[পর্ব-৭]
পড়ন্ত বিকেলের ঘোরলাগা আলো মেখে, লালনের আখড়ায় অলস, অর্থহীন বসে ছিল তরুণ। বিড়িতে গাঁজা ভরে টানছিল জোর। বিকেলটা ভারী সুনসান আজ। অহেতুক উৎপাত নেই। সাঁইজির আখড়ায় বেশ কিছুদিন আবাস গেড়েছে সে। গেরুয়া বসন, হাতে একতারা আর লম্বা চুল-দাড়িতে তাকে খুব আপনজন ছাড়া কেউই চিনতে পারে না আজকাল। সংসার তাকে বাঁধতে পারেনি। কিংবা সে-ই জড়ায়নি সংসারের মায়ায়। মাজারের উল্টোপাশের ডোবাপুকুর পাড়ে বসে পুকুরের কালো, ঢেউহীন জলে সে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখছিল। লাল, গাঢ় লাল বৃত্তটা চুপটি করে মুখ দেখছে দিঘির শান্ত শীতল জলে। যেকোনো মুহূর্তে হারিয়ে যাবে। ফুরিয়ে যাবে রাতের কালো উদরে। আজকাল নিজের মনে আর কোনো অশান্তি নেই তরুণের, কোনো চঞ্চলতা নেই। বুকের ভেতর ভারী শান্ত, থিরথিরে এক বোধ জন্মেছে। সাঁইজির দর্শন, না কি সিদ্ধির ঘোর সে অবশ্য জানা নেই তার। শুধু এটুকু জানে, বুকের মধ্যে যে ক্রোধের আগুনটা ফুঁসছিল, সাপের মতো হিংস্র ফণা তুলে যে প্রতিশোধস্পৃহা পাগল করে তুলছিল তাকে অহর্নিশ, সে আগুন নিভে গেছে, সে সাপ শীতনিদ্রায় গেছে। এখন সে শান্ত, স্থির। ছোটকাকাকে সে ক্ষমা করেছে। ক্ষমা করেছে জোহরাকেও।
এখানে তাকে সবাই চেনে তরুণ বোষ্টম নামে। বোষ্টমদের পূর্ব-পরিচয় জানতে নেই। কেউ জানতে চায়ও না। এখানে লোকজন আসে বাউলগান শুনতে, ভেদ-অভেদের তত্ত্বালোচনা শুনতে। আসে বাউল দর্শন জানতে। সে সবের তেমন কিছুই মূলত জানে না তরুণ। তার এই না জানা সে পুষিয়ে দেয় গান আর একতারার সুরে। কখনো বা ঝোলা থেকে লম্বা বাঁশিতে সে সুর তোলে অদ্ভুত। দর্শনার্থীরা মোহাবিষ্ট হয়, মুগ্ধ হয়। তার চেহারা আর পোশাকেও অনেকটাই কেটে যায় না জানার দৈন্য। এ সংসার সঙ পছন্দ করে, সার নয়। চটক হলেই তার চলে, ভেতরে ফাঁপা হোক, ক্ষতি নেই।
তারা বোষ্টুমী এসে বসে পাশে, চোখের কোণায় দেখে তরুণ। কিছু বলে না। নীরবে একতারায় সুর তোলে টুংটাং। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে দুই-এক কলি। এক একদিন এক একটা গানে সে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আজ তাকে আচ্ছন্ন করেছে, মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষেরই সনে…
জীবাত্মা ছেড়ে পরমাত্মায় মিশে যাওয়ার আকুলতা তরুণের কণ্ঠে ঝরে ঝর্ণার মতো, তার আকুল উদাস সুরে আচ্ছন্ন, বুঁদ হয়ে যায় শ্রোতাদের মন।
সকাল থেকেই আজ গানটা গুনগুন করে উঠেছে, একতারায় সুর তুলেছে তরুণ। দর্শনার্থী আজ ছিল না তেমন। যে দুই-চারজন ছিল, তাদের সে এ গানটাই শুনিয়েছে আজ। অন্য গানের অনুরোধ এলে দেখিয়ে দিয়েছে অন্য আরও বাউলদের। এখানে তার মতো আরও যারা বাউল আছে, সবাই তারই মতো। সংসারের মায়া আটকাতে পারেনি তাদের। ছন্নছাড়া, উড়ন্ত পাখি সব। দুই দিনের পান্থশালায় তারা কেউ কোথাও নোঙর ফেলেনি স্থির। স্বাধীনভাবে ঘুরছে, উড়ছে। যে শরীরের খাঁচায় বন্দি আছে এক অচিন পাখি, তার স্বরূপ জানার চেষ্টায়ই কেটে যাচ্ছে তাদের ব্যস্ত সময়। কিন্তু এ খাঁচার দাবিও বড় কম নয়। অগ্রাহ্য করা যায় না কিছুতেই। অচিন পাখি যে খাঁচায় আশ্রয় নেয়, সে খাঁচাকে যত্ন করতে হয়, নইলে পাখি ফুরুৎ। খাঁচাকে তাই জল দিয়ে, আলো দিয়ে, হাওয়া দিয়ে পরিচর্যা করতে হয়, পূজা করতে হয়। অরূপের সন্ধানে রূপকে পবিত্রজ্ঞানে ভজতে হয়। রূপের মাঝেই অরূপের বিস্তার। রূপকে আশ্রয় করেই বিকাশ তার। অরূপকে পেতে তাই রূপকে অবজ্ঞা করলে চলে না। সাঁইজি বলেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি! রূপের সাধনেই অরূপ মেলে।
—কী গো সাধু! আইজ যে চুপ কইরে আছ বড়? মন খারাপ নাকি গো তুমার?
তারার কথায় কিছুক্ষণ চুপ থাকে তরুণ। তারপর দিঘির জলে চোখ রেখেই ধীর, শান্ত কণ্ঠে বলে, এ কথা কও ক্যান তারা? মন কী জন্যি খারাপ হবি আমার?
—সকালেত্তে দেখতিছি মনডা কেমুন ব্যাজার কইরে রাখছ, তাই জানতি চাচ্ছি।
—কবে আমারে খুশিতি বাক-বাকুম নাচতি দেহিচো তুমি কওদিনি?
—তুমি খালি ত্যেরা কথা কও সাধু! তুমার মনডা যে ভালো নাই আইজ, সিডা বেশ বুঝা যাতিছে। যতই লুকাতি চাও।
তরুণ কথা বলে না কোনো। সে আপন মনে গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে, মন রে কৃষি কাজ জানো না…
তারা মুগ্ধ হয়ে শোনে। সে নিজেও খুব ভালো লালনের গান গায়। এ অঞ্চলে তারা বোষ্টুমি নামে তাকে এক নামে চেনে সবাই। তার গানের টানে ছুটে আসে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ। কিন্তু তরুণের কণ্ঠে অন্যরকম একটা কিছু আছে। মোহগ্রস্ত করে, ধ্যানস্থ করে দেয়। মনে হয় অন্যলোক থেকে ভেসে আসে সুর। অন্য জগৎ থেকে নেমে আসে শীতল ঝর্ণাধারা।
তরুণ গান করে। হৃদয় মথিত করে সে সুর। কিন্তু তার ভেতরে আজ অন্যরকম বোধ নাড়া দেয়। তারা ঠিক বলেছে। তার শান্ত স্থিরতায় সামান্য ফাটল ধরেছে, কিঞ্চিৎ চির দেখা দিয়েছে আজ। সিদ্ধির পরিমাণটা তাই একটু বেড়েছে হঠাৎ। এক দর্শনার্থী তার মগ্ন চৈতন্যে শীষ তুলেছে ঈষৎ। বুকের মধ্যে কেমন একটা ঢেউ তুলেছে ছলাৎছল। অথচ সে ভেবেছিল সব চুকেবুকে গেছে। ভেবেছিল ভুলে যাওয়া গেছে সবকিছু। কিন্তু এই পঞ্চাশের কোটা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেও, শুভ্র সাধুর বসন আর চুল-দাড়িতে নিজেকে ঢেকে ফেলেও দেখা যাচ্ছে বুকের ভেতর কোথাও একটু ঘুমিয়ে আছে সেই বিটকেলে বোধ। অদ্ভুত তো। খাঁচার দাবি তো মিটছে হামেশাই, অচিন পাখিটাও অভুক্ত নেই, তবু এ কোন খিদে ঘুমোয় তার আটকুঠুরী নয় দরজার খাঁচায়! এ কোন সর্বনেশে অনুভূতি তাকে পর্যুদস্ত করতে চায় হঠাৎ! এ ঘোর শত্রু তার। এ বোধকে গলা টিপে মারতে হবে এখন, এখনই!
সে হঠাৎ ক্ষ্যাপাটে, ঘোরলাগা চোখে তাকায় তারার চোখে। জ্বলজ্বলে, বড়বড় চোখদুটো তারার চোখে রেখে বলে,
তোমারে চাই বোষ্টুমী!
তারা হঠাৎ বুঝতে পারে না তরুণকে। কিংবা বিশ্বাস করতে পারে না তাকে। তরুণকে সে চেনে। তরুণ লম্পট নয়। অন্যদের থেকে আলাদা। ভীষণ আলাদা। সে তাই অবাক, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, কী কও সাধু?
—বোঝো না কী কই? তোমারে চাই, এখন! বড় কষ্ট!
তারা যতটা অবাক হয় তার চে’ বেশি চমকায়। এখানে শরীর নিয়ে শূচিবায়ুতা নেই কারও, থাকতে নেই। কিন্তু তরুণ আলাদা। সে এখানে এসে অব্দি কামনা করেনি কাউকে। তাকে কামনা করেছে অনেকেই। এমনকি তারাও। কিন্তু কখনো সাড়া দেয়নি তরুণ। আজ তার কী হলো হঠাৎ!
—কী হইল তারা? কষ্ট কমাও আমার!
তারার ইচ্ছে হয় একবার, বলে, আমারও তো কত কষ্ট সাধু! কতবার চেয়িচি তুমায়! কই কমাওনি তো! বলে না তারা। চেপে যায়। অন্যদিকে চোখ রেখে, গলা নামিয়ে বলে, আইসো!
সেই ভর সন্ধ্যায় তারার খাঁচায় নিজেকে পুরে, মনে মনে নিজেকেই শাপ-শাপান্ত করে তরুণ। চোখ বেয়ে জল গড়ায় ঝরঝর। না, জোহরা চিনতে পারেনি তাকে। বর নিয়ে, সন্তান নিয়ে, গাড়ি চেপে সাঁইজির গান শুনতে এসেছিল সে। দূর থেকে তাকে দেখে বুকের ভেতর পাখিটা কেমন ডানা ঝাপটে উঠেছিল। ডেকে উঠেছিল করুণ সুরে। তারার শরীরে সে ঢেলে দিতে চায় সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা। কাটাতে চায় মায়ার সুতো।
চলবে…
ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৬॥ শিল্পী নাজনীন