[পর্ব-দুই]
দিনটা কেটে গেলো শোকে-সন্তাপে। ঘরময় কান্না, ফিসফাস, কোলাহল, ব্যস্ততা, লোকাচার, ছড়িয়ে ছিল সারাদিন। লতিফা বানুর লাশ খাটিয়ায় তুলে যখন বাদলসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন পা বাড়ালো তার অন্তিম ঠিকানা অভিমুখে, তার কিছুক্ষণ বাদেই একে একে পাতলা হতে শুরু করলো ভিড়। হালকা হতে শুরু করলো বাড়ি। একইসঙ্গে শোকটাও যেন হঠাৎ করেই হালকা হয়ে এলো অনেকটাই। যেন বুকের ওপর চেপে থাকা পাথর কয়েকগুণ ভার হারালো সহসা। বাতাসে ভেসে থাকা শোকটা যেন লহমায় বেশ একটু মিলিয়ে গেল শূন্যে। বাড়িটা ধুয়ে-মুছে পাক-সাফ করার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। সেইসঙ্গে তাগাদা আসতে থাকলো বাড়ির সব নারীর স্নান সেরে নেওয়ার। পুরুষরা সবাই লতিফা বানুর লাশ কবরস্থ করতে তখনো বাইরে, ব্যস্ত। অরুন্ধতীকে স্নান করিয়ে নিজেও স্নান সেরে নিলো তিতলি। মেয়েটা হঠাৎ নামা এই শোকে মুষড়ে পড়েছে খুব। শুকনো মুখে ঘুরছে তিতলির পেছন পেছন। লতিফা বানুর সঙ্গে খুব হৃদ্যতা ছিল না তার। লতিফা বানু সেকেলে মানুষ ছিলেন, অরুন্ধতীকে তিনি শাসন করতে চাইতেন। তাছাড়া তিনি যে তিতলিকে পছন্দ করেন না, এটা বুঝত অরুন্ধতী। তার শিশুমনে স্বাভাবিকভাবেই লতিফা বানুর প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব তৈরি হয়েছিল। তিতলি চেষ্টা করেও ঘোচাতে পারেনি সে দূরত্ব। তবু ভালোবাসা ছিল, থাকেই। লতিফা বানুর হঠাৎ এই চলে যাওয়ায় কেমন ধাক্কার মতো খেয়েছে মেয়েটা। লতিফা বানুকে নিয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছে খাটিয়া, মেয়েটা এমন কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিল যন্ত্রণায়, এমন ভেঙে পড়ছিল কান্নায়, যে তিতলি তাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠেছিল ডুকরে। সেই কবে, কোন ছোটবেলায় নিজের হারিয়ে যাওয়া মাকে মনে করে ঠিক এমন করেই কেঁদেছিল তিতলি। মনে পড়তেই কান্নার বেগ প্রবল হয়েছিল আরও।
অরুন্ধতীকে খাইয়ে সে অপেক্ষা করছিল বাদলদের ফেরার। অপেক্ষা করছিল অন্যরাও। তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে প্রায়। বাড়ির ওপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া, আম আর নারকেল গাছগুলো তাদের বিষণ্ন, দীর্ঘ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। বাড়ির বাসিন্দাদের শোকে, কষ্টে, মূহ্যমান, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একটু একটু মাথা দোলাচ্ছিল থেকে থেকে। যেন ইশারায় সেরে নিচ্ছিল নিজেদের প্রয়োজনীয় আলাপন।
সারাদিনের শোকের ক্লান্তি আর লৌকিকতার শ্রান্তিতে তার অবসন্ন শিশুমন হাঁপিয়ে ওঠে। শেষে তিতলির কোলের কাছে গুঁটিশুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা।
প্রায় নীরবে, নিজেদের ভেতরকার শোকটাকে যত্নে বুকের মধ্যে পুষে রেখে, একসঙ্গে বসে, অতপর পরিবারের জীবিত সদস্যরা সেরে নিচ্ছিল খাওয়া নামক প্রাতঃকৃত্যটি। গলা দিয়ে কারও-ই নামতে চাইছিল না খাবার।
তবু ক্ষুধা নামক বস্তুটি রেহাই দেয় না কাউকেই। নিজেদের অজান্তেই, বাঁচার প্রয়োজনে গিলে নেয় দুই-চার গ্রাস যে যার মতো। সঙ্গে সঙ্গে লতিফা বানুর মৃত মুখটি মনে পড়ে, তার স্মৃতি চোখে ভেসে গলার কাছে অনেকেরই আটকে আসতে চায় খাবার। অনেকেরই চোখ থেকে দুই চার ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে সামনে, প্রায় অভুক্ত পড়ে থাকা ভাতের থালায়।
তারপর এক আশ্চর্য, নিথর সন্ধ্যা নামে। বিষণ্ন, স্যাঁতসেঁতে, ন্যাতানো। বাড়িময় কী এক চাপা উদ্বেগ, ভয় আর অস্বস্তি ভেসে বেড়ায়। সারা ঘরে উড়ে বেড়ায় আতর, আগরবাতি, লোবানের দমবন্ধ করা, হাঁফ ধরানো ঘ্রাণ। নিয়ন আলোও দূর করতে ব্যর্থ হয় সে বিষণ্নতা মোড়ানো শোক, লৌকিকতা জড়ানো আঁধার। উজ্জ্বল সে আলোর মধ্যেও বেহায়া, নির্লজ্জের মতো দাঁত বসিয়ে দেয় তারা, সবার চেহারায় এঁকে দেয় তার অমোচনীয় ছাপ।
অরুন্ধতী ছটফট করে। সারাদিনের শোকের ক্লান্তি আর লৌকিকতার শ্রান্তিতে তার অবসন্ন শিশুমন হাঁপিয়ে ওঠে। শেষে তিতলির কোলের কাছে গুঁটিশুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। তার চোখে তখনো জলের দাগ, কান্নার স্পষ্ট চিহ্ন জেগে থাকে, তিতলির বুকের মধ্যে কেমন হু হু করে ওঠে। বাদল তখন অরুন্ধতীর পাশে শুয়ে কড়িকাঠ গোনে, স্থির, অনড়। চোখ ফোলা, লাল। সারাদিন তিতলির সঙ্গে একটি কথাও বলেনি সে। অভিমান, ক্ষোভ, রাগ। তিতলিও চেষ্টা করেনি। তার নিজের মধ্যেও কি অপরাধবোধ ঘাই মারছে? আঁতিপাতি করে নিজের মনের গলিঘুপচি, গলি, তস্যগলি হাতড়ে বেড়ায় তিতলি। না, নেই। অভিমান, রাগ, ক্ষোভ সবই আছে। অপরাধবোধ নেই। স্বস্তিতে নিজেই মাথা নাড়ে। কখনো অকারণে কাউকে কষ্ট দেয়নি। দিতে চায়ওনি। তার বুকের মধ্যে টলটলে আরও একটা বস্তুর অস্তিত্ব সে টের পায়। ভালোবাসা। নিখাদ। লতিফা বানুকে সে ভালোবাসতো। বাদলের মা হিসেবে, মানুষ হিসেবে। কিন্তু ভালোবাসা মানেই তার অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়। কখনোই নয়। আর আশ্চর্য এটাই যে, অধিকাংশ মানুষেরই মনে থাকে না এই সহজ সত্যটা। লতিফা বানুরও থাকতো না। বাদলের অন্যায় আবদারে প্রশ্রয় দিতেন তিনি। তাতে যে অন্যের ওপর, তিতলির ওপর অন্যায় করা হচ্ছে, সেটা বুঝতেন না, কিংবা বুঝতে চাইতেন না। কিন্তু এটাও ঠিক, তিতলিকে ভালোবাসতেন তিনিও। অরুন্ধতীকেও ভালোবাসতেন খুব। কিন্তু স্নেহ বরাবর নিম্নগামী। অরুন্ধতী দাদুকে পছন্দ করতো না। এড়িয়ে চলতে চাইতো।
রুমকীকে স্কুলে দিয়ে অফিসে অনেকটা দেরি হয়ে যায় তুলির। প্রতিদিন প্রায়। বসের বিরক্তি উপেক্ষা করতে হয় না বুঝার ভাণে। জীবনটা কী যে বিশ্রী! আর রুমকী! মেয়েটার মধ্যে একদম দায়িত্বজ্ঞান নেই। দীপনকে বললে সে হেসেই উড়িয়ে দেয় মেয়ের সব অনাচার। বলে, ছোট তো! ঠিক হয়ে যাবে, ধৈর্য ধরো! কবে ঠিক হবে কে জানে! রুমকী দেখতে দেখতে আটে পড়লো এবার।
অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই বসের রুমে ডাক পড়ে। থমথমে, মেঘযুক্ত মুখে তুলির হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে দিয়ে বলেন, মন দিয়ে দেখো, তারপর রিপোর্টটা তৈরি করে দাও! কুইক!
কী যে এত ব্যস্ততা তার! কখনোই ফোন করলে একবারে পাওয়া যায় না তাকে। চারবারের চেষ্টায় ওপাশ থেকে দীপনের ব্যস্তসমস্ত কণ্ঠ শোনা যায়—হ্যালো!
মুখ বুজে ফাইলটা নিয়ে রুমে এসে আয়েশ করে বসে তুলি। এসিটা ছেড়ে দেয়। মার্চের গরম। বাইরে ভয়ঙ্কর রোদ। ফাইলটা নেড়েচেড়ে দেখে। ফালতু। মেজাজ খারাপ থাকলে এমন উটকো কিছু কাজ ধরিয়ে দেন বস। দেরি করে আসার শাস্তি। অথচ এই সামান্য একটু দেরি করে আসাটা বাদ দিলে অফিসের কোনো কাজেই সে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয় না, সে কথা বসও বেশ ভালোই জানেন। তবু, বসগিরি ফলাতে হবে, আর কী! বিড়বিড় করে তুলি। বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডেকে বেশ করে ধমকে দেয় অকারণেই। বসের ওপর রাগটা কমাতে হবে যেকোনোভাবে। নইলে মন বসছে না কাজে। পিয়নকে বলে চা দিতে। চা মুখে দিয়েই মুখ আরও বিকৃত হয়ে যায়। এমন জঘন্য চা-ও খেতে পারে মানুষ! পিয়নকে আর একপ্রস্থ বকে ফাইলে মন দেয় সে। ডুবে যায় কাজে। কতক্ষণ কাজ করে সে খেয়াল থাকে না আর। হঠাৎ ফোনের শব্দে চমকে মুখ তুলে দেখে, ময়না। ময়না কেন ফোন করল হঠাৎ? এ সময় তো ফোন করার কথা নয় তার! ঘড়ির দিকে চোখ চলে যায়, পৌনে একটা! তার মানে, একটানা আড়াইঘণ্টা কাজ করেছে সে। যথেষ্ট। ফোনটা নিয়ে কলব্যাক করে তুলি। একবার রিং হতেই ময়নার গলা, হ্যালো আফা!
—হ্যাঁ ময়না, কী হয়েছে বল!
—আফা, রুমকী মামনিরে আনতে যামু, ভাইজানে কয় আমার নাকি যাওন লাগতো না, ভাইজানেই আনতে যাইবো! কী করুম, আফা?
মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়ে ওঠে তুলি। চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একটু ভেবে, কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে, আচ্ছা, তোকে যেতে হবে না। উনিই যাক। ড্রাইভারকে বলিস সাবধানে থাকতে। রুমকী ফিরলে ফোন দিস আমাকে।
—আইচ্ছা আফা। দিমুনে।
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে তুলি। একটা অস্বস্তি খচখচ করে মনের মধ্যে। কী করবে ভেবে পায় না। শেষে আনমনেই দীপনের নাম্বারে রিং দেয়। ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। ফোন ধরে না দীপন। কী যে এত ব্যস্ততা তার! কখনোই ফোন করলে একবারে পাওয়া যায় না তাকে। চারবারের চেষ্টায় ওপাশ থেকে দীপনের ব্যস্তসমস্ত কণ্ঠ শোনা যায়—হ্যালো!
—হ্যালো!
তুলির ভারী, গম্ভীর কণ্ঠে হয়তো কিছুর আভাস পায় দীপন। সে ত্রস্তকণ্ঠে বলে, কী হয়েছে? এতবার ফোন দিচ্ছ যে?
—ভাইয়া রুমকীকে স্কুল থেকে আনতে যাবে বায়না করছে, ময়নাকে যেতে নিষেধ করছে।
—বলো কী! তুমি কী বলেছ?
—আমি কী বলবো? উনাকে নিষেধ করলে তো শুনবে না। ময়নাকে বলেছি যেতে দিতে, ড্রাইভারকে সাবধানে থাকতে বলেছি। তুমিও ফোনে বলে দাও।
—আচ্ছা। আমি দেখছি। তুমি চিন্তা করো না। ভাইয়া তো এখন অনেকটা সুস্থ।
—সেটাই ভয়ের। উনি কখন যে সুস্থ থেকে আবার অসুস্থ হবেন, সেটা তো কেউই জানি না, তাই না? রুমকীটাকে আমি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই না।
—চিন্তা করো না, আমি দেখছি।
—হ্যাঁ, দেখো। রাখছি।
ফোনটা রেখে অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে তুলি। দীপন কেন যে সমস্যাটাকে এত হালকা করে দেখে! ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা থাকবে, সেটা স্বাভাবিক, তাতে তুলিরও আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু নিজের স্ত্রী, কন্যার নিরাপত্তাটাও কি এতটাই মূল্যহীন? কেন বুঝতে চায় না সে, রতন তার ভাই হলেও সে মানসিকভাবে সুস্থ নয়, তার কাছে রুমকী নিরাপদ নয় এমনকি তুলিও।
নাহ্। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে। কাজে মন বসে না আর। বরং এইফাঁকে লাঞ্চটা সেরে নেওয়া যাক। ভাবতে ভাবতেই লাঞ্চ নিয়ে বসে যায় তুলি। মন পড়ে থাকে বাসায়। রুমকীটা এতক্ষণে ফিরল কি না, কে জানে! ময়না তো ফোন দিলো না এখনো! ঠিক তখনই আবার বেজে ওঠে ফোন। ময়না! ছোঁ মেরে ফোনটা তোলে তুলি। কণ্ঠে রাজ্যের উদ্বেগ নিয়ে বলে, হ্যাঁ ময়না, রুমকী ফিরেছে?
—হ, আফা! এইমাত্র ফিরছে! আওনের লগে লগেই ফোন দিছি আফনেরে!
—আচ্ছা, ঠিকাছে। রুমকীকে গোসল করিয়ে খেতে দে। তোরাও সব খেয়ে নে সেই সাথে। ভাইয়া কোথায়?
—ভাইজানে রুমকীর লগে গফ করতাছে।
—এখন অত গফ করা লাগবে না, গোসল সেরে খেয়ে নিতে বল সবাইকে।
—আইচ্ছা আফা, কইতাছি।
—ঠিকাছে, রাখছি! বলেই তুলি সঙ্গে সঙ্গে মত পাল্টে বলে, আচ্ছা, দাঁড়া! রুমকীকে একবার দে তো!
—জ্বে আফা, দিতাছি!
রুমকীকে পেতে বেশ দেরি হয় ময়নার। রুমকী তখন রতনের কাছে কী একটা গল্প শুনে হেসে গড়াচ্ছে। ড্রইংরুমে আড্ডা জমে গেছে তাদের। রুমকীর সঙ্গে দুই-চারটে প্রয়োজনীয় কথা বলে, কিছু নির্দেশ দিয়ে ফোন রেখে দেয় তুলি। আপাতত বেশ কিছুদিন মনে হয় নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে আবার। রতনের অমন হয়। কিছুদিন খুব অসুস্থ হয়ে যায়, কাউকে চিনতে পারে না। বদ্ধ পাগল হয়ে যায়। তখন নিরুপায় হয়ে তাকে ঘরে আটকে রাখতে হয়। মাস তিন-চার পর আবার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। তখন বেশ সহজ, স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করে। তারপর আবার একদিন হুট করে শুরু হয়ে যায় পাগলামি। তখন আবার সেই বন্দিদশা। মানুষটার জন্য মাঝে-মাঝে খারাপ লাগে খুব। আবার সময়-সময় বিদ্রোহ করে ওঠে মন। সে অতিমানুষ তো নয় কোনো। কিছুদিন পর-পর সংসারে এই অশান্তি কার ভালো লাগে! বিশেষ করে প্রভাবটা যখন পড়ে রুমকীর ওপর! সংসারে এই একটা কাঁটা বিঁধে আছে মস্ত! আর? আর কোনো কাঁটাও কি নেই? আছে! সেসব গোপন! গভীর! হৃৎপিণ্ডে ফুটে থাকা সে সব কাঁটা নিয়েই দিব্যি পাড়ি দেওয়া যায় সংসার নামক সাঁকো। অন্তত সে তো দিচ্ছে! উঁহু! সে একা, ও নয় তো! তারা! সে আর দীপন! আরও সব সংসারী মানুষও হয়তো তাদেরই মতো গোপন কাঁটা হৃৎপিণ্ডে গেঁথে নিয়েই পাড়ি দেয় জীবন, হাসিমুখে!
রতন দেখে, রুমকী নয়, ডুরে লাল শাড়ি পরে পাশে বসে আছে মা। হাসছে। তার পাশে দীপন। তার একহাতে রাজ্যের রঙবেরঙের কাগজ। লাল, নীল, বেগুনি।
তবে সে অর্থে তারা, সে আর দীপন খুব অসুখীও নয়। বেশ আছে তারা। প্রেম আছে, আশা আছে, ভালোবাসাও।
রুমকীকে স্কুল থেকে এনে মনটা ফুরফুরে লাগে খুব। মাথার মধ্যে ঝিঁঝিঁটার কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না আজ। অনেকদিন অবিরাম ডাকার শ্রান্তি নিয়ে সে সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। আপাতত বেশ কিছুদিন রতনের ছুটি। শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া মৃত্যুবীজগুলো নীরবে কাজ করে যাবে এখন। ঝিঁঝিটাকে ঘুমুতে দিয়ে তারা সম্ভবত নিজেরাও বিশ্রামে আছে এ মুহূর্তে। অনেকদিন পর শরীরটাকে নিজের বলে মনে হয় রতনের। যেন হৃত সাম্রাজ্যে আবার সে ফিরে পায় অধিকার। সবচে ভালো লাগে, রুমকী তাকে আর ভয় পাচ্ছে না এখন। সে সহজ, স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে গল্প করছে, নতুন নতুন সব গল্পে ভরে ওঠা তার ঝুড়িটা রতনের কাছে উজাড় করতে ব্যস্ত সে। একটু একটু করে পর্দা সরে যাচ্ছে তার চোখের সামনে থেকে। একটু একটু করে মনে পড়ছে পুরনো সব দিন। মাথাটা পরিষ্কার হচ্ছে, স্পষ্ট হচ্ছে তার নিজের কাছেই নিজের অবয়ব। এভাবেই, স্পষ্ট হতে হতেই যেদিন পুরোপুরি তার চোখের সামনে থেকে সরে যাবে পর্দা, সম্পূর্ণ স্পষ্টভাবে সে নিজের আয়নায় দেখতে পাবে নিজেকে, সেদিনই আবার ভীষণভাবে ডেকে উঠবে মাথার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ঝিঁঝিটা, ভয়ঙ্কর সরব হয়ে উঠবে শরীরের মধ্যে মাধবীর বুনে দেওয়া মৃত্যুবীজগুলো। তখন আবার বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে সে, পুরো পাগল। গত ক’বছর ধরে পালাক্রমে চলছে এ নিয়ম। জীবন তাকে নিয়ে জুয়া খেলছে। জীবন? না কি মাধবী? নাহ্! জীবনই! মাধবীর আর তাকে নিয়ে জুয়া খেলার সময় কোথায় এখন! সে এখন সংসার নামক পাশায় ব্যস্ত!
দুপুরের খাওয়া সেরে নিজের রুমটাতে বসে একটা বই পড়ার চেষ্টা করে রতন। কতদিন হল বইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তার! অথচ কী বইপাগল মানুষ ছিল সে! ছিল ভীষণ পড়ুয়া। ক্লাসে সব সময় প্রথম হওয়া শান্ত, সুবোধ ছেলে রতন কেন যে মাথার মধ্যে ঝিঁঝির আবাদ করে এখন, কেন যে তার শরীরে মাধবী বুনে দেয় ভয়ঙ্কর মৃত্যুবীজ, সে সব ভেবে কিছুতেই আর কুল-কিনারা পায় না সে। সে জানে, যত এসব ভাবনা তার মাথায় জেঁকে বসবে, তত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে ঝিঁঝিটা। সে তাই চেষ্টা করে এসব ভাবনা দূরে রাখার। একটু পরেই দরজায় রুমকীর মুখটা উঁকি দেয়। রতনের পাণ্ডুর, কৃশ মুখে অমলিন একচিলতে হাসি খেলে যায়। বইটা বন্ধ করে, হাত বাড়িয়ে বলে, আয় মামনি! ভেতরে আয়!
পায়ে পায়ে ভেতরে এসে রতনের পাশে গুঁটিসুটি মেরে বসে মেয়েটা। রতন সস্নেহে রুমকীর মাথায় হাত বোলোয়। মায়া! মেয়েটা দেখতে অবিকল মায়ের মতো!
মা! মা’র কথা মনে হতেই হুড়মুড় করে ছোটবেলাটা মাথার মধ্যে ঢুকে পড়তে চায় হঠাৎ। ভীষণ টালমাটাল লাগে রতনের। পাশে বসা লাল ফ্রক পরা রুমকী আচমকা মা হয়ে যায় চোখে। রতন দেখে, রুমকী নয়, ডুরে লাল শাড়ি পরে পাশে বসে আছে মা। হাসছে। তার পাশে দীপন। তার একহাতে রাজ্যের রঙবেরঙের কাগজ। লাল, নীল, বেগুনি। অন্যহাতে ঘুড়ি তৈরির বাকি সব সরঞ্জাম। খালি গা, খালি পা। হাফ প্যান্ট পরা, উস্কখুষ্ক একমাথা চুল। টলটলে মুখটায় রাজ্যের মায়া। বড় বড় চোখে রতনের দিকে তাকিয়ে সে নাকি সুরে বায়না করে—এই ভাইয়া! একটা ঘুড়ি বানিয়ে দে না!
—না না! যা এখন! দেখছিস না পড়ছি! এখন পারব না, যা ভাগ!
চলবে….
ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১॥ শিল্পী নাজনীন