হিরোদের বাড়ি থেকে ফিরে মনটা কেমন যেন উড়ু-উড়ু। সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠি। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। রাতেই চৌরাস্তাবাজারে এসে শুনেছি, আজ বিকালে বাজার মসজিদের উত্তরপাশের জমিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট। চৌরাস্তাবাজারের উত্তর দিক বনাম দক্ষিণ দিকের মধ্যে এই খেলা। এভাবে ভাগ করার ফলে উত্তর দিকে ভালো গোলকিপার সংকট দেখা দেয়। আর দক্ষিণ দিকে সংকট দেখা দেয় আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের। দক্ষিণ দিকে কোলকিপারের মধ্যে রয়েছি তিন জন। নুর আলম জিকো, সোলায়মান ও আমি। আমাদের মনের শক্তি এক জায়গায়, উত্তর দিকের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা যতই শক্তিশালী-কৌশলী হোক, গোল কিপার হিসেবে আমরা তিন জনই তাদের বল প্রতিহত করতে সক্ষম। এরমধ্যে জিকোর তুলনা আমাদের গোটা তল্লাটে নেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিকেলের খেলার কথাই ভাবছি কেবল। কেন দ্রুত বিকেল নামে না, এই চিন্তা-ই করোটির ভেতর ক্রমাগত হাতুড়িপেটা করে যাচ্ছে। তবু, গায়ের ওপর প্রজাপতি বসলে যেভাবে চঞ্চল কিশোর তার কোমল ফুঁয়ে তাকে তাড়ায়, ঠিক তেমন করে শীতের আলস্যকে আলতো করে তাড়িয়ে ঝপাৎ করে নেমে পড়ি পুকুরে। গোসল শেষে যখন উঠি, তখন ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকি। দ্রুত গরম জামাকাপড় পরে খেয়ে-দেয়ে সাইকেলে চড়ে বসি। গন্তব্য স্কুল। যেতে যেতে ঠিক করি, একদিন যে স্কুলে যাইনি, তার কী কৈফিয়ত দেবো। পঞ্চতন্ত্রমন্ত্রে যে পুচকে খরগোশ স্রেফ বুদ্ধির জোরেই আস্ত সিংহকে কুয়োর ভেতরে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে মেরে ফেলে, সেই রকম সহস্র পুচকে খরগোশের বুদ্ধি আমার মাথার ভেতর ছোটাছুটি শুরু করে। আমি তাদের যন্ত্রণায় স্থির থাকতে পারি না। পথে পথে অজস্র পরিকল্পনা করি, কেবল ক’টি বেত থেকে বাঁচার জন্য। কোনো পরিকল্পনাই মনের মতো হয় না। তাই নতুন নতুন পরিকল্পনা আমাকে অস্থির করে রাখে। কিন্তু পরিকল্পনা স্থির হওয়ার আগেই স্কুলে এসে পৌঁছে যাই। মনে মনে সময় ও পথের দূরত্বকে দুষি। এত দ্রুত পথ শেষ কী করে! পথ কেন আরও দীর্ঘ হলো না? কেন আমাকে ভাবার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়ার মতো দীর্ঘ হলো না এই পথ?
কিন্তু না, মুহূর্তে দর্শকসারিতে শোর উঠলো—‘গোল!’ চোখ খুলতেই দেখি, বলসহ আমি নেটের ভেতরে।
যাক, কথায় বলে যত গর্জে তত বর্ষে না। ক্লাসে ঢুকতেই সবাইকে দেখি হাসিহাসি মুখ। কিছুক্ষণ পর ব্রজলাল স্যার এসে ঢুকলেন। তিনি এসেই ফুটবল না খেলেও পয়েন্ট নিয়ে জিতে আসার প্রসঙ্গ। সবাই খোশগল্পে মেতে উঠেছি। ইতোমধ্যেই স্যার রোলকল করে চলেছেন। একজন আরেকজনের উপস্থিতি বলে দিচ্ছি। স্যার হাসিমুখে মাথা নাড়ছেন, আর মুখে বলছেন, ‘দুষ্টের দল। কেবল ক্লাসফাঁকি!’ ঘণ্টা পড়তেই স্যার চলে গেলেন, আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। খোকন আর ধনু কাকা বললো, ‘বিকেলে খেলা আছে। খবর আছে তোর?’ বলি, ‘জানি তো। তোরা না বললেও খবর দেওয়ার লোকের অভাব নেই। খবর ঠিকই পেয়ে গেছি। তোরা ভেবেছিস, আমাকে বাদ দিয়েই খেলবি। তাই তো?’ আমার খোঁচাটা ধরতে পারেনি ধনু কাকা। তাই ক্ষেপে গেলো, ‘ওই ব্যাটা কী কস? তুই একদলের, আর আমরা আরেক দলের। তোর টিম লিডার নূরনবী চিত্রকর, আমাদের টিম লিডার খুরশিদ ভাইয়া। তোরে আমরা কইলে কী, আর না কইলে কী?’ মৃদু তর্ক শুনে জিকো পাশের বেঞ্চ থেকে উঠে এসে আমাকে থামায়, ‘অ্যাই তুই থাম। তোরে তো কাল আমি কইছিই, আজ খেলা। বেহুদা এইটা নিয়ে আবার তর্ক করিস ক্যান?’ জিকোর কথায় আমি চুপ হয়ে যাই। ধনু কাকারও রাগ নেমে যায়। পরবর্তী ক্লাসের অপেক্ষার প্রহর গুনি।
ছুটির ঘণ্টা বাজলে ফের বাড়ির পথ ধরি। ধনু কাকা, খোকন, জিকো ও আমি একসঙ্গে পাশাপাশি সাইকেলে। সারি সারি চলে আমাদের সাইকেল। মনে হচ্ছে আমরা যেন কোনো বিশেষ সামাজিক আন্দোলনের কিশোর বাহিনী, চলেছি কোনো র্যালি নিয়ে। দ্রুত পথ ফুরিয়ে গেলো। খোকন ও আমি আমাদের কাছারিতে ঢুকলাম। বাকিরা যে যার বাড়িতে গেলো। দ্রুত খেয়ে-দেয়ে টুর্নামেন্টের জন্য তৈরি। যথাসময়ে নির্দিষ্ট মাঠে এসে হাজির। দেখি, আমাদের আগেই সবাই এসে গেছে।
আজকের রেফারি হেলাল ভাই। তার বাঁশির ফুঁতেই খেলা শুরু। মিনিট দশেকের মাথায় আমাদের নুর নবী চিত্রকরের কিকে প্রথম বল ঢুকলো উত্তর টিমের জালে। মুহূর্তে মুহুর্মুহু করতালি। এবার উত্তর টিমের আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড়রা মারমুখী হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মারকুটে ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে খুরশিদ কাকাকে। তাকে প্রায় প্রতিপক্ষ দলে খেলতে দেখি। দুর্ভাগ্য কি না জানি না, যতদিন খেলতে নামি, খুরশিদ কাকা আমার বিপক্ষে থাকেন। সেটা পরিকল্পিতভাবে টিম করা হোক, এলাকাভিত্তিক করা হোক কিংবা টসে নির্ণয় করা হোক, কোনোভাবেই খুরশিদ কাকার টিমে কখনোই পড়ি না। এই আক্ষেপ বহুদিনের। কারণও আছে। বলের ওপর তার কিক প্রায় বিপজ্জনক হয়। এর আগে, বর্ষায় স্কুলের মাঠে খেলা হচ্ছে। যথারীতি গোলকিপার আমি। প্রতিপক্ষের গোলকিপার জিকো। খুরশিদ কাকা খেলছেন প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগে। দেখলাম, বল মিডফিল্ডে। খুরশিদ কাকা চোখের পলকে বল টেনে নিয়ে এলেন ডিবক্সের সামনে। সেখানে আমাদের ডিফেন্ডার নুর হোসেন। কিন্তু নুর হোসেন কোনোভাবেই খুরশিদ কাকাকে প্রতিহত করতে পারলো না। কাকা সজোরে বলে দিলেন কিক। আমিও প্রস্তুত। দুই হাত বাড়িয়ে পাঁজাকোলে ধরার স্টাইলে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। বুঝতে পারছি বল আমার বুকে এসে গেছে। হাত ফসকে যায়নি। মনে মনে ভাবলাম, যাক গোল হয়নি। কিন্তু না, মুহূর্তে দর্শকসারিতে শোর উঠলো—‘গোল!’ চোখ খুলতেই দেখি, বলসহ আমি নেটের ভেতরে। এই হচ্ছেন খুরশিদ কাকা। আর এই হচ্ছে তার কিক। অতএব, আজও ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে।
রাতে যখন বিছানায় আসি, তখন টের পাই—আমার বাম হাত ফুলতে শুরু করেছে। সঙ্গে তীব্র ব্যথাও। রাসেল আমার চিৎকারে ভয় পায়। উঠে দৌড় দেয় বঙ্কিম ডাক্তারের ফার্মেসির দিকে।
আজ আমাদের ডিফেন্ডার হিসেবে আছে হাওলাদার বাড়ির বেলাল। সে খুব মজার মানুষ। যেকোনো বিষয়কে হালকাভাবে নিতে জানে। পড়াশোনা তেমন বেশি করেনি। বয়সে আমার চেয়ে ৪/৫ বছরের বড়। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক তুই-তোকারির। সেই সুবাদে নিজের জীবনের সব ধরনের হাসি-আনন্দ-বেদনার কথা শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে। আর কথা বলে বেশ রসিয়ে রসিয়ে। একবার নাকি কোম্পানিগঞ্জ গিয়েছিল কী একটা পারিবারিক কাজে। যে বাড়িতে গিয়েছিল, সে বাড়ির একজন বয়স্ক লোক তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’ বেলালের বিনীত জবাব, ‘চরক্লার্ক, চৌরাস্তাবাজারের কাছে।’ সে নাকি ইচ্ছা করেই বলেনি, বাজারের কোন পাশে। তাই প্রশ্নকর্তা আবারও জানতে চান, ‘বাজারের কোন পাশে?’ এবার তার জটপট জবাব, ‘আঙ্গো বাড়ির উত্তর পাশে চৌরাস্তা বাজার।’ প্রশ্নকর্তা বেলালের জবাবে সম্ভবত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই আবারও প্রশ্ন তার, ‘কালাম নেতার বাড়ির (আমাদের তৎকালীন বাড়ি। আমার কাকার নামে পরিচিত) কোন পাশে?’ বেলাল এবারও মুহূর্তমাত্র দেরি না করে জবাব দেয়, ‘আঙ্গো বাড়ির পূর্বপাশে কালাম নেতার বাড়ি।’ তার মুখে এই গল্প শুনে আমরা শ্রোতারা তাকে পাকড়াও করি, ‘কী বলিস ব্যাটা? সব কিছুর আগে তোদের বাড়িকে আনতে হবে কেন? তোদের বাড়িকে কেন্দ্র করে দুনিয়া ঘোরে নাকি?’ বেলাল হাসতে হাসতে বলে, ‘দুনিয়াদারির কী বুঝিস তোরা? টিভির খবর তো দেখিস? কী দেখিস? আঙ্গো দেশের প্রধানমন্ত্রী বাইরের দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর লগে দেখা করলে খবরে কী কয়? আঙ্গো প্রধানমন্ত্রীর নাম আগে কয় না? দেশের নাম বলার সময় বাংলাদেশের নাম আগে কয় না?’ আমরা আমতা আমতা করে বলি, ‘হ্যাঁ কয়তো। বাংলাদেশের নাম আগে কয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম আগে কয়। তারপর অন্যদের প্রধানমন্ত্রীর নাম কয়।’ এবার বেলাল মুখ গম্ভীর করে বলে, ‘পড়ালেখা করে কী শিখলি? নিজের দেশ, বাড়ির নাম আগে কইতে হয়। বুঝলি? নিজের মা ভিখারিনী হইলেও তাকে আগে সালাম দিতে হয়, খালা-ফুপু প্রধানমন্ত্রী হইলেও তাগোরে সালাম দিতে হয় পরে। এটাই শিষ্টোচার।’ বেলাল আমাদের চেয়ে পড়াশোনা কম করেছে। কিন্তু কিভাবে এসব নিয়ম শিখেছে বুঝতে পারি না। তার পড়াশোনা আমাদের চেয়ে কম হলে কী হবে, অভিজ্ঞতায় সে বেশ পাকা। এই কথা একবাক্যে সবাই স্বীকার করি।
এই বেলাল যে কেবল জ্ঞানী-বুদ্ধিমান তা-ই নয়, গায়ে-গতরেও দীর্ঘদেহী। অনেক লম্বা। তাই সে যখন আমাদের ডিফেন্ডার, তখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত থাকি। কিন্তু যখনই প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগে খুরশিদ কাকাকে দেখি, তখনই অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আমি হরিণের মতো কান খাড়া রেখেছি, বাজপাখির মতো তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে আছি বলের দিকে। হঠাৎই দেখি, খুরশিদ কাকা মিডফিল্ড থেকে বল টান দিয়েছেন। নূরনবী চিত্রকরকে আমরা ম্যারাডোনা বলি, কিন্তু সেই ম্যারাডোনাও কোনো রকম খেতাববিহীন খুরশিদ কাকার কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে পারছেন না। পারছেন না তার গতিরোধ করতেও। এবার এগিয়ে গেলো বেলাল। ততক্ষণে বলে সজোরে কিক। ওই দৃশ্য দেখামাত্রই কী করবো, ভাবছি। ভাবছি বল ধরবো, না বক্সিং দিয়ে পার করে দেবো? এক থেকে দুই সেকেন্ড হয়তো সেই ভাবনার স্থায়িত্ব। ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই বল এসে গেছে, ধরতে গিয়ে বক্সিং দিতে চাইলাম। যথাযথ হলো না। আমার বল নেটের বাইরে দিয়ে চলে গেলো। গোল হলো না। কিন্তু তীব্র চিৎকারে লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে। বাম হাতের কবজির ত্বক ছিঁড়ে হাড় বেরিয়ে এসেছে। দেখে আমার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। ছুটে এলো বেলাল। আমার কনুইয়ের কাছে পা দিয়ে চেপে ধরে দুই হাত দিয়ে ধরলো হাতের তালু। হঠাৎ দিলো টান সামনের দিকে। কটকট করে শব্দ হলো। এরপরই সে বসিয়ে দিলো হাত। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বেলাল আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘কিছু হয়নি। খেললে খেলতে পারিস।’ আমি অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকায়। সে মাথা নাড়ে, ‘বললাম তো, কিচ্ছু হবে না। ডরাইস না।’ আমিও ডরাই না। তার কথায় আস্থা রাখি। বাকি সময়টুকু খেলে যাই। আমরা জিতি এক-শূন্য গোলে।
রাতে যখন ঘুমাতে আসি আসি, তখনই টের পাই—আমার বাম হাত ফুলতে শুরু করেছে। সঙ্গে তীব্র ব্যথাও। রাসেল আমার চিৎকারে ভয় পায়। উঠে দৌড় দেয় বঙ্কিম ডাক্তারের ফার্মেসির দিকে।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৪৩॥ মোহাম্মদ নূরুল হক