নবম পর্বের পর:
রূপকথার ল্যাবরেটরি। বেশ কয়েকটা মনিটরে কি সব জটিল তত্ত্ব আর তথ্যের দিকে চোখ বুলান আকবর খান।
হুম। হুম ঠিক আছে। কিন্তু কি জানো রূপকথা, আমি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছি। ওখানে এসে একটা জটিলতা পাক খেতে পারে অনুমান করছি।
কী স্যার। আমাকে বলুন না? দেখি, সেটা থেকে আগেই সারভাইব করার কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না?
খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে স্যার বলেন,
না না। আগে আগে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
কেন স্যার।
যতক্ষণ না এটা সরাসরি বাস্তব ব্যবহারে না যাবে, বলা যাচ্ছে না কী হবে। সবই আমার অনুমান।
স্যার। আপনার অনুমান? নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ভুল আমার তাহলে রয়ে গেছে।
শুভ্র চুল দাঁড়িতে সমস্ত শরীর দুলিয়ে এমন ভঙ্গিতে তিনি না বলে ওঠেন। রূপকথা পুরো মনোবলটা যেন ফিরে আসে।
না না না। তোমার কোনো ভুল নেই। ঠিক আছ তুমি। এটা ঠিক ভুল নয়। দেখা যাক। কী হয়।
তারপর অন্য প্রসঙ্গে যান তিনি। ঈশানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? ওদিকে কদ্দুর?
প্রায় রেডি স্যার। নেভাদা স্টেট থেকে এই প্রকল্পের জন্য বেশ বড় একটা ফান্ড দিয়েছে। সেটা দিয়েই প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে টাইমমেশিন। আর এখানে বাংলাদেশ সরকার আমাকে তো সাহায্য করছে আপনি জানেনই।
হুম। খুব খেটেছ তুমি। সাফল্য তোমার নিশ্চিত রূপ। চিন্তা করো না। একদম চিন্তা করো না।
দিনটার দারুণ শেষ হয়। রাতে সবার সঙ্গে বসে ডিনার করেন পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী আকবর খান। চন্দ্রকথা তো খুবই ইমপ্রেসড্। মাও খুব উৎফুল্ল। এরই মাঝে ঈশানের ফোন আসে। টাইমমেশিন রেডি। আজই গরম চুল্লি থেকে পূর্ণ আকার নিয়ে নেমে আসবে পৃথিবীর প্রথম টাইমমেশিন। দিদি নেটে সংযোগ দেয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে টাইমমেশিনের আর্কিটেকচারার শেপ। ভেতরের ইঞ্জিন আর পেছনে বসবার সিটের প্ল্যান। রূপকথা সিট প্ল্যান দেখিয়ে বলে,
চন্দ্র নে দেখ। ঈশান তোর জন্য সিট বানিয়েছে। যেতে পারবি বোধ করি তুইও।
হাসতে থাকে সবাই।
কি ছোড়দি তুমিও যাবে নাকি টাইমমেশিনে করে মায়ের ছোটবেলায়?
ঝুমুর যোগ হয়,
কি অদ্ভুত জানেন মি. আকবর খান? ওরা যখন খুব ছোট। আমি ওদের রূপকথার দেওদানোর গল্প বলতাম না। ঘুমুতে যাওয়ার সময় আমার বাড়ির গল্প বলতাম। ওর মতো বয়সে আমরা ছিলাম কুমিল্লা শহরের লালমাই পাহাড়ের নিচে একটা সরকারি কলোনিতে। বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই সবুজ ধানখেত। দূরে উঁচু উঁচু টিলা। ধান খেতে উড়ে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে বক। এক পায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতো। আর লম্বা ঠোঁট ডুবিয়ে খেতের আল থেকে তুলে আনতো মাছ। ঝুম বৃষ্টি হতো কখনো পাহাড়ে। বাড়ির ঝুলন্ত বারান্দায়। তিনতলায় বাবার লাগানো লেবু গাছের সাদা সাদা ছোট ছোট লেবু ফুলগুলো চুঁইয়ে পড়তো বৃষ্টির জল। জানেন আজো আমার কাছে পৃথিবীর কোনোকিছু এত সুন্দর লাগে না। এ সব গল্প শুনতে শুনতে হলো কি রূপকথা প্রতিদিন আমাকে ঘুমাতে শুয়েই বলে মা আমাকে তোমার ছোটবেলার গল্প বলো। প্রতিদিন একই সব ঘটনা উল্টে পাল্টে বলি ওকে। তবু ওর শখ মেটে না। আমি তখন থাকি ছোট এক ভাড়া বাড়িতে। বাইরের দিকে তাকালেই অন্য এক বাড়ির বারান্দা কিংবা বাথরুম। দুই বিল্ডিংয়ের ফাঁকে অনেক কষ্টে একটু আকাশ দেখা যায়। আমার খুব কষ্ট হতো আমার মেয়েটার জন্য। আমি কথায় আর গল্পে যতটুকু সম্ভব ওদের একটা বিশালতা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। একটু বড় হলে ও বলতো আমি টাইমমেশিন বানাব। তারপর একদিন অনুভব করলাম সত্যি সত্যি ও বিজ্ঞানী হতে চায়। গবেষণা করতে চায়। টাইমমেশিন বানিয়ে মায়ের ছোটবেলা দেখতে চায়।
অনেক্ষণ ঝুমুরের কথাগুলো খুব মনোযোগে শুনলেন আকবর খান। তিনি কিন্তু এ গল্প আগেই জানেন। রূপকথার কোন কথা তার কাছে লুকানো নয়। তবু ঝুমুরের কাছে প্রথম জানলেন যেন। তারপর বললেন,
হোক না। যেকোনো কারণেই হোক। আমরা তো প্রতিনিয়তই এটা করছি দেখুন। যা চাই কিন্তু পাই না। সেটা পাওয়ার জন্যই আমাদের প্রাণান্ত চেষ্টা। তারই কারণে ঘটছে পৃথিবীতে কত হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত। এই সবকিছুরই বাইরে যদি ওর না দেখা কে দেখার, অধরা কে অবলোকন করার চেষ্টায় একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়, হোক।
চলবে…