্ধ উড়ছে। মনে হচ্ছে প্রত্যেকেই কোনো এক অজানা লুপ্তলোকে হারিয়ে গেছিল। যেখানে শুধু একজন চেনা মানুষ। যিনি বহুদিন আগে হারিয়ে গেছেন। কারও মনে গেঁথে আছেন গভীর ভালোবাসায়, কারও মনে সুপ্ত শ্রদ্ধায়, কারও মনে চিনি কি চিনি না–এমনি অধরা অনুভবে। কিন্তু কী যেন এক দিশা তিনি দিয়ে গেলেন। বর্তমান আর ভবিষ্যতের এক অসাধারণ বীক্ষা।এক অদ্ভুত আর যৌক্তিক ব্যাখ্যা যেন আজ পাওয়া গেল। তখন মাঝরাত্র পাড়ি দিয়েছে সময়। পুরো ঘরটাকে যেন এক অদৃশ্যলোকের দৃশ্যমান কোনো ছায়া ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। নিঝুম চারধার। বর্তমান আর অতীতের মাঝখানে এক ক্ষীণ সংযোগ রেখা টেনে দিয়েছে যা।
চলবে…