[পর্ব-২৯: জুনিয়র হাইস্কুল পর্ব]
বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে আগে ব্যাংকঋণ শোধ করলেন বাবা। এর পর বাকি টাকা থেকে কিনলেন ছয়টি বাইসাইকেল। পাঁচটি বড়দের, একটি ছোটদের। চৌরাস্তা বাজারের দক্ষিণ মাথায় রাস্তার পূর্বপাশে ভাড়া করা দোকানে সাইকেল গ্যারেজ হলো। সঙ্গে মবিল-ডিজেল-পেট্রোলও আছে। সাইকেলগুলো ভাড়া দেই। ঘণ্টায় পাঁচ টাকা। স্কুল থেকে ফিরে প্রায় দোকানে বসি। লোকজন সাইকেল ভাড়া নিতে আসে। বাইসাইকেল নেওয়ার সময় খাতায় টুকে রাখি। জমা দিতে এলে, সেই সময়ও। আর সময় হিসাব করে ভাড়ার টাকা গুনে নেই। পাশাপাশি মোবিল-পেট্রোল-ডিজেলও বিক্রি করি। দোকানে থাকি সকাল আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। এরই মধ্যে বাবা এসে দোকানে বসেন আর আমি বের হয়ে স্কুলে চলে যাই।
এ সময় নজরুলগীতি-রবীন্দ্রসংগীত-আধুনিকগানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। ৯০ টাকা দিয়ে ন্যাশনাল কোম্পানির একটি একব্যান্ড রেডিও কিনি। তখন সকাল আটটার সংবাদ প্রচারের পর বাংলাদেশ বেতারের কোন কেন্দ্র থেকে সপ্তাহের কোন দিন কী গান প্রচারিত হতো, সেই সময়সূচির পুরোটাই মুখস্ত ছিল। ফলে কোন দিন কোন সময় নজরুলগীতি, কোন সময় রবীন্দ্রসংগীত, কোন সময় আধুনিক গান, কোন সময় পুরনো দিনের গান বাজতো, তা জানা ছিল। যখন দোকানে বসতাম, তখন সকাল আটটার সংবাদ শুরু হতো। সংবাদ পরিবেশনের সময় ছিল পাঁচ মিনিট। এরপরই গান। প্রতিটি গান সাধারণত পাঁচ মিনিট করে পরিবেশিত হতো। ফলে কেউ সাইকেল ভাড়া নিতে বা ফেরত দিতে এলে দেয়াল ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই খাতায় সময় উল্লেখ করে বিল দাবি করতাম। তখন কেউ কেউ বলতেন, কতক্ষণ হলো, তুমি জানলে কিভাবে? তুমি তো ঘড়ির দিকেই তাকালে না? তাদের প্রশ্ন শুনে আমি বিশ থেকে ত্রিশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখতাম, এরপর ওই মুহূর্তে ঘটিড়ে কয়টা বাজতে পারে, তা বলতাম। তারা বিস্মিত হয়ে যেতেন, কিভাবে সময় বলতে পারি! আসলে আমি যখন চোখ বন্ধ করতাম, তখন রেডিওতে প্রচারিত গানটি ওই সময়ের কত নম্বর গান এবং সেই গানের স্থায়ী-অন্তরা-আভোগ-সঞ্চারীর কোন অংশ বাজছে, তা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। এরপর হিসাব করে ঘড়ির সময় বলতাম।
মহিউদ্দিন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার টুলে বসে পড়লেন। বললেন, ‘টাকা নানারে দিমু। হেতেনরে জিগামু পোলারে এত হিসাবী বানাইছেন ক্যামনে?’ মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই বাবা এসে ঢুকলেন।
একদিন দোকানে এলো—মহিউদ্দিন। এই মহিউদ্দিন সম্পর্কে আমার ভাগ্নে হন। তার মা আমার খালাতো বোন। তার দুই মামার একজন হোমিও চিকিৎসক নূর উল্লাহ, অন্যজন গৃহস্থ নুরুল হুদা। মহিউদ্দিন আমার ভাগ্নে হলেও বয়সে আমার চেয়ে বড় ছিলেন। ছিলেন বলছি এজন্য যে, সম্প্রতি তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
সেদিন সকাল ঠিক আটটার সময় মহিউদ্দিন এলেন সাইকেল ভাড়া নিতে। চাবি হাতে তুলে দিতেই দ্রুত চলে গেলেন। ফিরে এলেন ঠিক সোয়া নয়টায়। এসে সাইকেল জমা দিলেন। সঙ্গে দিলেন পাঁচ টাকা। বললাম, ‘সাত টাকা দেবেন। পনেরো মিনিট বেশি চালিয়েছেন।’ তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘নানির পোলা তুই আঁরে চিনোসনি? আঁই তোর ভাগিনা। তোর খালাতো ভাই ডাক্তার নূর উল্লা আছে না? আঁই হেতেনের ভাগিনা। তোরও ভাগিনা। তোর বাপ তো দশ-পনেরো মিনিট বেশি হইলে কিছু কয় না। তুই কোনতুন হইছোত এত হিসাবী আর কিপটা?’
মহিউদ্দিনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা হাত বাড়িয়ে দেই। উদ্দেশ্য হ্যান্ডশেক। বলি, ‘মামা চিনতি পারিনি। পরিচয় নাই তো। কিন্তু আম্নে তো ১৫ মিনিট বেশি চালাইলেন সাইকেল।’ এবার তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আচ্ছা সাইকেল নিলাম কয়টায়? আর দিলাম কয়টায়? তুই তো বেটা ঘড়ি না দেখেই মুখস্ত কইলি ১ ঘণ্টা পনের মিনিট। আন্দাজে কইলে অইবো?’ তার খোঁচায় আমার মেজাজ গরম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জোর করে নিজেকে ঠাণ্ডা রাখি। কারণ বাবা বলেছেন, কাস্টমারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা যাবে না। কাস্টমার হলেন মহাজন। তাদের সঙ্গে বিনয়ী হয়ে কথা বলতে হবে। তাই আমিও যতটা সম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বলি, ‘মামা এখন কয়টা বাজে, ঘড়ি না দেখেও বলতে পারবো।’ শুনে মহিউদ্দিন রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেন, ‘দেখি বল তো।’ বললাম, ‘সকাল নয়টা বিশ।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, ‘বিশ না একুশ। তারপরও কিভাবে সম্ভব?’ তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলি, ‘মামা, স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে, আব্বাজি এলে চলে যাবো। আম্নে টাকাটা দেন।?’
মহিউদ্দিন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার টুলে বসে পড়লেন। বললেন, ‘টাকা নানারে দিমু। হেতেনরে জিগামু পোলারে এত হিসাবী বানাইছেন ক্যামনে?’ মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই বাবা এসে ঢুকলেন। ক্যাশবাক্সের ভেতর থেকে ৫ টাকা, সঙ্গে একব্যান্ড রেডিওখানা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে বের হবো এমন সময় মহিউদ্দিন বললেন, ‘ব্যাটা খাড়া।’ আমি পেছন ফিরে তাকাতেই বললেন, ‘তোর লগে আঁইও যামু।’ আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে, মহিউদ্দিন বাবার সঙ্গে কী কী কথা বলছেন, আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছি না। তবে, দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলেন যখন, তখন মনে হলো, তাদের মধ্যে বেশ ভাব আছে। আর নিশ্চয় হাসির কোনো কথা বলছেন।
সূর্য তখন স্কুলের চার তলা ভবনের নিচে নেমে গেছে। তার দীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে মাঠে। স্কুলের আশেপাশে থাকা আমার বয়সীরা সব এসে মাঠে হাজির।
সংগীতের প্রতি আমার ‘আসক্তি’ ও গান শুনে শুনে সময়ের হিসাব কষার বিষয়টি বাবা জানতেন। আর সেই গোপন রহস্য তিনি মহিউদ্দিনকে বলে দেন। সেদিন মহিউদ্দিন আমার সঙ্গে বাড়ির দরোজ পর্যন্তে যেতে যেতে সেই কথা আমাকে জানালেন। এরপর আমি কাছারির দিকে চলে গেলে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। এই মহিউদ্দিনের সঙ্গে পরে সখ্য গড়ে ওঠে। একসময় তা নিবিড় সম্পর্কে পরিণত হয়। তারই সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে নূরুল হক (বর্তমান নাম মিজান বিন মজিদ), ইউসুফ জামানের সঙ্গেও পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। শেষোক্ত দুজনই মহিউদ্দিনের ক্লাসমেট ছিল। এরমধ্যে নূরুল হক সম্পর্কে মহিউদ্দিনের মায়ের ও আমার মামা হয়। সেই হিসেবে মহিউদ্দিনের নানা। কিন্তু তাদের মধ্যে সেই নানা-নাতি আচরণ-সম্বোধন কোনোটাই ছিল না। ছিল ভাইয়ের মতো ব্যবহার। আরও একটি তথ্য জানিয়ে রাখি, তারা তিন জনই ছিলেন প্রতিবেশী।
শুক্রবার বা স্কুল ছুটি ছিল—এমন একদিন মহিউদ্দিন এলেন সাইকেল ভাড়া নিতে। যাবেন চরবাটা ছমিরহাট। বললেন, যাবেন আর আসবেন, সব মিলিয়ে ৫/৬ ঘণ্টা লাগতে পারে। তবে ২০ টাকার বেশি দেবেন না। আমি টাকার অঙ্ক নিয়ে তর্ক না করে বলি, ‘৫/৬ ঘণ্টা লাগবে কেন? আসা-যাওয়ায় সবমিলিয়ে ৪ ঘণ্টার বেশি সময়ই তো লাগার কথা না।’ মহিউদ্দিন সাধারণত উত্তেজিত হতেন না। সেদিনও হননি। বললেন, ‘আরে নানির পোলা, সাইকেল চালাইতে পারোসনি?’ বলি, ‘না।’ এবার বিদ্রূপের হাসি দিয়ে বললেন, ‘সাইকেল চালাইতে জানোস না। কিন্তুক আন্দাজে কইয়া দিলি মাত্র চারঘণ্টায় আসা যায়। ব্যাটা সাইকেল চালানো আগে শিখে ল। হেরপর মাইনষেরে জ্ঞান দিস।’ তার কথায় আমি রাগ করি না। তাকে তখন আত্মীয় নয়, কাস্টমার হিসেবেই দেখি। কাস্টমার হলো মহাজন। সেই মহাজনের ওপর রাগ করতে নেই। আমিও রাগ করি না।
মহিউদ্দিন চলে গেলে ভাবতে বসি, আরে! বাবা সাইকেল কিনেছেন এতদিন হলো, এখনো চালানোটাই শিখলাম না। কিভাবে চালাতে হয়, তা অন্যদের শেখনপদ্ধতি দেখে বুঝেছি। কিন্তু আমাকে কে শেখাবে? সেদিন তখনো বাবা দোকানে আসেননি। ইসমাইল এলো। তাকে দোকানে বসিয়ে রেখে একটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। চালাতে তো জানি না। তাই হ্যান্ডলবার ধরে ঠেলে ঠেলে জুনিয়র হাইস্কুলের পথ ধরি। স্কুলের মাঠে পৌঁছে ভাবনা শুরু—কিভাবে শিখি। হঠাৎ মাথায় চাপলো দুষ্টুবুদ্ধি। মাঠের উত্তরপাশের ভিটার ওপর এসে দাঁড়াই। এরপর সাইকেলের সিটে বসে হ্যান্ডলবার ধরে নেমে পড়ি মাঠে। সামান্য কিছু দূর গিয়ে কাৎ হয়েই পড়ে যাই। আবার ফিরি ভিটায়। আবার একই পদ্ধতি। এভাবে বারকয়েক চেষ্টার পর আস্তে আস্তে প্যাডেলে চাপ দিতে থাকি। তাতে আরও বিপত্তি। আগে মাঠের মাঝ বরাবর যেতে পারলেও এখন অর্ধেকও না। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। শিখতেই হবে।
ততক্ষণে আসরের আজান পড়ে গেছে। লোকজন বাড়ি থেকে বের হতে শুরু করেছে। যাবে আক্তার মিয়ার হাট জামে মসজিদে। কেউ কেউ হাটে যাবে। জেনাজানা লোকজন আমার কাণ্ড দেখে হাসি-ঠাট্টা করেন। বলেন—‘সাইকেল এইভাবেই শিখেনি? একজন ধরে ধরে শিখাইতে হয়। এইভাবে জীবনেও শিখতে পারবি না।’ তাদের কথার জবাব দেই না। নতমুখে নিজের সাধনায় মনযোগ দেই। কঠোর সাধনা চালিয়ে যাই।
সূর্য তখন স্কুলের চার তলা ভবনের নিচে নেমে গেছে। তার দীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে মাঠে। স্কুলের আশেপাশে থাকা আমার বয়সীরা সব এসে মাঠে হাজির। তারা ফুটবল খেলবে। তারা মাঠে নামলে আর সাধনার সময় পাবো না। কায়মনোবাক্যে ওপরঅলাকে ডাকি। আর ভিটা থেকে সাইকেল নামিয়ে দিয়ে প্যাডেল চাপতে থাকি। প্রথমে ধীরে, খুব ধীরে। এরপর গতি বাড়াই। খেয়াল করি, কোমরই আসল। কোমর সোজা করে রাখতে পারলে হ্যান্ডলবারে থাকা হাত আর কাঁপে না। এবার ভিটা থেকে মাঠের দক্ষিণ মাথা পর্যন্ত যেতে সক্ষম হই। এরপর ভাবি, মাঠের ভেতর ঘুরে ঘুরে কয়েক চালিয়ে দেখি। খুদে খেলোয়াড়রা মাঠে নামা আগপর্যন্ত কয়েকপাক চালিয়েও নিলাম।
জবাব শুনে স্যার বললেন, ‘দেখো কাণ্ড! তোমাকে কে বলেছে স্যারের সামনে সাইকেল চালানো যায় না? স্যারকে দেখলে দ্রুত পালাতে হয়? তুমি স্যারকে দেখেছ, সালাম-আদাব দেবে। ব্যস। এটাই শিষ্টাচার। ছুটে পালানোটা শিষ্টাচার না। মনে থাকবে?’
আত্মবিশ্বাস জন্মালো। পারবো। শেষবারের মতো ভিটার ওপর গিয়ে দাঁড়াই। এবার আর দক্ষিণমুখী নই। পূর্ব-উত্তর কোণমুখী। চড়ে বসি সাইকেলে লক্ষ্য বাড়ির পথ। কিন্তু না। কিছু দূর এসেই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। রাস্তার পাশে তেমন উঁচু কোনো জায়গাও নেই, যেখান থেকে চালানো শুরু করবো। অগত্যা ঠেলে ঠেলে হাঁটা শুরু। সুফিয়ান হাজি বাড়ির উত্তর পাশের কালভার্টের ওপর এসে একটা আশার আলো জ্বলে উঠলো মনের কোণে। কালভার্ট রাস্তার চেয়ে উঁচু। সূর্য তখনো ডোবেনি। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ ধানক্ষেত। যতদূর চোখ যায়, তত দূর আকাশ আর সবুজের মিতালি। আনমনা হয়ে পড়ি।
সাইকেলখানা কারভার্টের সঙ্গে ঠেস দিয়ে আমিও বসে পড়ি। আজ আমি ভিষণ আনন্দিত। কোনো প্রশিক্ষক ছাড়াই সাইকেল চালানো শিখে ফেলেছি। যদিও এখন যেকোনো জায়গা থেকে বাইকেলে উঠতে পারি না, চালাতে পারি না—চালাতে হলে রাস্তার চেয়ে উঁচু জায়গা খুঁজে বের করতে হয়। আরও একটি কারণে মনে আনন্দের ঢেউ। সেবাপ্রকাশনী আমাকে নিয়মিত গ্রাহক করে নিয়েছে। তিন গোয়েন্দা সিরিজের নতুন বই বের হলেই তারা পাঠিয়ে দেবে। বৃহস্পতিবারেই এসেছে একটি পার্শ্বেল। ডাকপিওন এসে দিয়ে যাবেন আজ সন্ধ্যায়। এই দুই আনন্দে আমি তখন উড়ু-উড়ু। নাহ! আর বসে থাকা যাবে না। এবার উঠতে হবে। সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দরজার কাছাকাছি এসে গেছি, তখনই চোখ পড়লো হেড স্যার সাইকেলে আসছেন। কী করি, কী করি? স্যারের সামনে সাইকেল চালানো অশোভন। তাই দ্রুত প্যাডেলে চাপ দিয়ে বাড়ির দিকে মোড় নিলাম। তখন সদর দরোজা ছাড়া পুরো বাড়ির চারপাশে মান্দার (পলাশ) কাঁটার হাফ বেড়া ছিল। দরোজা দিয়ে ঢুকতেই দক্ষিণপাশে বিশাল আকারের একটি ডুমুর গাছ। গাছতলায় পড়ে আছে অসংখ্য পাকা ডুমুর। আর দক্ষিণ পাশ থেকে কাঁটার বেড়া এসে শেষ হয়েছে এই ডুমুর গাছের কাছেই। প্রতিবেশীদের গবাদি পশু যেন বাড়িতে ঢুকে পড়ে গাছপালা নষ্ট করতে না পারে, সে জন্যই মান্দার কাঁটার বেড়া।
স্যারকে আসতে দেখে সাইকেল ঘুরিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। অমনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম মান্দার কাঁটার বেড়াও ওপর। ডুমুর গাছের গোড়ায়। অসংখ্য কাঁটা বিঁধে গেলো পিঠে, সেই যন্ত্রণা যেই চিৎকার দিতে যাবো, অমনি সাইকেল এসে পড়লো বুকের ওপর। আমার তখন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। চোখ বন্ধ করে আছি। কে যেন সাইকেল সরিয়ে আমার দুই বাহু ধরে টেনে তুললেন। চোখ খুলে দেখি হেড স্যার। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেও সালাম দিতে গেলাম, স্যার বললেন, ‘সালাম পরে। চলো তোমাকে কাছারিতে নিয়ে যাই।’ কাছারি ফিরে জামা খুলে দেখি, রক্ত আর থেঁতলে যাওয়া পাকা ডুমুর একাকার হয়ে গেছে। স্যার বললেন, ‘রক্ত বেশি বের হয়নি। এগুলো ডুমুরের রঙ।’ ঠিক তখনই দোকানের দিকে যাচ্ছিলেন বাবা। স্যার বাবাকে দেখে বললেন, ‘দেখুন আপনার ছেলের কাণ্ড, কী করেছে। তাড়াতাড়ি বাজারে যান। বঙ্কিম ডাক্তারকে নিয়ে আসুন।’
বাবা কাছে এসে বললেন, ‘এমন করলি ক্যামনে?’ বলি, ‘স্যারকে দেখে তাড়াতাড়ি সাইকেল ঘোরাতে গিয়ে পড়ে গেছি।’ জবাব শুনে স্যার বললেন, ‘দেখো কাণ্ড! তোমাকে কে বলেছে স্যারের সামনে সাইকেল চালানো যায় না? স্যারকে দেখলে দ্রুত পালাতে হয়? তুমি স্যারকে দেখেছ, সালাম-আদাব দেবে। ব্যস। এটাই শিষ্টাচার। ছুটে পালানোটা শিষ্টাচার না। মনে থাকবে?’ ঘাড় কাৎ করে বলি, ‘জি স্যার।’ বাবা তখন বঙ্কিম ডাক্তারকে ডেকে আনতে দ্রুত বের হয়ে যান। আর হেডস্যার আমার পিঠ থেকে খুঁজে খুঁজে কাঁটা বের করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-২৮॥ মোহাম্মদ নূরুল হক