এইভাবে পার হয় কিছুকাল, সোনালি শৈশব রূপকথা আর চন্দ্রকথার। বিজ্ঞানের বই পড়তে পড়তে আরও গভীর হয় বিজ্ঞানের প্রতি রূপকথার আকর্ষণ। চশমার পাওয়ার বেড়ে চলে সমান তালে। ছোটবেলা থেকেই বই ছাড়া মেয়েটা কিছু বোঝে না। এ এক অদ্ভুত বিষয়। কখনো পুতুল খেলেনি চন্দ্রকথার মতো। যখন খুব ছোট রূপ মা তখন খুব নিঃসঙ্গ। সারাদিন একা একা অসম্ভব চঞ্চল একটা বাচ্চার সাথে কর্মব্যস্ত দিন আর ঘুমহীন রাত পার করে একটু সময় পেলে মা বসতো লেখার ডায়েরি নিয়ে। কী যে লিখে চলত আনমনে। আর ওই ছোট্ট রূপকথা কোনোমতে কলম পেন্সিল ধরতে পারে কেবল। হাতের সামনে যা পেত তাতেই ঘুরাতো পেন্সিল। আরও একটু বড় হলে ঝুমুর খেয়াল করে যে দ্রুত নিজে ডায়রিতে লিখছে তার তিন বছর বয়েসের মেয়ে খুব সচেতনভাবে অমন দ্রুত পেন্সিল ঘুরিয়ে গোল গোল করছে পাতার পর সাদা পাতা। আবার ফাঁকে দেখে নিচ্ছে মায়ের হাত। সেই মেয়ে সত্যি আজ বিখ্যাত সাইন্টিস্ট। এটা ২০৩৬ সাল। আমেরিকার এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়িয়ে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। বিদেশের মাটিতে নাকি তার পোষায় না। দেশের পুটি কৈ তাও নাকি বিদেশের পোলাও মাংসের চেয়ে ঢের ভালো। একটা জায়গায় সমস্যাটা দানা বাঁধছে। এখনো পড়ে রয়েছে সে টাইমমেশিন বানানোর নেশায়। সারাদিন রাত তাই নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। জটিল জটিল তত্ত্ব আর তথ্য নিয়ে তোলপাড় করছে নিজের জীবন। কিন্তু টাইমমেশিন বানাতে গবেষণার জন্য যে টাকার দরকার তা জোগাড় কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি কোনো সাহায্য তো দুরাশা। আমেরিকাসহ কিছু উন্নত বিশ্বে সাহায্যের জন্য কাগজপত্র পাঠিয়েছে, দেখা যাক। কদ্দুর কি হয়।দিনরাত ডুবে থাকে গবেষণায় নিজের গবেষণাগারে। মাঝে মাঝে ভুলে যায় মা আর বোনেরও কথাও। নানুর রেখে যাওয়া টাকা আর মা’র জমানো কিছু টাকা দিয়ে একটা জায়গা কিনেছিল ওরা শহরের শেষ প্রান্তে। একটু নির্জন। মা আর দিদি দু’জনেরই একটু দূরে নির্জন জায়গা পছন্দ। খালাতো বোন আর্কিটেক্ট নিঝুম খুব সুন্দর একটা প্ল্যান করে দিয়েছে। সেখানে দিদির একটা গবেষণাগার আর চন্দ্রর ছবি আঁকার জন্য নির্জন ঘরও আছে। দিনের বেশির ভাগ সময় দিদি তার গবেষণাগারে থাকে। কিন্তু চন্দ্র অত নয়। হঠাৎ ছবি আঁকার নেশায় পেলে মাঝ রাত অবধি স্টুডিওতে ইজেল, ক্যানভাস আর রংতুলির সাথে কাটায়। তা না হলে সে ছোটবেলার মতোই মায়ের পাশে পাশে ঘুর ঘুর করে।
ঝুমুরের বয়স হয়েছে। ঝুমুরের কাছে বেশি থাকে চন্দ্রই।তার দিদির মতো কোনো কিছুতে অত ঝোঁক নেই। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরিতে জয়েন করেছে এই মাস দুই তিন। তার ইচ্ছে অফিসে যাবে কাজ করবে । বাড়ি চলে আসার পর আর কোনো অফিসের কাজ নয়। বাড়ি ঘর ক্লিন করা, মজার মজার রান্না করা, মায়ের দেখা শোনা করা আর নিজের মনের মতো গান শোনাই তার পছন্দ।চন্দ্রকথা অবশ্য মাঝে মাঝে ছবি আঁকে। দারুণ ছবি আঁকে। মনে পড়ে ছোটবেলায় মা দিদিকে নিয়ে বাফায় যেত নাচ শেখাতে। দিদি নাচটা করল না। তারপর গেল ছবি আঁকার স্কুলে। মনি আপু খুব আদর করতো দিদিকে ভালো ছবি আঁকে বলে।ছবিটাও দিদি অত মনোযোগ দিয়ে আঁকা শিখল না। কিন্তু মাঝে মাঝে অদ্ভুত সুন্দর ছবি আঁকতো। চন্দ্রকথা মুগ্ধ হয়ে সে ছবি দেখতো। কিন্তু দিদিটা কেমন যেন হিংসুটে আর মেজাজি ছিল ছোটবেলায়। সে যখন দিদির ছবি আঁকা দেখতো দিদি ছবিটা লুকিয়ে ফেলতো,
দিদি ছবিটা একটু দেখিনা।
না, তোমার দেখার দরকার নেই।
প্লিজ দাওনা। আমি একটু দেখি। কী সুন্দর রং করেছ,
তুমি বুঝবে না।
আমি দেখব।
খুব কষ্ট পেত চন্দ্র। মাও খুব বকা ঝকা করতেন দিদিকে।
কী হয় বলতো রূপ ছোটবোনটাকে ছবিটা দেখতে দিলে,
ও ছিঁড়ে ফেলবে।
এ কি কথা! তুমি দাও ওকে। ছিঁড়ে ফেললে আমি দেখব তখন।
রাগ করে দিদি ছবিআঁকা কাট্রিজটা ছুঁড়ে মারতো। সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে দেখত চন্দ্র।সেই ছবি দেখে একা একা রং নিয়ে চেষ্টা করত ছবি আঁকার। ওদের তখন খুব আঁকালো। দিদিকে যত নাচের স্কুল ছবি আঁকার স্কুলে দিয়েছে মা চন্দ্রকে তা দিতে পারেনি। হঠাৎ বাবার চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় খুব অনটন শুরু হয় সংসারে। মা একা সংসারটা চালিয়েছে। চাল ডাল নুন তেল আনতে আর স্কুলের বেতন দিতে টাকা ফুরিয়ে যেত। মা খুব কষ্ট পেত রূপকথা চন্দ্রকথার শখগুলো কিংবা নেশার বিষয়গুলোতে তাদের যুক্ত করতে না পেরে। কিন্তু অদ্ভুত একটা বিষয় দিদি ওই বয়সে অনেক কিছু বুঝতো। কোনো বায়না ধরত না। মা যেমন করে বলত তেমন করে পড়ত, মাঝে মাঝে ছবি আঁকত।কিন্তু তাতে কিচ্ছু থেমে থাকেনি। মা তাদের পরম ভালোবাসা দিয়েছিল। দারুণ দীক্ষা দিয়েছিল জীবনের। চন্দ্রও দিদির ছবি দেখে দেখেই অনেক সুন্দর ছবি আঁকা শিখেছে।এমনকি আজ সে দিদির চেয়েও বেশি সুন্দর ছবি আঁকে।
চলবে…