[পর্ব-২৫: জুনিয়র হাইস্কুল পর্ব]
বাম পায়ে গেঁথে যাওয়া খেজুর কাঁটা আর কোনোভাবেই বের করা সম্ভব হয়নি। কয়েকদিন বঙ্কিম ডাক্তারের ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা কমে যায়। একসময় মনে হয় আর ব্যথা নেই। তবে হাঁটতে গেলে কষ্ট হয়। তাই বাম হাতে একটি লাঠি রাখি। তাতে ভর দিযে হাঁটলে পায়ের ওপর চাপ কমে। ব্যথাও পাই না।
একদিন সকালে ধনু কাকা, খোকন, খায়রুল বাসার, বেলাল, আনোয়ার হোসেন কাছারিতে এসে হাজির। তখন কেবল সকাল ৮টা বাজে। আমি তখনো শুয়ে। ধনু কাকা ধাক্কা দিযে বলে, ‘কী রে ব্যটা সিক্সে ভর্তি হইবি না? তোরে তো আগেই বলে রাখলাম, আজ যামু। তুই দেখি এখনো ঘুমাস! উঠ বেটা।’ বাকিরা চেয়ারে-খাটে বসা। তাদের পীড়াপীড়িতে উঠে বসি। দ্রুত তৈরি হয়ে নেই। বেরিয়ে পড়ি সবার সঙ্গে।
নতুন স্কুলে চলেছি। রাস্তার দুই পাশে সোনালি ধানের ক্ষেত। ধানের পাতাও সোনালি হয়ে এসেছে। তখনো কুয়াশা শুকিয়ে যায়নি। তাই ধানপাতার ওপর লেপ্টে যাওয়া ডানা নিয়ে শুয়ে আছে ফড়িং। তারই পাশে ওড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে পাখা খসেপড়া ছোট্ট প্রজাপতি। আর অমনি উড়ে এসে ছোঁ মেরে ধরে যাচ্ছে বায়স ফিঙে এসে। আহা ফড়িং-প্রজাপতির জীবন। ডানা ভাঙা ফড়িং কিংবা পাখা খসেপড়া প্রজাপতির দিকে আমাদের নজর নেই। আমাদের যত আগ্রহ ধানে-ধানে, ঘাসে-ঘাসে উড়ে বেড়ানো ফড়িংগুলোর দিকে। যেই ঘাসের ওপর বসে, অমনি পেছন থেকে খপ করে ধরি। এরপর ফড়িংয়ের লেজে ছোট সরু ধানপাতা বেঁধে দেই ছেড়ে। ছেড়ে দেওযা ফড়িং যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়াল হয়, ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের এই এক অদ্ভুত মানসিকতা। অসুস্থ ফড়িং-প্রজাপতির জন্য মন কাঁদে অথচ সুস্থ-উড়ন্ত ফড়িং ধরে তাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাই। ভিষণ স্ববিরোধী স্বভাব। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে হয়তো ভাবি না। ভাবলেও তাৎক্ষণিক বলতে পারি না।
কিন্তু আজকের ঘটনা আমাকে কষ্টা দেয়। বেলালরা যখন ফড়িং ধরে ধানপাতা বেঁধে উড়িয়ে দেয়, হাততালি দেয়; তখন বলি, ‘কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?’ আনোয়ার-বেলাল বলে, ‘কোনটা? ফড়িং ধরে ওড়ানো? তুই যখন উড়াস, তখন ঠিক থাকে? আমরা ওড়ালে দরদ?’ শুনে ধনু কাকা বলে, ‘চুপ কর তোরা। ভাতিজা কদিন পঙ্গু হয়ে আছে তো। এখন কীটপতঙ্গের কষ্টও বোঝে। একটা কবি কবি ভাব এসে গেছে।’ তার কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
হাসি-বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পথ ফুরিয়ে আসে। এসে দাঁড়াই চরক্লার্ক জুনিয়র হাইস্কুলের মাঠে। তখন একটি মাত্র ভবন। চার তলা। রেডক্রিসেন্টের আশ্রয়ণকেন্দ্র। পূর্বমুখী ভবন। ভবনের সামনে বিশাল মাঠ। মাঠের উত্তর পাশে পূর্ব-পশ্চিমে লম্ব ভিটা। তার পেছনে পূর্ব-পশ্চিমে আরও লম্বা পুকুর। পুকুরে তখন হাঁটুপানি। বরফের মতো ঠাণ্ডা।
আমি হা করে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় ব্রজলাল স্যার হাতে বেত নিয়ে নামলেন। পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেন, ‘তোমরা চাইলে বল খেলতে পারো।’
স্কুলের মাঠে, ভবনের নিচে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী গিজগিজ করছে। বেশিরভাগই অচেনা। কারও সঙ্গে আমরা কথা বলি না। তারাও আমাদের সঙ্গে না। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠি। অফিস রুমের সামনে যেতেই দেখি সাকু কাকা। এসেছেন ধনু কাকাকে ভর্তি করাতে। ভাবলাম, ভালোই হলো। খোকন ও আমাকেও ভর্তি করিয়ে দেবেন। অফিস রুমে ঢুকেই দেখি, বিশাল টেবিলের পশ্চিম পাশে হেড স্যার সন্তোষচন্দ্র দাস। শান্তসৌম্য চেহারার নিপাট-গম্ভীর ভদ্রলোক। হালকা হাসি সমস্ত অবয়বে ছড়িয়ে রাখেন তিনি। টেবিলের দক্ষিণ পাশে ব্রজলাল দাস। সদহাস্যময়, প্রাণোচ্ছ্বল। হেড স্যার একে একে আমাদের নাম জিজ্ঞাসা করেন, ব্রজলাল স্যার খাতায় লিখে যান। ভর্তি ফিও ব্রজলাল স্যারকে দিতে হয়। সবাই পনেরো টাকা করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার পকেটে টাকা নেই। আছে কাকার লেখা চিঠি। চট্টগ্রাম যাওয়ার আগের দিন লিখে গেছেন। বলেছেন, যেন না খুলি, কাউকে না দেখাই। তাই এতদিন কাউকে দেখাইনি। তবে, শার্টের পকেটে রেখেছি।
ধনু কাকা, খোকন, খায়রুল বাসারের নাম লেখার পর এগিয়ে গেলাম। হেডস্যার বললেন, ‘কী নাম?’ আস্তে জবাব দেই, ‘মোহাম্মদ নূরুল হক।’ এরপরই হেডস্যারের দিকে চিঠিটি এগিয়ে দেই। ব্রজলাল স্যার চিঠি দেওয়ার সময় খেয়াল করেননি। তিনি আমার নাম লিখেই বললেন, ‘মানি কই?’ আমি কাচুমাচু করে বলি, ‘নাই স্যার।’ সঙ্গে সঙ্গে হেডস্যার বলেন, ‘বাবু, ওকে ভর্তি করে নিন। ও আমাদের কালাম সাহেবের ভাতিজা। ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, এসব ওর কাকা দেবেন। বাচ্চাদের সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে বেশি কথা বলবেন না।’ হেডস্যারের কথা শুনে ব্রজলাল স্যার হাসি দিয়ে বললেন, ‘ওকে স্যার।’
সবার ভর্তি কার্যক্রম শেষ হতে হতে বেলা তিনটা বেজে গেলো। আমরা মাঠে পায়চারী করছি। এমন সময় দেখা ইউসুফ ভুঁইয়ার সঙ্গে। তিনি তখন ক্লাস সেভেনে উঠেছেন। তার পেছন পেছন এলেন ছোলেমান চেয়ারম্যানের মেয়ে বিউটি। তার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। চৌরাস্তা বাজারে যেদিন জেনারেটর বন্ধ থাকতো, সেদিন আমরা দলবেঁধে চেয়ারম্যান বাড়িতে ম্যাকগাইভার দেখে যেতাম। মুখোমুখি হতেই সালাম দিলাম। তিনি বললেন, ‘কীরে ভর্তি হইছোস?’ বলি, ‘হ্যাঁ। আপনার বই কী করছেন? বাড়িতে যাওয়ার সময় নিয়া যামু। দিয়েন ক্যামন?’ তিনি বললেন, ‘টাকা কবে দিবি।’ বলি, ‘কাকা বাড়ি এলে।’ তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে চলে যান ওপরে। এভাবে ঘাড় বাঁকানোর মানে কী, কিছুই বুঝলাম না।
আমি হা করে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় ব্রজলাল স্যার হাতে বেত নিয়ে নামলেন। পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেন, ‘তোমরা চাইলে বল খেলতে পারো।’ স্যার চলে গেলে আবু ইউসুফ ভুঁইয়া বল নিয়ে এলেন। যারা পুরনো ছাত্র, তারাই খেলতে নেমে গেলেন। আমাদের কেউ পাত্তাই দিলেন না। আমরা মাঠের উত্তর পাশের ভিটির ওপর বসে খেলা দেখতে লাগলাম। ইতোমধ্যে আমাদের চারপাশে পরিচিত অপরিচিত অনেকেই এসে বসেছে। আগেই থেকে পরিচিত মোহাম্মদ ইলিয়াছ। সে এসেছে বাংলাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ওই স্কুলে আমার ক্লাসমেট ছিল। আরেকজন পরিচিত, সে খালাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন সোহেল। এই স্কুলে সবাই নবাগত। শুরু হলো, পরিচয় পর্ব। এই পর্বে মূলত নিজের ও প্রাইমারি স্কুলে নাম বলে, সঙ্গে জানিয়ে দেয় রোল নম্বর। কাছাকাছি যারা বসেছে, তাদের সবাই মোটামুটি নিজ নিজ স্কুলের সেরা ছাত্র ছিল। প্রথমজন নুর উদ্দিন। তার রোল এক ছিল। দ্বিতীয়জন মিজান, তারও এক। তৃতীয় জন ধনু কাকা, তারও এক। এভাবে একে একে সবাই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এবার আমার পালা। নিজের ও স্কুলের নাম বলে থেমে গেলাম। তবে, রোল বললাম না। কারণ উল্লেখ করার মতো আমার রোল নম্বর ছিল না। হঠাৎ পেছন থেকে একজন বলে উঠলো, ‘রোল কত ছিল?’ আমি ঘাড় বাঁকিয়ে বলি, ‘পাঁচ।’
কিন্তু আমরা যারা জটলা করে বসে আছি, তাদের অনেকের ভেতেই তখন করুণা নয়, দয়া নয়, জ্বলে উঠেছে প্রতিশোধের আগুন। সেই আগুনে বেলাল ভস্ম হওয়ার আগেই উত্তরের পথ ধরে।
আমার জবাব শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। প্রশ্নকর্তা এবার ভ্যাংচি কেটে বলে, ‘ওহ। তাই বলি, রোল নম্বর বলে না কেন? কারণ তো আছে। খুবই মেধাহীন। দুর্বল ছাত্র।’ আমি কোনো জবাব দেই না। মন খারাপ করে বসে থাকি। প্রথম স্কুলে এসেছি। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই অপরিচিত। কার স্বভাব কেমন, জানি না। রাগ করে কিছু বললে যদি এই ছেলেটিও সেলিমের মতো কাণ্ড করে বসে, যদি আছাড় দেয়, সেই ভয়ে কিছু বলি না। আমি অপমান হজম করলেও ধনু কাকা করে না। সে ক্ষেপে ওঠে। বলে, ‘ওই তোর নাম কীরে? কোন স্কুল থেকে আইছস? রোল কত ছিল?’ ছেলেটি সিনা টানটান করে দাঁড়ায়। শার্টের কলার ঠিক করে। এরপর বলে, ‘আমার নাম বেলাল উদ্দিন। এসেছি কেরামতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। রোল নম্বর এক।’
তার কথা শেষ হতে না হতেই ধনু কাকার পাল্টা প্রশ্ন, ‘ছাত্র-ছাত্রী কতজন ছিল?’ এবার বেলাল আর কোনো কথা বলে না। চুপ। আনোয়ার বলে, ‘কী হলো, কতজনের মধ্যে তোর রোল এক?’ বেলাল, এতটাই আস্তে জবাব দেয় যে, তার সবচেয়ে কাছে বসা আমিও শুনি না। ধনু কাকা এবার ধমক দেয়, ‘কী, কতজনের মধ্য এক তুই? কইতে শরম লাগে?’ এবার বেলাল একটু কেশে নিয়ে বলে, ‘একজন।’ তার উত্তরে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কিন্তু আমি হাসি না। তখনো চুপ। ইলিয়াছ বলে, ‘কী রে তোর মন খারা ক্যান?’ বলি, ‘কিছু না। ভাল্লাগছে না।’ এদিকে সবার অট্টহাসিতে বেলাল যেন কেঁদে ফেলবে। আর সেই কান্নার কয়লায় ঘি ঢেলে দিলো খোকন। বলে, ‘আরে তুই তো পাস না করলেও রোল এক হতো। অনেক বড় মেধাবী রে তুই!’ বেলালের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। চোখে চোখ পড়তেই, সে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, খোদাতায়ালার দুনিয়ায় যত অপমানের ভাগাড় আছে, সব এনে আজ তার সামনে কেউ উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে। আর সেই ভাগাড়ের দুর্গন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই সে আর দাঁড়ায় না। হন হন করে হাঁটা দেয় পূর্বদিকে। যেদিকে মাঠের পাশঘেঁষেই ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। সে রাস্তায় ওঠে। আর একবার আমাদের দিকে তাকায়। তার তাকানোতে কেমন যেন করুণাপ্রার্থনা ছিল। কিন্তু আমরা যারা জটলা করে বসে আছি, তাদের অনেকের ভেতেই তখন করুণা নয়, দয়া নয়, জ্বলে উঠেছে প্রতিশোধের আগুন। সেই আগুনে বেলাল ভস্ম হওয়ার আগেই উত্তরের পথ ধরে।
বেলালের গমনপথের দিকে চেয়ে আরও একবার হেসে ওঠে আমাদের দল। এতকিছুর পরও আমি নিজের অপমানের কথা ভুলতে পারি না। আমি মেধাবী নই, তাই রোল পাঁচ। মেধাবী হলে রোল এক হতো। আর যাদের রোল এক থেকে তিনের মধ্যে থাকে, তারাই কেবল মেধাবী। তারাই সব জানে। বাকিদের প্রতিভা নেই। পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠদের সবার রোল কি এক দুই তিন ছিল? কী জানি, হবেও বা। কিন্তু আমার রোল তো কোনো দিন এক দুই তিন হলো না। আর হবেও না। আমি তো তেমন পড়াশোনাও করি না। ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরি। দেখাদেখি অন্যরাও উঠে দাঁড়ায়। যারা একসঙ্গে স্কুলে এসেছিলাম, তারা একসঙ্গেই ফেরার পথ ধরি। চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে বলি, ‘তোরা দাঁড়া। বিউটি ফুপুর কাছ থেকে বই নিয়ে আসি।’ সবাইকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে এক দৌড়ে ঢুকে গেলাম চেয়ারম্যান বাড়ি। দেখি সামনের রুমেই বসে আছেন বিউটি। বইগুলো সোনালী কোম্পানির পলিথিনে ভরে রেখেছ দিয়েছেন রিডিং টেবিলে। আমি বইয়ের দিকে হাত বাড়াতেই বললেন, ‘আরে ভাত খেয়ে যা।’ বলি, ‘না ফুপু, ধনু কাকারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আরেকদিন খাবো।’
জামা-কাপড়ের ধুলাবালি ঝেড়ে বাড়ির পথ ধরি। আর ডানে-বামের বাড়ি-ঘরগুলোয় জ্বলে ওঠে কেরোসিনের চেরাগ। তারই আলোয় দেখা যায় ছোট বাচ্চারা উঠোনে ছুটে বেড়াচ্ছে, মায়েরা তাদের ধরার জন্য ছুটছেন। ঠিক ওই মুহূর্তেই ধারে-কাছের মসজিদ থেকে ভেসে আসতে থাকে মাগরিবের আজান।
বই নিয়ে রাস্তায় আসতেই খোকন বলে দেখি, ‘ছেঁড়াটেঁড়া কি না।’ পলিথিন থেকে বের করে বইগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে বলে,‘না রে, নতুন বইয়ের মতো। তুই জিতি গেছস।’ আমি কিছু না বলে বইগুলো গোছাতে থাকি। কিছুদূর হাঁটার পর তিন রাস্তার মাথা। এক রাস্তা গেছে পশ্চিম দিকে। ওই রাস্তা ধরে সামনে গিয়ে ডানে মোড় নিলে আমাদের বাড়ির পথ। আরেকটি রাস্তা গেছে পূর্বদিকে। সেই রাস্তা ধরে গেলে নুর উদ্দিনদের বাড়ির পথ। আর তিন রাস্তা থেকে উত্তর দিকে নামলে রাস্তা নয়, চওড়া আল। ওই আল ধরে সোজা হেঁটে গেলে চৌরাস্তা বাজার টু চর আলাউদ্দিনের রাস্তা। তার আগেই আলের পূর্বপাশে পড়ে নাজমাদের বাড়ি। তাদের বাড়ির সামনে বিশাল এক বটগাছ। নিচের শেকড়-বাকড় এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, মাটির দেখা মেলে না। আমরা সেই বটগাছের নিচে এসে দাঁড়াই। নাজমা চলে যায় বাড়ির ভেতর। বাকিরা বসে পড়ি শেকড়-বাকড়ের ওপর।
শুরু হয় গল্প। গল্পের বিষয় আর কিছু না। সেই পুরনো কিচ্ছা। এই বট গাছে পূর্ণিমা-অমাবস্যা রাতে জিন আসে। কেউ নিচ দিয়ে হেঁটে গেলে তার ঘাড় মটকে দেয়। এসব গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলে ধনু কাকা। সঙ্গে তাদের বাড়ির এক সূর্য আলী জিনের প্রসঙ্গও টানে। সে জিন-ভূতের গল্প এমনভাবে পরিবেশন করে, শুনতে শুনতে গা শিউরে ওঠে। পুরোটা বানানো গল্প জেনেও ভৌতিক নাটক দেখে লোকের যেমন অনুভূতি হয়, আমাদেরও তেমনি গা ছম ছম করে।
গল্প জমে উঠেছে। এদিকে, রাখালেরা গরু নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছে। কোনো কোনো রাখাল গরুর লেজে একটা মোচড় দিয়ে বলে, ‘আরে হইট হইট, যা-যা।’ অমনি গরু দৌড় দেয়, পেছন পেছন সেও দৌড়ায়। এই রাখাল ও গরুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্যও বড় বড় গাছের আড়ালে নেমে গেছে কখন, আমরা টেরই পাইনি। চারদিকে কখন নেমে এসেছে কুয়াশাভেজা গোধূলি বেলা। হিম হিম ঠাণ্ডায় আর বসতে ভালো লাগছে না। একজন উঠতেই বাকিরাও দাঁড়াই। জামা-কাপড়ের ধুলাবালি ঝেড়ে বাড়ির পথ ধরি। আর ডানে-বামের বাড়ি-ঘরগুলোয় জ্বলে ওঠে কেরোসিনের চেরাগ। তারই আলোয় দেখা যায় ছোট বাচ্চারা উঠোনে ছুটে বেড়াচ্ছে, মায়েরা তাদের ধরার জন্য ছুটছেন। ঠিক ওই মুহূর্তেই ধারে-কাছের মসজিদ থেকে ভেসে আসতে থাকে মাগরিবের আজান।
চলবে
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-২৪॥ মোহাম্মদ নূরুল হক