[পর্ব-২২: প্রাইমারি স্কুল পর্ব]
সেলিমের নাক ফাটিয়ে দেওয়ার পর অনেকদিন আর বাজারে উঠি না। ভয়ে। লজ্জায়। স্কুলে যাই আলপথ দিয়ে। আলপথ ঘুরতে ঘুরতে মৌলবি মফিজ উল্লাহর বাড়ি ও আজাদদের বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তায় উঠি। এই পথে আসতে-যেতে আশরাফ মামার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকি। আশরাফ মামা হলেন মৌলবি মফিজ উল্লাহর ভাতিজা। তিনি মাদ্রাসায় পড়েন। সম্ভবত সিক্স বা সেভেনে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখা। জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তার বেডরুমের একপাশে রিডিং টেবিল। টেবিলে ক্লাস সিক্স থেকে নাইন-টেন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসের বাংলা ব্যাকরণে ঠাসা। বলি, ‘এত ব্যাকরণের কাজ কী?’ মামা জানালেন, এসব ব্যাকরণ তার নয়। তার বড় ভাইদের। অন্যান্য বই বছর বছর বিক্রি হয়ে গেলেও ব্যাকরণ বই কেউ নেয় না। কারণ বোর্ড থেকে বছর বছর নাকি ব্যাকরণ বই পরিবর্তন করা হয়। একেকবার একেক লেখকের ব্যাকরণ বই পাঠ্য করা হয়। এখানে বলে রাখি—তখণ ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পুরনো বইই কিনতো বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী। নতুন বইয়ের দুই তৃতীয়াংশ দামে।
আশরাফ মামার টেবিলে যত ব্যাকরণ পেলাম, তার বেশিরভাগই বানান ভুলে ভরা। একটি মাত্র ব্যাকরণ ছিল ভিন্ন রকমের। সেটি হরলাল রায়ের লেখা। মামাকে বলি, ব্যাকরণে যদি এত বানান ভুল থাকে, শুদ্ধ শিখবো কিভাবে? মামা উত্তর দেন না। কেবল হাসেন। তার সঙ্গে আমার একধরনের সখ্য হলেও তিনি মিতভাষী হওয়া আলাপ হয় কম, কিন্তু দীর্ঘসময় আড্ডা দেয়, প্রায় কথা না বলেই। তো সেদিন একই প্রশ্ন বারবার করায় তিনি বোধ হয় কিছুটা বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘এত পণ্ডিতির দরকার আছেনি? তোর কোনটা লাগবো, নিয়া যা।’ তখন ব্যাকরণ সংগ্রহ করা আমার প্রায় নেশায় পরিণত হয়েছিল। মামার কথায় যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। বলি, ‘হরলাল রায় নেবো।’
খোকন খেকিয়ে ওঠে, ‘তোর মাথা খারাপ? দুদিন বাদে পরীক্ষা। পড়মু না? চল পড়তে বসি।’ তার ধমক খেয়ে আর বের হই না। শুয়ে থাকি তার পাশে। সে জোরে জোরে পড়ছে, আমি শুনে শুনে মুখস্ত করছি।
কাছারিতে ফিরে ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায় থেকে পড়া শুরু। পরীক্ষার বাকি আর মাত্র কদিন। পাঠ্যবই বাদ দিয়ে পড়ছি অষ্টম শ্রেণীর ব্যাকরণ। কী কাজে লাগবে? বড়রা প্রায় বলেন, ব্যাকরণ নাকি নিরস বিষয়। কিন্তু আমার পড়তে বেশ লাগছে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই—হরলাল রায় পড়েই যাচ্ছি। আমি যেন পুরোদস্তুর ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক। এখন ছাত্র তো একজন লাগবেই। ছাত্রও প্রস্তুত। বেশি দূর খুঁজতে হয়নি। রাসেলকে যখন যা বলি, সে তাই শোনে। সুতরাং আমি ব্যাকরণ-ভাষাতত্ত্বের স্বঘোষিত শিক্ষক। রাসেল একমাত্র ছাত্র। মাঝেমাঝে বেলাল আসে। তার সঙ্গেও ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা জমাতে চাই। কিন্তু সে আগ্রহ দেখায় না। তার রাজ্যের আগ্রহ তখন আউট বই সংগ্রহ করে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার। খোকনের সঙ্গে ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করার সাহস পাই না। বলতে গেলেই সে ধমক দেবে। তাই তাকে ঘাটাই না। বরং সে যখন জোরে জোরে ক্লাসের বা পরীক্ষার জন্য পড়ে, তখন চোখ বন্ধ করে শুনি—শতভাগ মনোযোগ দিয়ে।
এখানে বলে রাখি, আমার স্মরণশক্তি এতটাই ছিল যে, একবার শুনলে অনেকদিন তা হুবহু মনে রাখতে পারতাম। সুতরাং খোকন যা পড়ে, আমার তা মুখস্ত হতে থাকে। একদিন খোকনদের বাড়িতে গেছি। চাঁদনি রাত। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এসেছে। বলি, ‘চল একটু রাস্তা থেকে হেঁটে আসি।’ খোকন খেকিয়ে ওঠে, ‘তোর মাথা খারাপ? দুদিন বাদে পরীক্ষা। পড়মু না? চল পড়তে বসি।’ তার ধমক খেয়ে আর বের হই না। শুয়ে থাকি তার পাশে। সে জোরে জোরে পড়ছে, আমি শুনে শুনে মুখস্ত করছি।
আমাকে চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখে খোকন বলেন, ‘কী রে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ঘুম? কাল কিন্তু ক্লাসে পড়া না পারলে একটা বেতও মাটিতে পড়বো না। তোর যে কী অইবো, আল্লাহই জানে।’ খোকনের হুমকিতে আমি একটুও বিচলিত হই না। বলি, ‘তোর পড়া তুই পড়। ক্লাসেরটা ক্লাসে দেখা যাবে?’ এবার সে বলে, ‘বাড়ির কাজ, হাতের লেখা? সেগুলোর কী হবে?’ বলি, ‘সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে বাড়ির কাজ করবো। তুই এত টেনশন করিস না তো!’
আমি থত্থর করে কাঁপি। আমার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। আমি পড়া শেষ না করেই দাঁড়িয়ে থাকি। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুই কথা বলেছিস?’ বলি, ‘না স্যার। আমি তো রিডিং পড়ছিলাম।’ এবার যেন স্যারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়—‘তাহলে কে কথা বললো? সবাইকে গণহারে বেত চালাবো কিন্তু।’
পরদিন যথারীতি স্কুলে হাজির। অন্যদিন ছাত্রদের সারির সামনের বেঞ্চের একপাশে বসি। হয়তো সর্বডানে, না হয় সর্ববামে। যেন স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে বের হতে পারি। কিন্তু আজ বসলাম, মাঝখানে। আমার ডানপাশে খোকন, ধনু কাকা। বামপাশে খাইরুল বাসার, সাইফুল। এরা চারজনই তুমুল মেধাবী। রীতিমতো প্রতিযোগী। রোলনম্বর এক থেকে পাঁচের মধ্যে সবাই। এক থেকে পাঁচের মধ্যে এই চার জনের বাইরে আরও একজন আছে। সে মাহমুদা খানম আলেয়া।
তো এই চার জনের ঠিক মাঝখানে বসায় সবার কৌতূহলী চোখ আমার দিকে। কী ব্যাপার? যে প্রতিদিন কিনারে বসার জন্য মারামারি পর্যন্ত করে, আজ কেন মাঝখানে? কিন্তু কেউ সেই প্রশ্ন প্রকাশ্যে করে না। কেবল একবার আলেয়া এসে বলে, ‘কী ব্যাপার আপনার? আজ দেখি মাঝখানে? সাইডে বুঝি জায়গা পান নাই?’ বলি, ‘আপনি করে বলছিস ক্যান? টিটকারির আর জায়গা পাস না? ফাজিল। যাহ! ভা-গ।’ আমার ধমকে আলেয়া গিয়ে নিজের সিটে বসে।
ঘণ্টা পড়তেই হেড স্যার এসে হাজির। ইংরেজির ক্লাস। প্রথমে ধনু কাকাকে বাংলা অর্থসহ ‘রিডিং’ পড়তে বললেন। ধনু কাকার পড়া শুরু, আমার কান খাড়া। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছি। তার শেষ হলে খোকন। যথারীতি খোকনও বাংলা অর্থসহ ‘ইংরেজি রিডিং’ পড়ে গেলো। এবার আমার পালা। স্যার আমাকে পড়তে বলেই চোখ বন্ধ করলেন। প্রত্যেকের বেলায়ই তাই করেন। কেউ ভুল পড়লেও শাস্তি দেন না, আবার ভালো পড়লেও প্রশংসা-টশংসা কিছু করে না। স্যারের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই আমি গড়গড় করে পূর্ববর্তী দুজনের চেয়ে দ্রুত পড়তে শুরু করলাম। খোকন বিস্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। তার যেন বিশ্বাসই হতে চায় না, যে আমি সারারাত একটি বর্ণও পড়িনি, বইয়ের পাতাও ওলটাইনি, সে আমি কিভাবে এত দ্রুত পড়তে পারি। তাও বাংলা অর্থসহ! তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। সে ধনু কাকাকে ফিস ফিস করে সব বলে দেয়। ধনু কাকাও বিস্মিত। বলে, ‘বলিস কী? কিভাবে সম্ভব? হেতার লগে কোনো জিন-টিন আছেনি? হেতে না তোগোরে একদিন ভূত সাজি ভয় দেখায়ছিল? মনে হয়, হেতার লগে জিন-ভূত কিছু একটা আছে!’
তাদের ফিসফিসানিতে স্যারের ধ্যানচ্যুতি ঘটে। টেবিলের ওপর ডাস্টার দিয়ে জোরে আঘাত করে বলেন, ‘কী হইছে তোদের? কী সমস্যা? কিসের এত ফিসফিসানি?’ পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। স্যার আবারও হুঙ্কার ছাড়েন—‘কে কথা বলেছে? স্বীকার কর। নাহলে কিন্তু একটা বেতও মাটিতে পড়বে না।’ তবু কেউ স্বীকার করে না। স্যার এবার ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তোরা কথা বলেছিস?’ তারা মাথা দোলায়—‘না’। স্যার এবার দ্বিগুণ গর্জনে বলেন, ‘তাহলে কে কথা বললো?’ ভয়ে আমি থত্থর করে কাঁপি। আমার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। আমি পড়া শেষ না করেই দাঁড়িয়ে থাকি। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুই কথা বলেছিস?’ বলি, ‘না স্যার। আমি তো রিডিং পড়ছিলাম।’ এবার যেন স্যারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়—‘তাহলে কে কথা বললো? সবাইকে গণহারে বেত চালাবো কিন্তু।’
দেখি—তার চোখে প্রতিশোধের আগুন। সে আমার করুণ পরিণতি দেখে ভ্যাংচি কাটে। বলে, ‘কী, কেমন মজা? আর করবা পণ্ডিতি?’ রাগে-দুঃখে আমার কান্না আসে। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল।
এবার আলেয়া বলে, ‘স্যার ধনু আর খোকন কথা বলেছে।’ এবার আর যায় কই দুই জন? স্যারের জেরার মুখে পড়ে গড়গড় করে সব বলে দেয়। সব শুনে স্যার বলেন, ‘গুড। এটা তো ভালো গুণ। সে যদি কারও পড়া শুনে শুনে মুখস্ত করতে পারে, তাহলে তো দোষের কিছু দেখি না। তোরা দুজন পণ্ডিতি না করে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাক।’
ততক্ষণে আমার রিডিং পড়া শেষ। এরপর খাইরুল বাশার, সাইফুলের পালা। তাদের পড়া শেষ হলে পেছনে ছানাউল্লাহ কচি। কিন্তু আমি এ কী শুনছি? কচি তো কিছুই পড়ছে না। কেবল গুনগুন করে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে একটি-দুটি শব্দ জোরে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করছে। স্যার যেভাবে চোখ বন্ধ করে মাথা দুলিয়ে যাচ্ছেন, সেভাবেই চলেছেন। কিছুই বলছেন না। বিষয়টি আমার ভালো লাগলো না। তাই উঠে দাঁড়ালাম। বলি, ‘স্যার, কচি কিন্তু পড়তেছে না।’ কোনো সাড়া নেই। আবারও বলি। স্যারের চোখ বন্ধ। এদিকে সাইফুল আর খায়রুল বাশার আমাকে বারবার বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে—‘এই তুই বসে পড়। বেশি কথা বলিস না। স্যার কিন্তু চোখ খুললে তোর খবর আছে।’
এবার সত্যি স্যার চোখ খুললেন। বললেন, ‘কে কথা কয়? কথা কইতে নিষেধ করেছি না?’ আবারও সবাই কেমন চুপসে গেছে। কেউ কিছু বলে না। আমি বীরের মতো বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেভাবেই বলি, ‘স্যার আমি বলছি।’ স্যার চোখ বড় বড় করে টেবিলের ওপর থেকে বেতটা হাতে নিলেন। আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘দাঁড়া।’ আমি তো দাঁড়িয়েই ছিলাম। স্যার এবার হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ‘কী হলো, তোকে দাঁড়াতে বললাম না? দাঁড়া।’ কাঁপতে কাঁপতে বলি, ‘স্যার আমি তো দাঁড়িয়ে আছি।’ স্যারের চোখে অবিশ্বাস। তিনি ঘাড় কাৎ করে বেঞ্চের নিচের দিকে তাকালেন। দেখলেন দাঁড়িয়ে আছি কি না। এবার বললেন, ‘বেরিয়ে আয়। গেলাম তার সামনে। হেড স্যার বললেন, তোকে বসলে বড় দেখায়, দাঁড়ালে ছোট লাগে। আমি বুঝতে পারি না, তুই বসে আছিস, না দাঁড়িয়ে। আচ্ছা বাদ দে। এবার বল, ‘কী বলছিলি?’ কচির গুনগুন করে যাওয়ার কথা সবিস্তারে বলি। শুনে তিনি তেলেবেগুনে চটে গেলেন—‘‘তাতে তোর কী সমস্যা? সে যদি ‘এম’ বলে, তাহলে ‘ম্যান’ বা ‘ম্যাংগো’ বলেছে। সে যদি ‘সি’ বলে, তাহলে ‘ক্যাট’ বলেছে। অয়েল ইউর ওন মেশিন। বুঝছিস? একটু আগে প্রশংসা করেছিলাম বলে, মনে করিস না, মাথাটা কিনে নিছস। যত্তসব। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক দশ মিনিট।’’
স্যারের কথা শুনে আমি তো হতভম্ব। আমার দোষটা কী, তা-ই বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দুই হাতে দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। কারও দিকে তাকানোর সাহস পাই না। শুধু একবার কচির দিকে তাকাই। দেখি—তার চোখে প্রতিশোধের আগুন। সে আমার করুণ পরিণতি দেখে ভ্যাংচি কাটে। বলে, ‘কী, কেমন মজা? আর করবা পণ্ডিতি?’ রাগে-দুঃখে আমার কান্না আসে। দুচোখ ফেটে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে জল। সে জল নাক বেয়ে জিহ্বা স্পর্শ করে।সেদিন প্রথম টের পাই—চোখের জল নোনা।
চলবে..
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-২১॥ মোহাম্মদ নূরুল হক