বাদল ঘুমিয়েছে। অরুন্ধতীও। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত শরীর বিছানা পাওয়ামাত্রই সাড়া নেই আর। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে বিছানা থেকে নামে তিতলি। সময় নিয়ে স্নান সারে। এককাপ কফি পেলে বেশ হতো। ঝামেলা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় গিয়ে বসে। রাতের অন্ধকারে জায়গাটাকে কেমন রহস্যময়, অচেনা লাগে। সমুদ্রের একদম লাগোয়া হোটেলটায় উঠেছে তারা। বারান্দায় দাঁড়ালে স্পষ্ট সমুদ্র চোখে পড়ে, সীমাহীন। কানে আছড়ে পড়ে তার তুমুল গর্জন। ঢেউগুলো কেমন মাথা তুলে এগিয়ে আসে, সাদা সাদা ফেনাতুলে ছড়িয়ে পড়ে তীরে, ভেঙে পড়ে কাঁচের মতো সৈকতজুড়ে, দেখতে দেখতে কেমন নেশা ধরে যায়। ঝিমঝিম করে ওঠে শরীর। শিরশির করে বুক। এগারোতলার উঁচু বারান্দা থেকে নিচের সৈকত, সমুদ্র, ঘর-বাড়ি কেমন অদ্ভুত লাগে। হাওয়াটাও ভালো লাগে খুব। শীতল, শরীর জুড়ানো। দূরে, সমুদ্রের চোখে চোখ রাখে তিতলি। অন্ধকার, গভীর। সাদা সাদা ঢেউয়ের ফেনায় আছড়ে পড়ছে তীরে। এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যায় তার গর্জন। কান পেতে শোনে। জগতের সবকিছুই ছন্দময়। এই যে সমুদ্র, ঢেউ, তীরে তার আছড়েপড়া, দুলে ওঠা হাওয়ার তালে, তাতেও অদ্ভুত পাগল করা এক ছন্দ আছে। মাতাল করে দেয়। ঝিম ধরিয়ে দেয়। সন্ধ্যাটাকে মনে পড়ে যায়।
সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় তারা গিয়ে বসেছিল বিচে। ভাটায় তখন জল সরে গেছে অনেকদূর। তিতলি অরুন্ধতীর হাত ধরে আস্তে আস্তে নেমে গেছিল সাগরের অনেকটা কাছে। পায়ের নিচে বালু তখনও ভেজা, বেশ নরম। বাদল সাবধান করছিল বারবার, নিষেধ করছিল। তিতলি কান দেয়নি। সে এগোচ্ছিল বুঝি কোনো ঘোরে। একটা জায়গায় খানিকটা জল, অদূরে আবার শুকনো বালিয়াড়ি। একটু দেখল তিতলি। সামান্য জল। শক্ত ক’রে অরুন্ধতীর হাত ধ’রে সে জলটুকু পার হয়ে পৌঁছে গেলো ওপাশের বালিয়াড়িতে। এখান থেকে সমুদ্র নেমে গেছে অনেক দূরে। শোঁ শোঁ আওয়াজ আছড়ে পড়ছে কানে। বিচ এই মুহূর্তে নির্জন। তেমন মানুষজন নেই। শুধু দূরে সারি সারি হেলানো বসার চেয়ারগুলো চোখে পড়ছে। মাথার ওপর ছাতা। অল্প কিছু মানুষ সেগুলোতে শুয়ে-বসে উপভোগ করছে সাগরের নির্জনতার গান। ভেজা বালুর ওপর লেপ্টে বসে পড়ে তিতলি।
অরুন্ধতী ততক্ষণে বাদলের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় মেতেছে। নিজের মধ্যে ডুবে যায় তিতলি। সাগরের হু হু কান্নার সঙ্গে মিশে যায় নিজেরও কান্নার সুর। চোখের নোনা জল আর সমুদ্রের নোনা জল মিশে যায় একসঙ্গে। চোখেতে সাগর আছে! গানটা মনে পড়ে হঠাৎ। কী যেন গানটা? হ্যাঁ, মনে আগুন জ্বলে চোখে কেন জ্বলে না।
গানটা গুনগুন করতে থাকে তিতলি। ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার করুণ, অসহায় মুখ। সরকারি শিশু পরিবারের সেইসব গ্লানিময়, বিষণ্ন দিন। একেকটা দিন যেন একেকটা যুদ্ধ ছিল তখন। বিশ্বাস হতো না শেষ হবে। জীবনটাকে তখন মনে হতো কৌটাবন্দি থাকা এক কষ্ট-প্রজাপতি। যাকে ভালোবাসতেও ইচ্ছে হতো খুব আবার বন্দিত্বের যন্ত্রণাটুকুও ছিল অসহ্যরকম দুর্বিষহ। সেসব ভাবতেও চোখে জল এসে যায়। অভিমানে কান্না উথলে উঠতে চায় বুকের ভেতর। কষ্ট এসে আটকে যায় গলার কাছে। আহা! তার ভাইটা! একমাত্র সহোদর তার, আপনজন। কোথায় আছে এখন, কেমন আছে কে জানে! সে তো তবু সব কষ্ট সহ্য করে, সবার সব অবহেলা উপেক্ষা করে, তৈরি করে নিয়েছে নিজের একটা অবস্থান। কিন্তু তার বোকা ভাইটা! বিদ্রোহ করল। অভিমানে সব ছেড়ে চলে গেল জীবন থেকে দূরে। ছিটকে গেলো চেনা-পরিচিত জীবন থেকে। পথে পথে ঘোরে এখন ভবঘুরের মতো। কী খায়, কোথায় ঘুমোয় কিচ্ছুটি ঠিক নেই তার। তরুণের শুকনো, না খাওয়া মুখটা মনে ক’রে ভীষণ কান্না পায় হঠাৎ। দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ কাঁদে তিতলি। সমুদ্রের উত্তাল গর্জনের সঙ্গে মিশে যায় তার কান্নার ঢেউ। দূরে অরুন্ধতী তখন বাবার সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত।
দীপনটা সেই যে ফোন রাখলো, আর কোনো খোঁজ নেই তার। তিতলিকেও ব্লক করে রেখেছে। অভিমানে কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায় তার। কেন অমন করে দীপন? কী সে চায়? তিতলি আর তাকে বিরক্ত না করুক? বেশ! তাই হবে তাহলে! আর কোনোদিন সে বিরক্ত করবে না দীপনকে। কাউকেই না! কী ক্ষতি সে করেছে দীপনের? কিংবা পৃথিবীর? কেন তার জন্যই শুধু জমা করে রেখেছে পৃথিবী অবহেলার সমস্ত ভাঁড়ার? উপেক্ষার সবটুকু ভাণ্ডার? তার জন্যই কেন বরাদ্দ আছে সবটুকু যন্ত্রণার উপাচার? কী এমন সে চেয়েছে, চায় দীপনের কাছে? কিছুই তো নয় তেমন! একটু ভালোবাসা শুধু! দীপনের বুকের ভেতর তার জন্য একটু স্নেহের জল! তাতেও এত আপত্তি তার! বেশ! চোখ ফেটে জল আসে তিতলির। ভুলে যায় সে আসলে মধ্য ত্রিশে দাঁড়ানো এক নারী, কিশোরীটি নয়, ভুলে যায় তার একটি ফুটফুটে মেয়ে আছে, মেয়ের বাবা আছে, সংসার আছে!
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১৪॥ শিল্পী নাজনীন
ঘোরগ্রস্তের মতো উঠে দাঁড়ায় সে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রের মতোই তারও বুকের ভেতর তখন তুমুল গর্জন, যন্ত্রণার প্রবল ঢেউ। তার মনে হতে থাকে সমুদ্র যেন তাকে ডাকে। তীব্র এক আকর্ষণে টানে। মনে হয় তার সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা, অভিমান ধুয়েমুছে দেবে সমুদ্র আজ। সমুদ্র আর তার দুঃখ এক হয়ে মিশে যাবে আজ পৃথিবীর হাওয়ায় হাওয়ায়। অনেকটা এগিয়ে গেছিল তিতলি। অনেকটা নেমে গেছিল জলে। কী করছে নিজেও জানে না। যেন জাগতিক সব বোধ লুপ্ত হয়ে গেছিল তার। উবে গেছিল হিতাহিতজ্ঞান। তার কানে তখন সমুদ্রের প্রবল গর্জন। অপ্রতিরোধ্য আহ্বান। সমুদ্র তাকে ডাকছে। প্রবলভাবে ডাকছে। তীব্রভাবে টানছে। সে এগিয়ে যাচ্ছে মোহমুগ্ধের মতো।
অরুন্ধতী মেতেছিল বাবার সাথে ছোঁয়াছুঁয়ির খেলায়। দৌড়ে অনেকটা দূরে যাচ্ছিল সে, বাদল তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই আবার ছুটে যাচ্ছিল দূরে, আরও দূরে। তিতলি বসে ছিল একা। নিজের মধ্যে। বরাবরই অমন সে। নিজের মনে থাকতে ভালোবাসে। বাদল বা অরুন্ধতী তাই তাকে ঘাঁটায়নি আর। খেলতে খেলতে হঠাৎই তিতলির চোখ গেলো মায়ের দিকে। মা তো বসা ছিল ওখানেই! নেই কেন? কোথায় গেলো?
আতিপাতি করে খুঁজে যায় অরুন্ধতীর চোখ। হঠাৎ চোখে পড়ে। সমুদ্রের মধ্যে অনেকটা নেমে গেছে তিতলি। বুকসমান জলে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আর্তনাদ ক’রে ওঠে অরুন্ধতী, মা!
অরুন্ধতীর কণ্ঠে বাদলও চমকে তাকায়। অতদূর থেকে অরুন্ধতীর ডাক শুনতে পায় না তিতলি। তার কানে তখন শুধু সমুদ্রের ডাক, গভীরতর আহ্বান।
মেয়েকে সেখানেই দাঁড়াতে বলে বাদল পড়িমরি করে ছোটে। একছুটে নেমে যায় জলে। তিতলির কাছটিতে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। উৎকণ্ঠায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, কী করছ তুমি?
তিতলি চমকে ওঠে। কেঁপে ওঠে হঠাৎ। বাদল স্পষ্ট টের পায় তার চমকে ওঠা, কাঁপন। অরুন্ধতী তীরে দাঁড়িয়ে তখনও চিৎকার করছে, মা! মা!
তীরে উঠে আসে দুজনেই। ভেজা শরীরে অরুন্ধতীকে জড়িয়ে ধরে তিতলি। অরুও। ভীষণ ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মাকে পেয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে হঠাৎ। অভিমানে ফুলে ফুলে ওঠে তার শরীর। চোখ-মুখ শক্ত ক’রে কান্না আটকায় তিতলি। জাল। পৃথিবীময় ছড়ানো। হঠাৎ হঠাৎ টের পাওয়া যায়।