[পর্ব-২০]
বাইপাস সার্জারির পর থেকে শরীরটা একদমই ভালো যাচ্ছে না মুজতবা খানের। প্রেসারটা ওঠানামা করছে খুব। কিডনি আর লিভারের অবস্থাও সঙ্গীন বলে জানিয়েছে ডাক্তার। কিডনিতে ক্রিটিনিনের পরিমাণ অনেক বেশি, রক্তে কোলেস্টরেল হাই। কিছুই খেতে পারছেন না প্রায়। অবশ্য তার খাদ্যতালিকা এতটাই সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে যে খাবার ইচ্ছেটাও আর নেইই বলতে গেলে। কিন্তু বাঁচার ইচ্ছে তার ষোলো আনা আছে এখনো। আরও অনেকদিন বাঁচতে চান তিনি। ডাক্তারকে বলেছেনও সে কথা। বলেছেন, যা টাকা লাগে নিন। শুধু আমাকে সুস্থ করে দিন।
উত্তরে অল্পবয়সি, টাকমাথা ডাক্তারটা তার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলেছে, আল্লাহকে ডাকুন। আমি সুস্থ করার কেউ নই।
ডাক্তারের কথায় মাথায় রক্ত চড়ে গেছিল মুজতবা খানের। ব্যাটা হারামজাদা! সব কাজ যদি আল্লায়ই করবি তালি পরে তুই সুমন্দির ছাওয়াল কোন বালের ডাক্তার রে?—কথাগুলো মনে মনে বললেও, মুখে কাষ্টহাসি টেনে কাতরভাবে বলল, সে তো অবশ্যই ডাক্তার সাব! তবু আপনি চেষ্টা করলেই হবে। টাকা-পয়সা কোনো সমস্যা না। আপনি টাকা নিয়ে চিন্তা কইরেন না।
টাকা নয়, আমি আপনার শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা করছি। অনেক অনিয়ম করেছেন, এবার সাবধান হন। অতিরিক্ত উত্তেজনা, চিন্তা আপনার জন্য ক্ষতিকর। খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়ম মেনে চলবেন। ধুমপান, মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষেধ। বেশি কথা বলাও আপনার জন্য ক্ষতিকর। পুরোপুরি বিশ্রামে থাকবেন এখন থেকে। টাকা দিয়ে সব হয় না, বুঝেছেন?—বলে বেত্তমিজ চ্যাংড়া ডাক্তারটা গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল তার কেবিন থেকে।
শুনে ভয় ধরে গেছিল মনে। ডাক্তারের ওপর মেজাজও খারাপ হয়ে গেছিল খুব। এলাকায় তাকে এক নামে চেনে সবাই। তার নামে এখনো লোকে ভয়ে কাঁপে। আর দুই পয়সার ডাক্তার ছেমড়া কয় টাকা দিয়ে নাকি কিছুই হয় না। জীবন চেনে না চ্যাংড়া। চিনলে বুঝতো টাকা দিয়ে হয়। সব হয়। সে দেখেছে, হয়।
মুরগির তেল-মসলা ছাড়া পাতলা ঝোল আর গলাভাত তার এ বেলার খাবার। আম্বিয়া টেবিলে খাবার রেখে রান্নাঘরে ব্যস্ত।
মুজতবা খান খেতে বসলেন। গলা দিয়ে নামতে চায় না। এ খাবারে তিনি অভ্যস্ত নন। তার পছন্দ মসলাদার খাবার। অতিরিক্ত তেল মসলা সহযোগে ভুনা মুরগি আর চালের আটার রুটি তার প্রিয় খাবার। গরুর গোস্ত তার পাতে সপ্তায় অন্তত একদিন দিতেই হবে। নইলে চলে না একদম। সেই তাকে খেতে হবে ঝাল-মসলা-তেল ছাড়া সেদ্ধ তরকারি। সবজিও সব নয়। বেছে বেছে নির্দিষ্ট কয়েকটা সবজি সে খেতে পারবে। লাউ, পেঁপে আর ঝিঙে জাতীয় দুনিয়ায় যত পানসে সবজি আছে সব তার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ব্যাটা হারামজাদা ডাক্তার। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে তার। সব ওই দোষ ব্যাটা ডাক্তারের। ব্যাটা বদমাশ! সব যদি নিষেধই থাকবে তাইলে তুই ব্যাটা ডাক্তার কিসের রে! ডাক্তার হয়ে কী বালটা ছিঁড়তে শিখলি তাইলে তুই?
মনে মনে গজরায় মুজতবা খান। শরীরটা একটু ধাতস্থ হলেই ভারতে যাবে সে। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আসবে। এই দেশে বাইপাস সার্জারি করাটাই মস্ত একটা বোকামি হয়ে গেছে তার। উচিত ছিল সোজা ভারত চলে যাওয়া। সব নষ্টের গোড়া ওই বিলটু হারামজাদা। সে বললো, আব্বা, ঢাকায় আমার পরিচিত ভালো ডাক্তার আছে, উনার কাছে নিয়ে যাই আপনাকে, আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি।
ছেলের কথায় বিশ্বাস করে তার ভালো ডাক্তারের নমুনা তো মিললো। বাইপাস সার্জারি হলো, এক কাঁড়ি টাকাও গেলো, মাঝখান থেকে সব খাওয়া নিষেধ, রাজ্যের নিয়মকানুন মানার হুকুম আর সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার বিদায় করলো তাকে। ডাক্তারের না কি কিছু করার নেই, যা করার সব আল্লাহ করবেন। ওরে ব্যাটা বদমাশ, সব যদি আল্লাহই করবে তাইলে তুই অতগুলা টাকা নিয়ে বাইপাসই বা করতে গেলি কেন? আল্লার ভরসায় ওইটাও ফেলায়া রাখতি! ব্যাটা বজ্জাত কোনেকার!
দাঁতের নিচে সেদ্ধ মুরগির বিস্বাদ রান রেখে চিবুতে চিবুতে ছেলে বিলটুকে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করতে থাকেন মুজতবা খান। আম্বিয়া অদূরে দাঁড়িয়ে বলেন, ডাক্তার আপনেক কম কতা কতি কয়চে। মিজাগ ঠান্টা রাখতি কয়চে।
মিজাগ ঠান্টা রাইকপের কয়চে, তেয় না? যেই দেহোচো ছাওয়ালেক গাইলেতিচি অমনি তুমার ডাক্তারের কতা মনে পড়েচে, তেয় না? সপ তুমার ছাওয়ালের শয়তানি, বোচ্চ? আমি চোখ বুঁজলি পরে তুমাক লাত্তি দে বাড়িত্তে বাইর করে সপ সম্পত্তি হাতা নিবি, এসপ তারই ধান্দা, বুইজলে? প্যাটে তো মানুষ থোও নাই কো, সাপ রাহোচো দুইডে। যেম্মা তুমার ছাওয়াল কাল কেউটে, সেম্মা তুমার মিয়াডাও কাল নাগিন। আমি মরলি তারা বাঁচে। কিডা জানে, তুমু বাঁচো কি-না!
কী কতা কন!—বলে আঁচলে চোখ মোছেন আম্বিয়া। ধরা গলা। স্বামীর সামনে এখনো ঘোমটা পড়ে না তার, স্বামীর পায়ের নিচে যে বেহেস্ত, তাতে তার অটল বিশ্বাস, অনড় আস্থা।
হাত ধুয়ে আধপেটা উঠে পড়েন মুজতবা খান। উঠতে গিয়ে টাল খেয়ে যায় শরীর। মাথা ঘুরে ওঠে। চেয়ারের হাতল ধরে টাল সামলে নেন। প্রায় টলতে টলতে হাঁটতে থাকেন নিজের ঘরের দিকে। আম্বিয়া খাতুন দৌড়ে আসেন। মুজতবা খানকে ধরে নিয়ে শুইয়ে দেন বিছানায়। শুয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলেন মুজতবা। হাঁপান। কদিন থেকে একটু কথা বললে, হাঁটাচলা করলেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে খুব। একটু সুস্থির হয়ে তিনি কড়া গলায় আম্বিয়াকে হুকুম করেন, সিগারেট আর লাইটারডা নিয়াসো।
আম্বিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, আপনের দুহাই লাগে, ওসপ খাবেন না কো। ডাক্তার বারণ করেচে। কয়ডা দিন মানেন। ইটু সুস্ত অলি পরে সেহন নায় খাবেনআনে আবার।
যা কইচি তাই করো। নায়তে আমিই উটতিচি কলাম। উটে খুঁজে নিবের পারবনে আমু।—বলে নিজেই উঠতে যান বিছানা ছেড়ে। বাধ্য হয়ে আম্বিয়া খাতুনই এনে দেন। সিগারেট জ্বেলে, বড় করে টান দেন মুজতবা খান। বুক ভরে টেনে নেন ধোঁওয়া। সঙ্গে সঙ্গে বেদম কাশি শুরু হয়। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে প্রায়। দৌড়ে এসে টান দিয়ে সিগারেট কেড়ে নেন আম্বিয়া, ফেলে দেন দূরে। মুজতবা খান কাশির দমকে তখনো দিশেহারা। তাকে জাপটে ধরে শুইয়ে দেন বিছানায়। আস্তে আস্তে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস। বড় করে দম টানতে টানতে বলেন, দেহিচো তো, তুমার ছাওয়াল ডাহায় তার পরিচিত ডাক্তারেক দিয়ে কী সব্বনাশটা কইরে দেচে আমার, দেহিচো? মাইরেই ফেলেচে পিরায়। এটা বিড়ির ছাতা, তা-ও খাইবের পারতিচিনে এহন!—গলা ধরে আসে মুজতবা খানের। জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। আম্বিয়া খাতুন কান্না চেপে বলেন, কী পাগলের মতো কতা কন। ছেঁড়াডা আপনের বালোর জন্যি কত চিষ্টা কইরতেচে, আর আপনের খালি কুচিন্তা মনে। অসুস্থ অয়চেন, এহুন নিয়ম তো ইটু মানাই লাগবি। তা না অলি সুস্ত অবেন কেবা কইরে? ওসপ আর খাবেন না কো। জান আগে, না ওসপ খাওয়া আগে, শুনি?
বিছানায় নেতিয়ে পড়েন মুজতবা খান। কথা বলার শক্তি নেই আপাতত। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে বড় ভাই হাবিবুর রহমান খানের মুখ। শেষ দিকে ক্ষেপে উঠেছিলেন। শেকল কেটে বেরোতে চাইতেন খুব। না পেরে অভিশাপ দিতেন, শাপ-শাপান্ত করতেন। পাগলের অভিশাপের কোনো মূল্য নেই, মুজতবা খান জানেন। তবু মাথার মধ্যে ঢুকে যান বড়ভাই হাবিবুর রহমান। একনাগাড়ে বলে যেতে থাকেন, পতে পইড়ে মরবি তুই! শাস্তি পাবি সপ শয়তানির। মরলি পানি পাবি নে মুহি একফুঁটা, মাটি পাবি নে কব্বরের, এই কয়া থুলাম, দেহিস। মরণকালে কেউ থাকপি নে পাশে। কুত্তোর মতো পতে পইড়ে মরবি তুই, লেহে থো, খাতায়! সপ বেইমানির ফল পাবি আতে-নাতে।
মুখ থুবড়ে বিছানায় পড়ে থাকেন মুজতবা খান। মাথার মধ্যে অবিরাম বকে চলেন উন্মাদ হাবিবুর রহমান খান। নিজেকেও হঠাৎপাগল পাগল লাগে মুজতবা খানের। ভয় এসে খামচে ধরে বুক।
চলবে…