[পর্ব-৩৪]
ছুটি শেষে প্রায় স্কুলমাঠে ফুটবল খেলি। এই খেলায় আবার অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন আছে। চৌরাস্তা বাজার বনাম আক্তার মিয়ার হাট। জুনিয়র হাইস্কুলের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত তিন শ্রেণী ছাত্রসংখ্যা শতাধিক। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা নেহায়েতই ভদ্র-নিরীহ। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীতে আমরা যারা পড়ি, আমাদের মধ্যে সেই অর্থে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। ক্লাসফাঁকি দেওয়া, ফুটবল খেলা, মারামারি করায় আমাদের জুড়ি মেলা ভার। এমনকি স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাস্টার ছিদ্দিক উল্লাহর বাড়ির ডাব চুরিতেও আমাদের ভুবনজোড়া খ্যাতি।
খেলার মাঠে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের চেয়ে আমাদের প্রতাপ বেশি। মাঠ আমাদের নিয়ন্ত্রণে। সিনিয়রদের খেলার সুযোগ নির্ভর করে আমাদের মর্জির ওপর। সেই মর্জিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বও আমাদের প্রকট। আক্তার মিয়ার হাটকেন্দ্রিক পালের গোদা নুর হোসেন মাস্টার; চৌরাস্তাবাজার কেন্দ্রিক দলের নেতৃত্বে ধনু কাকা, খোকন ও আমি।
সেদিন স্কুল ছুটির বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি আমরা। অর্থাৎ চৌরাস্তাবাজারকেন্দ্রিক দল। এদিকে মাস্টারের দলও ছাড়ার পাত্র নয়। সারা স্কুলে বল একটি। সেটি ইতোমধ্যেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু মাস্টারের দল বল না পেয়ে খালি হাতেই চলছে তাদের তর্জন-গর্জন। শুরু হলো তর্ক-বিতর্ক। আমরা কিছুতেই তাদের খেলতে দেবো না। তারাও আবার আমাদের সুযোগ দিতে রাজি নয়। বিষয়টি বাক্বিতণ্ডা থেকে শুরু করে হাতাহাতি পর্যায়ে গড়িয়ে যাওয়ার পথে। ইতোমধ্যে শোরগোল শুনে তিন তলা থেকে নেমে এলেন ব্রজলাল স্যার। হাতে চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী বেত। নিচু অথচ দৃঢ় স্বরে ঢাকলেন, ‘এই বাচ্চারা এদিকে আসো। কী হয়েছে? সবাই মিলেমিশে খেলতে কী সমস্যা?’ জবাবে আমরা দোষারোপ করি মাস্টারদের, তারাও দোষে আমাদের। সব শুনে দাঁত কিড়মিড় করে স্যার বলেন, ‘তোমাদের জন্য দরকার মিস্টার কেইম। এছাড়া তোমরা সোজা হইবা না।’ ধনু কাকা, খোকন ও আমার দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি সময় ভাগ করে দিচ্ছি। রেফারিও আমি। প্রথম ৩০ মিনিট তোমরা খেলবে। পরের ৩০ মিনিট মাস্টাররা।’ কথা বলতে বলতেই স্যার মাঝমাঠে গিয়ে দাঁড়ালেন। শুরু হলো বাঁশি। আমরা খুশিতে নেমে পড়লাম মাঠে। আমাদের ৩০ মিনিট শেষ হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম স্কুলের পুকুরে।
পানির ওপর ভেসে উঠতে পারি না। তখন মনে হয়, এই বুঝি আমি শেষ। আর কোনো দিন মা-বাবা-ভাইয়ের চেহারা দেখতে পাবো না। আর কোনো দিন ধনু কাকা-খোকনের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পারবো না। ওবায়দুল হক মৌলবিদের বাড়ির সামনে বটতলায় বসে বিবর্তনবাদ-ডারউইন-আরজ আলী মাতুব্বর কিংবা কবিতার ছন্দ-অলঙ্কার নিয়ে আর কোনো তর্কে জড়াতে পারবো না। এসব ভাবি আর হাত-পা ছুড়তে থাকি।
পুকুরে নেমে গোসল সেরেই উঠে যাবো, আমাদের স্বভাব এমন নয়। জলেও আমাদের খেলা চলে। এই খেলার নাম কাউ কাউ খেলা। এই খেলার নিয়ম ঘাস-লতা-পাতা যা কিছু একটা পাই না কেন, সেটিকেই কাউ ফল ধরে নেই। এরপর ওই ফল একজনের কাছে থাকে। সবাই তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা অংশ নেই। সেও প্রাণপণে চেষ্টা করে সবার স্পর্শ এড়িয়ে চলতে। কখনো জলের তলায় দীর্ঘক্ষণ ডুব দিয়ে থাকে, কখনো সাঁতার কাটে। একসময় সবার তাড়া খেয়ে কারও না কারও হাতে নিজেকে সমর্পণ করে। এরপর শুরু হয় নতুন কাউঅলাকে স্পর্শ করার প্রতিযোগিতা।
আমাদের কাউ-কাউ খেলা শুরু। পুকুরের জল বেশ স্বচ্ছ। ডুব দিলেও দেখা যায়। আমাকে যেন কেউ দেখতে না পায়, সেজন্য দুষ্টুমির সব কৌশল প্রয়োগ করি। প্রথমে একডুবে চলে যাই পুকুলের তলায়। এক খাবলা মাটি তুলে নেই। এরপর পানিতে গুলিয়ে দেই। পুকুরের তলায় জলের ভেতর কাদা মাটি ছিটিয়ে দিলে সেখানে যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, সেটি অনেকটা ককটেল বিস্ফোরণের পর যেমন আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডুলী দেখা যায়, তেমনই। এতে আমার অবস্থান কোথায়, তা অন্য প্রতিযোগীরা আন্দাজ করতে পারে না। তো সেদিনও খেলার শুরুতেই কাউ আমার হাতে। সবাই আমাকে তাড়া করছে। এই পুকুরে পালিয়ে বেড়ানোর সুযোগ কম। কারণ, স্বচ্ছ পানি, ডুব দিলেও দেখা যায়। তবে দ্রুত সাঁতার কাটতে পারলে দীর্ঘক্ষণ নিজের কাজে কাউ রাখা যায়। কিন্তু স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার কারণে ভালো সাঁতারও কাটতে পারি না। তাই পুকুরের যে কোণায় প্রচুর শাপলা, সেদিকে চলে যাই। প্রতিযোগীরাও তাড়া করতে করতে এগিয়ে আসে। তখন এক ডুবে চলে যাই পুকুরের তলায়। কিন্তু পনেরো/ষোলো সেকেন্ডের বেশি থাকতে পারি না। ফের ভেসে উঠি। ইতোমধ্যে ধনু কাকা আমাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলবে—বাঁচার জন্য আবারও দেই ডুব। শাপলার লতা ধরে চলে যাই শালুক পর্যন্ত। বেশকিছু শাপলার লতার গোড়া ধরে চুপ করে বসে থাকি। এক ফাঁকে কাদা মাটি গুলিয়ে পানিতে ছড়িয়ে দেই। এতে চারদিক ঘোলা অন্ধকার হয়ে যাই। তখন প্রতিযোগীরা আমাকে দেখবে কী, আমি নিজেই নিজেকে আর দেখতে পাই না। ইতোমধ্যে শাপলার লতাপাতা আমার সারা শরীরে জড়িয়ে গেছে। এবার পানির ওপরে ভেসে উঠতে চাই, পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে। কী করবো—বুঝতে পারি না। নাকেমুখে পানি ঢুকে যায়। আমার বুক ধুঁকপুক করতে থাকে। শাপলার লতাপাতা ছাড়াতে পারি না। অনেক শক্ত। নাকি আমারই শরীর দুর্বল হয়ে আসে—বুঝতে পারি না। কিছু বুঝতে না পেরে বুকভরে শ্বাস নিতে গিয়ে মুখ হা করে ফেলি। অমনি গলগল করে কাদা পানি ঢুকে যায় গলার ভেতর। পানির তলায় সেই পানি উগরে দেই। প্রাণপণে শাপলালতার সঙ্গে লড়াই করি। কিন্তু ছিঁড়তে পারি না। পানির ওপর ভেসে উঠতে পারি না। তখন মনে হয়, এই বুঝি আমি শেষ। আর কোনো দিন মা-বাবা-ভাইয়ের চেহারা দেখতে পাবো না। আর কোনো দিন ধনু কাকা-খোকনের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পারবো না। ওবায়দুল হক মৌলবিদের বাড়ির সামনে বটতলায় বসে বিবর্তনবাদ-ডারউইন-আরজ আলী মাতুব্বর কিংবা কবিতার ছন্দ-অলঙ্কার নিয়ে আর কোনো তর্কে জড়াতে পারবো না। এসব ভাবি আর হাত-পা ছুড়তে থাকি।
ধনু কাকা ক্ষেপে উঠলো—‘তোরা সব থামবি? পোলাটা মরলে খুশি হইতি তোরা?’ তার গর্জনে গোধূলিলঘ্নে সূর্য ডোবার পথে মিইয়ে আসা লাল আভার মতো সঙ্গীদেরও গুঞ্জন থেমে যায়। পিনপতন নীরবতায় আমরা চলেছি হেঁটে বাড়ির পথে।
হঠাৎ কার যেন হাত এসে আমার বাহু ধরে হেঁচকা টান দেয়। এরপর রকেটের গতিতে পানির ওপর ভাসিয়ে আনে। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে তোলে পুকুর পাড়ে। তখনো চোখ খুলিনি। কেবল কানে ভেসে আসে একেকজনের একেক কথা। কেউ দ্যাখ-দ্যাখ পেটে পানি ঢুকেছে কি না, কেউ বলে মাথার ওপর তুলে ঘোরা। তাহলে পানি বের হয়ে যাবে। কেউ বলে মাথার ওপর তুলে ঘোরাতে হলে বড়দের কাউকে লাগবে। ইতোমধ্যে কেউ একজন পেটের ওপর আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে। ওই চাপে প্রচণ্ড ব্যথা পাই। প্রায় কঁকিয়ে উঠি। বমি করে দেই। চোখ খুলে দেখি ধনু কাকা শাপলা পাতা ভরে পানি এনে বুক ধুয়ে দিচ্ছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই, খোকন বলে, ‘আল হামদুলিল্লাহ। বিপদ কেটে গেছে। বড়দের সাহায্য লাগবে না।’ আনোয়ার বলে, ‘কিছুক্ষণ এভাবে থাকুক। গায়ে বাতাস লাগুক। তাহলে ভালো লাগবে।’ ধনু কাকা কারও কথায় কর্ণপাত করে না। আমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘ব্যাটা তোরে এত হেড মাস্টরি করতে বলেছে কে? শাপলার বনেই লুকাতে হবে কেন? আবার কাদা মাটি দিয়ে পানি ঘোলা করতে বলেছে কে? তুই অনেকক্ষণ ধরে ডুব দিয়ে আছিস। এরপর দেখি খালি পানির বুদ্বুদ উঠতেছে। তখনই সন্দেহ হইলো। এজন্য বুদ্বুদ সোজা ডুব দিলাম। আর তোকেও পেয়ে গেলাম। সারা গায়ে শাপলার লতা পেচিয়ে মরতে গেলি ক্যান? আজ আমি না থাকলে তোকে বাঁচাইতো কে?’ তার কথার কোনো জবাব খুঁজে পাই না। ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।
আমাদের শোরগোলে অনেকেই এসে জড়ো হয়। ধনু কাকা ছাড়া সবাই আমাকে সহানুভূতির সুরে কথা বলে। কিন্তু ধনু কাকা চুপ। প্রথমে একদফা বকাবকি করেছিল। এখন আর কিছুই বলছে না। এদিকে বেলাল, আনোয়াররা স্কুলের সামনে থেকে জামা-জুতা-বই-সাইকেল নিয়ে এলো। ইতোমধ্যে ত্রিশ মিনিটেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আমিও বুক ভরে শ্বাস নিলাম। মনে হলো, এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আমি।
আমরা ভেজা কাপড়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আমার এক হাত ধনু কাকার কাঁধে, আরেক হাত খোকনের কাঁধে। বাকিরা আমাদের সামনে-পেছনে হাঁটছে। পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি বিপুল প্রাণশক্তি নিয়ে সূর্য তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে মেঘমালার ওপর। তারই ফাঁক গলে সেই আভা ধানক্ষেতের ওপর এসে পড়েছে। সবুজ ধানগাছ আর অনেক দূরের বাড়িগুলোর সবুজ গাছগাছালির পাতায় সূর্যের সেই লাল আভা পড়ে রঙ বদলে যাচ্ছে।
আমরা হেঁটে চলেছি বাড়ির পথে। পায়ের তলায় কারও জুতা আছে, কারও নেই। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে-ভেজা লুঙ্গিতে ধুলোর আস্তর লাগিয়ে হেটে চলেছি আর আমাদের চোখে-মুখে ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে কিছুক্ষণে আগের সেই আতঙ্ক। আমরা আতঙ্কের মুহূর্ত ভুলতে পারছি না। যতবারই ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি, ততবারই কেউ না কেউ আতঙ্কের প্রসঙ্গ ফিরিয়ে আনছে। প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছে। কারও প্রশ্নের উত্তর হয়তো দিচ্ছি, কারওটা দিচ্ছি না। যারা ঘটনার আদ্যোপান্ত জানে না, তারা বারবারই খোঁচা দিচ্ছে—কিভাবে কী হলো? একই ঘটনা বারবার বর্ণনা করতে গিয়ে ধনু কাকা ক্ষেপে উঠলো—‘তোরা সব থামবি? পোলাটা মরলে খুশি হইতি তোরা?’ তার গর্জনে গোধূলিলঘ্নে সূর্য ডোবার পথে মিইয়ে আসা লাল আভার মতো সঙ্গীদেরও গুঞ্জন থেমে যায়। পিনপতন নীরবতায় আমরা চলেছি হেঁটে বাড়ির পথে।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৩৩॥ মোহাম্মদ নূরুল হক