॥দুই॥
শীতের সকাল। ভোরবেলাই আলতো রোদ ঢুকে পড়েছে জানালা বেয়ে একেবারে বিছানায়। সেই আদুরে রোদে আর শুয়ে থাকা যায় না। ঝুপ করে বিছানা থেকে নেমেই এক দৌড়ে রূপকথা চলে আসে বারান্দায়। মা কিছু একটা রান্না করছেন বোঝা যায়। কিন্তু বারান্দায় এসেই তারস্বরে চিৎকার শুরু করে, পাশে দাঁড়ানো ছোট বোন চন্দ্র।
মা মা দেখে যাও। দেখে যাও চন্দ্র কী করেছে?
আমি কিছু করিনি, আমার হাত লেগে গেছে।
চন্দ্রের চোখ উপচানো জল। আর রূপের একটানা ঝারি।
দেখতো কী করেছ। হ্যাঁ। এটা কোনো কাজ? মা আমগুলো রোদে দিল, আর তুমি এগুলো ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে?
আমি ফেলিনি দিদি। আমার হাত লেগে পড়ে গেছে।
ততক্ষণে ঝুমুর এসে দেখে বাড়ান্দায় রেলিংয়ে প্রায় পাঁচ ছয় কেজি কাঁচা আম লবন হলুদ দিয়ে মাখিয়ে রোদে রেখে দিয়েছিল সেগুলোর সব বাইরে পড়ে গেছে। কিছু পড়েছে ভেতরে। তাই দেখে রূপকথা চিৎকার করছে আর ছোটবোনকে বকছে।
কী হয়েছে?
মা দেখো, মা আমি নিচে গিয়ে তুলে আনব আমগুলো?
না না। ওগুলোতে বালিধূলা লেগেছে। আর খাওয়া যাবে না।তুমি শুধু ডালাগুলো নিয়ে এসো।
মা আবার রান্না ঘরের দিকে চলে যান।আর রূপকথা বকতে থাকে চন্দ্রকে
ইস। খালি-খালি খেলেও কত মজা ছিল কাঁচা আমগুলো। সবগুলো উপুড় করে ফেলে দিলেন তিনি।যাই এখন নিচে গিয়ে ডালাগুলো নিয়ে আসি।জলভরা চোখে চন্দ্র।
দিদি আমিও নিচে যাই তোমার সঙ্গে?
না না। তোমার আর যেতে হবে না। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ভাব আরও কী কী ফেলা যায়।
চলে যায় রূপ। পেছনে ভীষণ অপরাধির মতো একা একা দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্র। কিছুক্ষণ পরই আবার বাড়ান্দার গ্রিল ধরে নিচে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে দিদি গেছে নাকি দেখার জন্য আর অমনি মাথা অর্ধেক ঢুকে পড়ে গ্রিলে। মাথা বাইরে বেরও করতে পারে না ভেতরে আনতেও পারে না। কিছুক্ষণ জোর চেষ্টা করে মাথাটা ছাড়ার। কোনোভাবেই পারে না।এই অবস্থায়ই তার মনে হয় এমনিতেই দিদি যে রাগ করেছে, একটু আগে আম ফেলে দেওয়াতে, এখন না জানি মা এসে কী করে। কিন্তু নিচে তাকিয়েই ভয় পেয়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে,
মা, মা আমি পড়ে যাচ্ছি। মা আমি পড়ে যাচ্ছি।
চিৎকার শুনে নিচ থেকে রূপ একবার ওপরে তাকায় আর দেখতে পায় চন্দ্রের মাথাটা আধাআধি। কিন্তু অত কিছু বোঝা যায় না তাতে। চিৎকারটা শুনে তার কিশোরী মনেও কি একটা সন্দেহ দেখা দেয়। ডালাগুলো কোনোমতে হাতে তুলেই দৌড় দেয় সে পাঁচতলার উদ্দেশে। এদিকে পড়িমরি করে ঝুমুর এসে দেখে এই অবস্থা। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েকে শান্ত করবে কিভাবে বুঝে পায় না,
চুপ করো। কিছু হয়নি। এই তো মা চলে এসেছি। কিছু হয়নি মানিক।
সে বেচারা চন্দ্র। ঘাড়টা গোজা করে আধো ভাঙা শরীরের ভঙ্গিতে অমনি দাঁড়িয়ে আছে। ঝুমুর এদিক-সেদিক একটু চেষ্টা করে। বাচ্চার মাথা, তাই জোরও করতে পারে না। যদি খুব আঘাত লেগে যায় ব্রেইনে। কোনোভাবেই ভেতরে আনতে পারে না ওর মাথাটা। কী করবে। পাশের বাসার ভাবিকে ডাকবে? কিন্তু এভাবে একা ওকে রেখে গেলে যদি হঠাৎ আটকাটা ছুটে গিয়ে বাইরে পড়ে যায়?
উহ
মাথাটা বুঝি ছিঁড়েই পড়ে যাবে ঝুমুরের। শিরাগুলোতে রক্তের প্রবাহ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। কোনোভাবেই আর নিজেকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না। ঘরে কেউ নেই। ছোট দুটো মেয়েকে নিয়ে এখন কী করবে? চন্দ্র কেঁদেই চলেছে।
মা আমাকে ছাড়াও। ও মা আমাকে ছাড়াচ্ছ না কেন?
আমি সত্যি বলছি, মা আমি আমগুলো ইচ্ছে করে ফেলিনি। হাত লেগে গেছিল। মা দিদি আমাকে নিচে নিল না। আমি একটু দেখতে চেয়েছিলাম নিচে দিদিকে। মা আমি আর কখনো এমন করব না। মা, ও মা। আমি কি নিচে পড়ে যাচ্ছি?
কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েকে সান্ত্বনা দেয় ঝুমুর,
না না কিছু হয়নি মা। এইতো আমি তোমাকে ধরে রেখেছি। পড়বে কেন। পড়বে না।
তবে আমার মাথাটা কেন ভেতরে আনছ না। মা আমাকে কোলে নাও। ওমা । মাগো । আমি ভয় পাচ্ছি। মা…।
ঝুমুরের বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে। আজে-বাজে নানা চিন্তা মাথায় উঁকি দিচ্ছে। কে আসবে তাকে সাহায্য করতে। এই বিপদের কী সমাধান। এই বাচ্চাটাকে এভাবে রেখে সে কাউকে ডাকতেও যেতে পারছে না। এক সেকেন্ডের অসতর্কতায় ঘটে যেতে পারে সর্বনাশ। তাছাড়া ভর দুপুর। কোনো বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষও নেই যে কেউ একটা মানুষ ডেকে আনবে। গ্রিলটা কাটানোর মিস্ত্রীই বা কোথায় পাওয়া যায়, কে জানে।এমন সময় রূপকথা হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢোকে,
মা মা চন্দ্র. . .
কথাটা শেষ হয় না।
তুমি ওকে একটু ধরে দাঁড়িয়ে থাকো তো। একদম ছাড়বে না। ঠিক আছে? পা দুটো শক্ত করে। হ্যাঁ ঠিক এভাবে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। ছাড়লেই কিন্তু নিচে পড়ে যেতে পারে। সাবধান। আমি আসছি বলেই এক ছুটে মা বের হয়ে গেল।
চন্দ্র দিদির গলা শুনেই আবারও কেঁদে ওঠে,
দিদি। ও দিদি। আমি আর কখনো তোমাকে দেখতে নিচে উঁকি দেব না। আমাকে বের করো। দিদি ই ই ই…
আহারে। ছোট বোনটার জন্য এখন খুব মায়া লাগতে থাকে রূপকথার। আহা কি ভুলটাই না হয়েছে। তখন যদি নিচে নিয়ে যেত। মনে মনে নানা ভাবনা উঁকি দেয়।
ইস কত কষ্ট পাচ্ছে। চন্দ্র, ছোট বোনটা আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে?
হ্যাঁ দিদি। আমাকে কোলে নাওনা।
মনে মনে ভাবে রূপকথা,
আমি কি একটু চেষ্টা করব। চন্দ্র তুমি একটু শক্ত হয়ে থাকতে পারবে? আমি একটু তোমার মাথাটা বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে দেখি?
না না। মা বলেছে আমার পা ছেড়ে দিলে আমি পড়ে যাব। দিদি আমার মাথায় খুব ব্যথা করছে।
রূপকথা উঁকি দেয়। মাথার দু’পাশে যেখানে গ্রিল আটকে আছে সে জায়গা দু’টো লাল হয়ে গেছে…
আহা
এমন সময় পাশের বাসার এক আন্টি আর মা একসাথে ঘরে বারান্দায় আসে হন্তদন্ত হয়ে। মা ডেকে এনেছে।
দেখি দেখি…
কি অদ্ভুত কাণ্ড। আন্টি বাইরে থেকে একবার কেমন করে জানি মাথাটা উল্টে ঠেলল, কানদুটো মুড়িয়ে ধরতে বলে রূপকথাকে। আর অমনি মাথাটা ভেতরে চলে এলো। মা এক দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিলেন চন্দ্রকে।
চন্দ্র তখন একটানা মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদেই চলছে,
মা আমি আর কখনো বাড়ান্দায় যাব না। কখনো আম ফেলে দেব না। কখনো নিচে তাকাব না।
না না কেন যাবে না। অবশ্যই যাবে। কোনো সমস্যা হয়নি। কিচ্ছুটি হয়নি। এইতো কত সুন্দর আছ। ভালো আছ।
তবে একটু সাবধানে। হ্যাঁ?
সঙ্গে-সঙ্গে চন্দ্র মায়ের কোলে লাফ দিয়ে উঠে বসে,
মা সাবধান কী?
আর অমনি রূপকথা হেসে ওঠে। সঙ্গে মাও। নিজেকে এই মুহূর্তে প্রত্যেকেরই খুব হালকা লাগতে শুরু করে। রূপকথাও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে। তার মনে হয় একটু হিংসে হচ্ছিল বোনের এত আদর দেখে। মা সেটা বুঝতে পারে। মা রূপুকেও বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে।
চলবে…