[পর্ব-৩১: জুনিয়র হাইস্কুল পর্ব]
ইসমাইলের হাতে কাঁটা কম্পাস বিঁধে যাওয়ার পর বেশি কিছুদিন খোকন আর আমাদের কাছারিতে আসে না। আমিও বিছানায় পড়ে আছি। যেতেও পারি না। খোকন না এলেও নিয়মিত আসে আজাদ, বেলাল, ধনু কাকা, খায়রুল বাসার। এরা মূলত স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে একটু ঢুঁ মেরে যায়। আর আসেন মহিউদ্দিন, আজাদের বড় ভাই হেলাল উদ্দিন। হেলাল ভাই বেশ কদিন ধরে আমাদের ফুটবল কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিকাল বেলা বাড়ির সামনে সবাই ফুটবল খেলে। খেলা শেষে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর যাওয়ার সময় আমার খোঁজ-খবর নেয়।
ইতোমধ্যে বাম পায়ের গোড়ালির ওপর বিশাল আকারের একটি ফোঁড়া উঠেছে। দেখতে অনেকটা টিউমারের আকার ধারণ করেছে। কদিন যেতে না যেতেই সেই ফোঁড়ায় প্রচুর পুঁজ জমেছে। ফোঁড়ার ব্যথা এতই তীব্র যে, পিঠের কাঁটার যন্ত্রণাকে রীতিমতো মামুলিই মনে হচ্ছে। তাই ডাক পড়লো বঙ্কিম কাকার। অর্থাৎ চৌরাস্তা বাজারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ডাক্তার বঙ্কিম চন্দ্র রায়ের। তিনি এসে ভালো করে পা দেখলেন, বললেন, ‘ফোঁড়া কেটে পুঁজ বের করতে হবে।’
এরপর ফোঁড়া কাটার আয়োজন শুরু। ভেবেছিলাম, কোনো ইনজেকশান দিয়ে অবশ করে তারপর কাটবেন। কিন্তু না। তিনি হারিকেনের আগুনে একটি নতুন ব্লেড পোড়ালেন। এরপর আমার চোখে চোখ রেখে বিভিন্ন গল্প শুরু করলেন। হঠাৎই পোচ দিলেন ফোঁড়ায়। প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। বঙ্কিম কাকা বললেন, ‘চুপ করে থাক।’ দুই হাতের সর্বশক্তি দিয়ে পুঁজ বের করে ডেটল দিয়ে ভালো করে ক্ষতস্থান ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। জানতে চাইলেন, ফোঁড়া ওঠার কারণ কী? তাকে সবিস্তারে খেজুর কাঁটা বিঁধে যাওয়ার ঘটনা খুলে বলি। বঙ্কিম কাকা, প্রায় ত্রিশ মিনিট চোখ বন্ধ করে রাখেন। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘তোকে আল্লাহ কোন মাটি দিয়ে বানাইলো, আল্লার লগে দেখা হইলে জিগাইতাম। বাচ্চারা দুষ্টুমি করে। তাই বলে এতটা বাঁদরামি! তুই কোন বাঁদরামিটা না করছিস? দ্যাখ বাবা, তুই যা বললি, তাহলে তো ফোঁড়ার কারণ ওই খেজুর কাঁটাই। সাবধানে থাকিস। দেখবি একদিন কাঁটা বের হয়ে যাবে। আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি।’
তার প্রস্তাবে বিস্মিত, ‘আমরা গান লিখবো’ মানে কী? সে যদি লিখতে চায়, লিখবে। সেখানে আমরা লিখবো বলার মানে কী? আমি তার কথা ধরতে পারি না। তাই জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাই। সে বলে, ‘বুঝিসনি?’ বলি, ‘না। বুঝিয়ে বল।’
ওষুধ খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে মা এসে ভাত দিয়ে গেলেন। উঠে বসবো, সেই শক্তি নেই। পায়ের ব্যথা-পিঠের ব্যথা—দুই যন্ত্রণায় ধরাশায়ী। কোথাও যেতে পারি না। তাই ক্লাসমেট-সমবয়সী-আত্মী-স্বজনরা আমাকে প্রায় দেখতে আসে। আর আমার দুর্ভাগ্যের জন্য আপসোস করে, জানায় সমবেদনাও। অনেক দিন পর খোকন এলো। এ কথা-সেকথার পর বলে, ‘তোর কাব্যচর্চা কেমন চলছে?’ বলি, ‘মাঝেমাঝে লিখি। যন্ত্রণায় লিখতে ইচ্ছে করে না। আর সাদা কাগজও প্রায় শেষ।’ টেবিলের ওপর থেকে নিউজপ্রিন্টের সাদা খাতা টেনে খোকন বলে, ‘এত বড় সাদা খাতা, তবু বলিস সাদা কাগজ শেষ?’ তার কথায় ম্লান হাসি। ড্রয়ার থেকে আমার বিখ্যাত পার্কার কলম বের করে দেখাই। বলি, ‘সেই ক্লাস টু থেকে এই পার্কার কলম দিয়ে লিখি। আমাকে কখনো বলপেন দিয়ে লিখতে দেখেছিস?’ সে নিরুত্তর। বুঝতে পারি কখনো সে খেয়াল করেনি আসলেই আমি কী কলমে লিখি।
পার্কার কলমটা যথাস্থানে রাখতে রাখতে খোকনের মুখোমুখি হই—‘তুই নতুন কিছু লিখেছিস?’ আমার কথা তার কানে যায় না। কারণ ওই সময় আমার একব্যান্ড রেডিওতে বাজছিল আবু জাফরের লেখা গান—‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে/ আমার রাখাল মন, গান গেয়ে যায়—এই আমার দেশ, এই আমার প্রেম, আনন্দ-বেদনায়-মিলন-বিরহ সংকটে।’ গানের শিল্পীও আবু জাফর, সঙ্গে ফরিদা পারভিন। গানের প্রতি মোহ খোকনেরও। তাই তাকে আর বিরক্ত করি না। আমিও সহশ্রোতা হয়ে যাই। গান শেষ হলে এবার খোকনের মুখে হাসি ফোটে—‘কী যেন বলছিলি?’
তার প্রশ্নে আমিও হাসি—‘বলছিলাম, তুই কি ছড়া-কবিতা কিছু লিখেছিস এই কদিন?’ আমাকে হতাশ করে দিয়ে সে উত্তর দেয়—‘না রে। ভালো লাগে না। আমার অন্য কিছু লিখতে ইচ্ছা করে।’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকাই। কী বলছে সে? ছড়া-কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে না! অন্য কিছু লিখতে ইচ্ছা করে। সবিস্ময়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেই—‘কী ইচ্ছা করে?’ গান শোনার প্রতি তার আগ্রহ-অভ্যাসের কথা জানি। আমার মতো সেও বালিশের নিচে রেডিও রেখে গান শোনে। তবে, সে আসার চেয়ে আরেকধাপ এগিয়ে। রেডিওতে যত নাটক প্রচারিত হয়, তার সবই সে শোনে। রেডিও-নাটকের এমন নিবিষ্ট শ্রোতা দ্বিতীয়টি দেখিনি। সে কেবল শোনেই না, ওইসব নাটকের কাহিনী-সংলাপের পাশাপাশি পরিবেশও বর্ণনা করে। শুনে তো আমি থ। আমার স্মরণশক্তি তার চেয়ে বেশি হলেও অতটা মনোযোগ দিয়ে নাটক বোধ হয় শুনিনি কখনো।
‘কী ইচ্ছা করে’—আমার এমন প্রশ্নের জবাবে সহজে উত্তর আসে না তার কাছ থেকে। সে কিছুটা ভূমিকা করে। গান কী ও কেন, গানের সঙ্গে সুরের, সুরের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কী যোগসূত্র—এসব বোঝায়। আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনি। আর ‘হ্যাঁ-হু’ বলি। হঠাৎ তার চোখ যায় আমার সেল্ফের দিকে—সেখানে অন্যান্য বইয়ের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে উস্তাদ মুনশী রইস উদ্দীনের ‘ছোটদের সারেগামা’। খোকন বইটি টেনে নিয়ে কয়েকপাতা উল্টেপাল্টে দেখে। এরপর তার প্রথম বাক্য—‘চল আমরা গান লিখবো।’ তার প্রস্তাবে বিস্মিত, ‘আমরা গান লিখবো’ মানে কী? সে যদি লিখতে চায়, লিখবে। সেখানে আমরা লিখবো বলার মানে কী? আমি তার কথা ধরতে পারি না। তাই জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাই। সে বলে, ‘বুঝিসনি?’ বলি, ‘না। বুঝিয়ে বল।’
এবার আমার ছন্দশাস্ত্রের ছাত্রের সংগীতের গুরু সাজার অভিনয় শুরু। বলে, ‘গানে কয়টি স্তবক, জানিস তো? মনে কর চারটি। তাহলে প্রথম ও তৃতীয় স্তবক আমি লিখবো, দ্বিতীয় ও চতুর্থ স্তবক তুই লিখবি। যৌথ রচনা হবে। কী কেমন আইডিয়া?’ বিস্ময়ের মাত্রা আমার বাড়তে থাকে—‘আইডিয়া তো চমৎকার। এই ধরনের লেখাকে কী বলে, জানিস?’ সে ‘না-সূচক’ মাথা নাড়ে। এই সুযোগে আমি আবার গুরুর আসন দখল করে তাকে পাঠিয়ে দেই শিষ্যের কাতারে। তখন মনে পড়ে, কদিন আগেই একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম, রামের সুমতির লেখক অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র তার আরও এগারো সহলেখককে নিয়ে ‘রসচক্র’ নামে একটি বারোয়ারি উপন্যাস লিখেছেন। বাকি এগারোজন কারা, এতদিনে তাদের নাম ভুলে গেছি। কিন্তু ভুলিনি ‘রসচক্র’ও শরৎচন্দ্রের নাম। শরৎচন্দ্রের নাম মনে থাকার কারণও আছে। কদিন আগে রামের সুমতি নামে একটি বই (সিনেমা) দেখেছি বিটিভিতে। সেখানে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল কাহিনী অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখনই তার নাম মনে গেঁথে গিয়েছিল। ওই ঘটনারই কদিন পর মায়ের নতুন শাড়ির ভাঁজ খুলতে গিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকার দুটি পাতা পেয়ে যাই। আর সেখানে ‘রসচক্র’নামের বারোয়ারি উপন্যাস লেখার ঘটনাও বর্ণনা করেন লেখক। সঙ্গে শরৎচন্দ্র ও তার এগারো সহলেখক সম্পর্কেও মূল্যায়ন ছিল। তবে, ওই প্রবন্ধের শিরোনাম কিংবা লেখকের নাম; কোনোটাই মনে নেই।
আমার কথা শেষ হয় না, তার আগে ডাক্তার নূর উল্লাহর গলার আওয়াজ ভাসে—‘মহি উদ্দিন, খালাতো ভাইরে নিয়ে আয় ভেতরে। হের তো মাথা গরম। হেরে আগে বিদায় করতে হইবো। বুঝতে পারছি।’ কথা শুনে মহিউদ্দিন আমাকে ভেতরে নিয়ে যান
‘বারোয়ারি’ শব্দ ও এর স্বভাব-চারিত্র্য সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে। তাই খোকনকে বলি, এই ধরনের রচনাকে বলে, ‘বারোয়ারি রচনা। আমরা এসব গান লিখে কী করবো? কে গাইবে আমাদের গান?’ খোকন বলে, ‘আরে বোকা আগে লিখি। ২৫টি গান লেখা হয়ে গেলে চট্টগ্রাম বেতারে পাঠিয়ে দেবো। রেডিওতে শুনিসনি, ২৫টি গান পাঠাতে হয়? পাঠালে তারা গানগুলো ভালো করে দেখে, তারপর শিল্পীরা কণ্ঠ দেন।’ আমি মাথা নাড়ি। খোকন বলে চল, ‘দুজনে মিলে গান লিখি।’
খোকনের প্রস্তাব পাস হয়ে গেলো। সেই থেকে শুরু। বহুদিন যাবত দুজনে মিলি কত দেশাত্মবোধক আর প্রকৃতির গান যে লিখেছি, সবই বারোয়ারি, তার ইয়ত্তা নেই। মজার ব্যাপার হলো, এসব গান লিখে লিখে আমরা খাতা ভর্তি করে ফেললেও রেডিও অফিসে আর পাঠানো হয় না। একদিন খোকনকে বলি, ‘অনেক তো লিখলাম, ত্রিশটিরও বেশি হবে। কবে পাঠাবি গানগুলো?’ সে বলে, ‘গান তো দুজনে লিখেছি, কার লেখা বলে পাঠাবো?’ বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। বললাম, ‘তুই ভাবতে থাক, আমিও ভাবি। উপায় একটা বের হবেই।’
কার নামে গান চট্টগ্রাম বেতারে পাঠাবো, এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমাদের সপ্তাহ পার। সমাধান বের হয়নি। ইতোমধ্যে আমার বাম পায়ের গোড়ালির ওপর আবারও টিউমারের মতো ফোঁড়া। তীব্র ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারি না। কেবল ব্যথাই নয়, সঙ্গে পা থেকে দুর্গন্ধও বের হয়। এই দুর্গন্ধের কারণে রাতে কেউ আর কাছারিতে থাকে না। না রাসেল, না ইসমাইল। সারারাত আমি একলা থাকি। হঠাৎ একদিন এলো সলিমুল্লাহ। সে চৌরাস্তা বাজারের বিখ্যাত ‘বড্ডা ভাই’য়ের ছেলে। পড়ে ক্লাস ফাইভে। বৃত্তান্ত শুনে বলে, ‘তোর কাছে তো একজন থাকা দরকার। একলা থাকলে কখন কী হয়? টেনশন করিস না, আমি থাকবো।’ সেই থেকে সলিমুল্লা রাতে এসে কাছারিতে থাকা শুরু করে। আর মাঝেমধ্যে মহিউদ্দিন এসে খোঁজ-খবর নেন।
একদিন সকালে মহিউদ্দিন এসে বললেন, ‘তুই কি একবার মামার কাছে যাইবি?’ বলি, ‘কোন মামা?’ প্রশ্ন শুনে হেসে দেন মহিউদ্দিন—‘মামাকে চিনিস না? ডাক্তার নূরউল্লাহ। তোর বৃত্তান্ত খুলে বললে মামা ওষুধ দেবেন। দেখবি কাঁটা হয় বের হয়ে যাবে, না হয় গলে যাবে।’ মহিউদ্দিনের প্রস্তাবে সলিমুল্লাহও রাজি হয়। বলে, ‘কাকা তোকে আমি ধরে ধরে নিয়ে যামু। চল আজ বিকালেই।’
বিকালে গিয়ে হাজির ডাক্তার নূর উল্লাহর হোমিও চেম্বারে। তার চেম্বারে বেশ কয়েকটি রুম। কোনো রুমে ওষুধের প্যাকেট তৈরি হচ্ছে, কোনো রুমে নারীরা বসে আছে। কোনো রুমে পুরুষরা। কেউ এসে সঙ্গে সঙ্গে তার সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না। আমি এসেছি, এই খবর তাকে মহিউদ্দিন দিলেও তিনি গা করেন না। বলেন, ‘সামনের রুমে বসতে হবে। আগে যারা এসেছেন, তাদের সমস্যা শুনতে হবে। রোগের বৃত্তান্ত এন্ট্রি করতে হবে। এরপর রাতে নিদান খুলে দেখতে হবে, কোন সমস্যার কী সমাধান।’
ডাক্তার নূর উল্লাহ যেভাবে বললেন, হুবহু সেভাবেই মহিউদ্দিন এসে আমাকে শোনালেন। শুনে আমার মেজাজ ধরে রাখা কঠিন। চিৎকার করে বলি, ‘এইটা মামুর বাড়ির আব্দার নাকি? একজন রোগী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকবে বাইরের রুমে? তিনি রোগীর কথা শুনবেন নিজের সময় মতো? শোন্ মহিউদ্দিন, তোর মামারে বল, এক্ষুণি আমার পায়ের সমস্যার কথা যদি না শোনেন, তাহলে তার ডাক্তারি বন্ধ। আমি সবাইকে বলবো, তিনি ডাক্তারি করেন না, এখানে বসে বসে…।’ আমার কথা শেষ হয় না, তার আগে ডাক্তার নূর উল্লাহর গলার আওয়াজ ভাসে—‘মহি উদ্দিন, খালাতো ভাইরে নিয়ে আয় ভেতরে। হের তো মাথা গরম। হেরে আগে বিদায় করতে হইবো। বুঝতে পারছি।’ কথা শুনে মহিউদ্দিন আমাকে ভেতরে নিয়ে যান।
এবার সোজাসুজি তার দিকে তাকাই—‘‘গানগুলো আমাদের দুজনের নামেই পরিচিতি পাবে। আমার নামের ‘নূরুল’, তোমার নামের ‘আসাদ’—দুই নামের দুই শব্দ নিয়ে নতুন নাম হবে ‘নূরুল আসাদ’। কী পছন্দ হয়েছে লেখক নাম?’’
ডাক্তার নূর উল্লাহ এবার আমাকে জেরা শুরু করেন। এর আগে কখনো কাঁটা বিঁধেছে কি না, এই কাঁটা কতদিন আগে বিঁধেছে? কোনো ওষুধপত্তর খাচ্ছি কি না, ব্যথা হয় কি না, হলে কেমন? বংশে আর কারও পায়ে কাঁটা বিঁধেছে কি না? তার প্রশ্নের ফিরিস্তি শুনে আমার বিরক্তি চরমে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। দাঁতে দাঁতে ঠক ঠক করে। বিষয়টি তিনি আঁচ করতে পেরেছেন কি না জানি না, কিন্তু আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করেননি। কিছু ওষুধ দিয়ে সেবনবিধি বলে দিলেন। আর মহিউদ্দিনের উদ্দেশে বললেন, ‘খালাতো ভাইয়ের কাছ থেকে কোনো ফিস লাগবে না। ওষুধের দামও না। আগে সে ভালো হোক। তাকে বাড়িতে দিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।’
মহিউদ্দিন ও সল্লিমুল্লাহ—দুজনের কাঁধে হাত রেখে বাড়ির পথ ধরি। দুজনেই আমার বদমেজাজ ও ডাক্তার নূরউল্লাহর ভয় পাওয়া নিয়ে পথে পথে এন্তার আলাপ জুড়ে দেয়। তাদের আলাপের ভেতর আমি ভাবতে থাকি গানের কথা। খোকনসহ যে বারোয়াগি গান লিখছি, এগুলোর ভবিষ্যৎ কী? কে কার স্বত্ব ছেড়ে দেবো? কার নামে গানগুলো পরিচিতি পাবে?
ভাবতে ভাবতে কাছারিতে পৌঁছে গেলাম। সন্ধ্যায় খোকন আসে বাজারে। বাজার থেকে সোজা কাছারিতে হাজির। বলে, ‘কী কোনো সমাধান খুঁজে ফেলি?’ তার প্রশ্নে আমি রহস্যময় হাসে দেই—‘আমি কি আর গুরু এমনি এমনি হইছি? তুই কি আর এমনি এমনি আমারে গুরু মানবি? সমাধান তো পাইছি। তোরও পছন্দ হইবো। পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণই নাই।’ আমার রহস্যময় কথাবার্তায় খোকন হতবম্ভ। হা করে থাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে কিছু বলে না, চোখের ভ্রূ নাচিয়ে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে তাকায় আমার দিকে। এবার তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেই—‘তোর পুরো নাম কী?’
—কাজী মোহাম্মদ আসাদুল হক।
—‘কাজী মোহাম্মদ’ বাদ দিলে?
—আসাদুল হক।
—আমার পুরো নাম কী?
—মোহাম্মদ নূরুল হক?
—‘মোহাম্মদ’ বাদ দিলে?
—নূরুল হক।
—ইউরেকা!
—কী?
এবার সোজাসুজি তার দিকে তাকাই—‘‘গানগুলো আমাদের দুজনের নামেই পরিচিতি পাবে। আমার নামের ‘নূরুল’, তোর নামের ‘আসাদ’—দুই নামের দুই শব্দ নিয়ে নতুন নাম হবে ‘নূরুল আসাদ’। কী পছন্দ হয়েছে লেখক নাম?’’ খোকনের মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। পলকহীন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখে অবিশ্বাস-সন্দেহ আছে কি না, জানি না। তবে সাত সমুদ্র তেরো নদীভরা বিস্ময় যে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের মতো চমক খেলছে, তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৩০॥ মোহাম্মদ নূরুল হক