[পর্ব-২০: প্রাইমারি স্কুল পর্ব]
একদিকে ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’, অন্যদিকে সুচিত্রা সেনের ‘বাচনভঙ্গি’র রহস্য—এই দুই কারণ আমাকে আমূল বদলে দিতে থাকে। প্রথমটিতে আমি এতই মোহগ্রস্ত যে, প্রতিদিন কবিতা লিখে খাতার পর খাতা ভরিয়ে তুলছি। বেশ কদিন লেখার পর মনে হয়, কিচ্ছু হয়নি। তখন রাসেলকে ডাকি। বলি, সব খাতা নিয়ে আয়। সে নিয়ে আসে। এর পুকুর পাড়ে নিয়ে যাই। খাতাগুলোর ওপর হারিকেন থেকে কেরোসিন ঢালি। এরপর ম্যাচের এক কাঠির ঘষাতেই ভবলীলা সাঙ্গ। ছাইগুলো পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেই। ভাসতে ভাসতে একসময় ডুবে যায়। আমারও সব ব্যর্থতার প্রমাণ মুছে যায়। রাসেল খুব কষ্ট পায়। বলে, এত কষ্ট করে লেখেন, আবার এমন করে পোড়ান ক্যান?’ বলি, ‘আরে বোকা, যা গেছে, আবর্জনা গেছে। নতুন করে লিখবো।’
আবার শুরু করি। গণিতের খাতা, বাংলা হাতের লেখার খাতা, সব ভরে উঠে আমার লেখায়। একদিন মনে পড়ে ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’তে আল মাহমুদ বলেছেন, স্বরবৃত্তের প্রতিটি চরণ চার পর্বে গঠিত হয়। আর প্রথম তিন পর্বে চার মাত্রা থাকে। শেষ পর্ব থাকে অপূর্ণ। কিন্তু আমি তো এসব বুঝি না। এই হিসাব ছাড়া লিখবো কী করে, তাও তো জানি না। আল মাহমুদও সেই বর্ণনা দেননি। তবে, পাঠ্যবইয়ের পদ্য-ছড়াগুলোর একেক চরণে যত অক্ষর-বর্ণ আছে, আমিও একেকটা ছড়ায় তত অক্ষর-বর্ণ রেখে লিখে যেতে থাকি। আর অপেক্ষা করি, কোনো একদিন হয়তো মাহফুজউল্লাহর মতো কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সেই ভরসায় দিনের পর দিন লিখে যাই। তবু খাতার পর খাতা লিখে যাই। তবে রাসেল ছাড়া কাউকে দেখাই না। কিন্তু মুশকিলটা হয় অন্য জায়গায়। পাঠ্যবইয়ের পদ্য-ছড়াগুলো যেরকম সাবলিলভাবে পড়তে পারি, আমার লেখা সেভাবে পারি না। কোথায় যেন হোঁচট খাই।
আবার তোতলামি দূর করার প্র্যাকটিসও কেবল রাসেলের সঙ্গেই করি। এই গোপন খবর সে যেন ফাঁস না করে, সে বিষয়েও হুঁশিয়ার করে দেই। সেও আমার কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে। রাসেলের সঙ্গে কথা বলি আস্তে আস্তে, বাকিদের সঙ্গে আগের মতোই দ্রুত কথা বলি। আর দ্রুত বলতে গিয়েই তোতলামিটা থেকে যায়। ফলে কেউ আর আমার গোপন সাধনার বিষয় ধরতে পারে না।
স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রায় গরু নিয়ে মাঠে বের হতাম। আর রাসেল ও ইসমাইল বের হতো জাঙ্গি (নাইলনের মতো শক্ত তালের আঁশ দিয়ে তৈরি, বক ধরার একধরনের ফাঁদ) নিয়ে বের হতো। কেউ দুটি, কেউ তিনটি বক ধরে নিয়ে আসতো। দুই বাড়িতে প্রতিদিনই বকের মাংস রান্না হতো। আমাদের যদি কোনো দিন রান্না না হতো, সমস্যা নেই। রাসেলদের তো হতোই। আমার জন্য এক বাটি মাংস বরাদ্দ থাকতোই। রাসেলরা তখন ৪ বোন এক ভাই। রাসেল সবার ছোট। বড় বোনের বিয়ে থা হয়েছে। থাকেন শ্বশুর বাড়ি। বাকিরা বাড়িতে। তাদের ও আমাদের বাড়ি পাশাপাশি। নিবিড়। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব কেবল পুকুর পাড়। তাদের বোনদের মধ্যে মেজ বোন, মানে হাজেরা আপা আমাকে রাসেলের চেয়ে বেশি স্নেহ করেন। বাড়িতে ব্যতিক্রম কিছু রান্না হলেই শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে এক বাটি আমার জন্য নিয়ে আসবেনই।
উপস্থিত জনতা উত্তেজিত। তারা এসব মায়াকান্না শুনতে চান না। ‘কালাম নেতার ভাতিজা’র গায়ে হাত তোলার উপযুক্ত শাস্তি তারা দেবেনই। শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন। কেউ তেড়ে আসেন বাসন্তির মায়ের দিকে, কেউ ছুটে যেতে চান ঘরের দিকে। বাসন্তিকে ধরে এনে মারতে চান কেউ কেউ।
তখনো আমাদের বাড়িতে সন্দ্বীপ থেকে আসা ওই পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। তাদের পরিবারে তিন চার বোন, এক ভাই। আর বৃদ্ধ মা। বোনদের মধ্যে একজন আমার বয়সী। ডাক নাম বাসন্তি। ভাইয়ের নাম জামাল। বাকিদের নাম এখন মনে নেই। তো আমাদের ঘর ছিল পূর্ব ভিটায়। তাদের ঘর পশ্চিম ভিটায়। বাসন্তিদের ঘরের পাশে নারিকেল গাছ, গড়ই গাছ। কড়ই গাছের ডাল চালের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি, বাসন্তী কড়ই গাছের ডালপালা সব কেটে সাফ করে ফেলছে। বলি, ‘কী রে গাছ কাটোছ ক্যান?’ সে বলে, ‘কাটলে তোর কী?’ আমি আর কিছু বলি না। কেটে রাখা ডালগুলো নিয়ে আমাদের ভিটির দিকে যেই হাঁটা দিয়েছি, অমনি বাসন্তি হাতের দা আমার দিকে ছুড়ে মারে। এসে পড়ে হাঁটুর ওপর। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। কাউকে কিচ্ছু বলি না।
বিষয়টি গুরুতর। এমনি তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। দিলাম দৌড় বাজারের দিকে। আমাকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দেখে খায়ের কাকা, খুরশিদ কাকা বলেন, ‘কী হইছে?’ ঘটনা খুলে বলি। আর যায় কই? খায়ের কাকা, দুপদাপ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করেন। খুরশিদ কাকা এক হাঁক ছাড়ে—‘ওরে তোরা কে কই আছোস? লাঠিসোটা নিয়ে আয়। আঙ্গো পোলার গায়ে হাত তুলছে। এত্ত বড় সাহস!’ মুহূর্তে চল্লিশ-পঞ্চাশজন মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। সবার আগে খায়ের কাকা। পেছন পেছন খুরশিদ কাকাসহ তার আজ্ঞাবহ লাঠিয়াল বাহিনী। বাড়িতে ঢুকেই আমি উঠোনের মাঝখানে দাঁড়ালাম। উপস্থিত জনতার সামনে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করি। সব শুনে তারা বাসন্তিদের ঘরের দিকে প্রায় ঝড়ের বেগে যেতে উদ্যোত হন। খুরশিদ কাকা হুঙ্কার ছাড়েন, ‘থামেন সবাই। আগে জিগ্যাই।’ এরপরই বাসন্তির নাম ধরে ডাকেন, ‘ওই বাসন্তি বাইরে আয়। তোর মাকেও আয়তে ক।’ খুরশিদ কাকার ডাকে বাসন্তি কেন, আমি নিজেও থত্থর করে কেঁপে উঠি। তবে, বাসন্তি ঘর থেকে বের হয় না। লম্বা ঘোমটা টেনে তার মা বেরিয়ে আসেন। ভীরু ভীরু পায়ে। সবার সামনে দিয়ে এগিয়ে আসেন। আসতে আসতে থেমে যান। হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে—‘তুই আমার পোলার মতো। বাসন্তি যদি কোনো অন্যায় করে তুই আমারে বলতি। শালিস ডাকার তো কোনো দরকার ছিল না বাবা। অন্যায় হয়ে গেছে। মাফ চাই।’ তার কান্নায় আমিও কাঁদি। কিছু বলতে পারি না। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও হতভম্ব। এত বড় ঘটনা ঘটে যাবে, দুই ঘরের কেউই আঁচ করতে পারেননি।
উপস্থিত জনতা উত্তেজিত। তারা এসব মায়াকান্না শুনতে চান না। ‘কালাম নেতার ভাতিজা’র গায়ে হাত তোলার উপযুক্ত শাস্তি তারা দেবেনই। শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন। কেউ তেড়ে আসেন বাসন্তির মায়ের দিকে, কেউ ছুটে যেতে চান ঘরের দিকে। বাসন্তিকে ধরে এনে মারতে চান কেউ কেউ। কেউ বলেন, ‘জামাইল্যা কই?’ বাসন্তির মা বলেন, ‘দোকানে।’ আমি কী করবো, বুঝতে না পেরে খুরশিদ কাকার বাম হাত চেপে ধরি। কাঁদতে কাঁদতে বলি, ‘কাকা, সবাইরে থামতে কন। খালা তো মাফ চাইছেন।’
আমার কান্নাকাটিতে খুরশিদ কাকা গলে গেলেন। যে প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বাজার থেকে তেড়ে এসেছিলেন, তার দ্বিগুণ দরদ দেখিয়ে চলে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন উত্তেজিত জনতাকেও।
সবাই চলে গেলে বাসন্তির মা ঢুকলেন ঘরে। বাসন্তিকে টেনে-হিঁচড়ে উঠোনে আনলেন। বললেন, ‘ওই বেয়াদ্দপের ঘরের বেয়াদ্দপ, অনই তুই এই পোলার কাছে মাফ চাইবি। ধর, পোলার পা ধরি মাফ চা।’ বাসন্তি কিছুতেই পা ধরবে না। তার মা-ও নাছোড় বান্দা। দুজনেই প্রচণ্ড জেদি। শেষমেষ এগিয়ে এলেন আমার মা। বললেন, ‘আরে আপা, আম্নে এসব কী কন? এত্তটুকুর পোলার পা ধরি মাফ চাইতে অইবো ক্যান? যান। মাফ করি দিছি। এই বাসন্তি তুই আঙ্গো ঘরে আয় তো।’ বাসন্তি যেন হাতে ঈদের চাঁদ পেলো। আমার মাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না তার—যেন অপরাধটা আমারই বেশি!
বঙ্কিম বাবুর পেছনে আমার মা। বঙ্কিম বাবু ছাড়া সবার চোখে জল। এতক্ষণ যিনি দরদমাখানো সুরে ডাকছিলেন, তিনি হাজেরা আপা। এখনো ডেকেই চলেছেন। কিন্তু চোখ খুলতেই তার জেরা শুরু—‘তোরে কে কইছে এই সাঁইঝের বেলায় গাছে উঠতে?’
আমিও ভাবনায় পড়ে গেলাম। আসলে কী করতে গিয়ে কী হয়ে গেলো! সত্যিই তো, আসলে বাসন্তির দোষটা কী? আমিই বা কেন গাছের ডাল কাটতে মানা করলাম? সে আমাকে দা মেরেছে, তো কী হয়েছে? না হয় একটু ব্যথাই পেয়েছি, তা নিয়ে তো মা বা খালাকে বলতেই পারতাম। তাদের কাউকে না বলে বাজারের দিকে দৌড় দিলাম কেন?—এসব প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। বাসন্তি যখন মায়ের সঙ্গে আমাদের ঘরে ঢুকলো, আমি তখন কাছারির দিকে পা বাড়ালাম।
তখন আমার একট বদভ্যাস ছিল। আসরের আজান পড়লে বাবা-কাকা দুজনই বাজারের দিকে চলে যেতেন। এই সুযোগে একেকদিন একেক নারিকেল গাছে উঠতাম। আর ডাব পেড়ে পানি ও নরম নারকেল খেয়ে খোল ফেলে দিতাম বাড়ির পাশের নালায়। তো, এই ঘটনার দিন বাবা-কাকা কেউ বাড়ি নেই। কাকা তো আগে থেকেই চট্টগ্রাম। বাবা গেছেন ফেনী। বাড়িতে তখন কেবল আমারই রাজত্ব।
সন্ধ্যা হয়-হয়। হঠাৎ মনে হলো—এত ঝামেলার ভেতর আজ তো ডাব খাওয়া হলো না! এটা হতেই পারে না। ডাব খেতেই হবে। উঠোনের উত্তর পাশে তখন ঘন সুপারি বাগান। সেই বাগানে মাঝে-মাঝে মান্দার (পলাশ) গাছের চারা। সুপারি বাগানে নাকি বান্দার গাছ থাকা ভালো। গাছের পাতা পচে নাকি সুপারির গাছের জন্য সার হয়। পুষ্টি জোগায়। আর আছে দশ গজ দূরে দূরে বিশাল বিশাল নারিকেল গাছ। দেখে-শুনে একটি গাছ ঠিক করলাম। এটি সোজা ঘরের উত্তর পাশে। উঠোন কিংবা পুকুর ঘাট—কোনোদিক থেকেই এই গাছটি দেখা যায় না। ফলে নির্বিঘ্নে ডাব নিয়ে নেমে আসতো পারবো।
পায়ে রশি লাগিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকি। আর চারদিকে তাকাই—কেউ যেন দেখে না পেলে। এই সময়টায় হাজেরা আপা এই পথ ধরে আমাদের বাড়ি একবার আসেন। মায়ের সঙ্গে অনেক্ষণ গল্প করে চলে যান। আর বাড়িতে বাবা না থাকলে রাতে মায়ের সঙ্গেই থাকেন। আজও তার আসার সময় হয়েছে। আমিও গাছে উঠছি। বিকেলের ঘটনাগুলো বারবার মনে পড়ছে। ধুর কী করলাম? একই বাড়িতে থাকি। লজ্জায় চোখ দেখাবো কী করে বাসন্তিকে? মনের মধ্যে এও ঘুরপাক খায়—আচ্ছা বাসন্তি যদি দেখে ফেলে, তখন সে তো সবাইকে বলে দেবে! আবার হাজেরা আপাও যদি দেখে ফেলেন, এই সন্ধ্যার সময় গাছে উঠতে দেখে নির্ঘাৎ বকা দেবেন। ভাবছি আর উঠছি। উঠছি আর ভাবছি। প্রায় উঠেই গেছি—শাখার ওপর বসব, এমন সময় হাত গেলে ফসকে; পা-ও। কী হয়ে গেলো, বুঝে ওঠার আগেই আমি নিচের দিকে পড়তে লাগলাম। মুহূর্তেই মনে হলো পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে ছিটকে পড়ছি। কোথা গিয়ে ঠেকবো জানি না। নারকেলের শাখা, সুপারির শাখা—যা কিছুই আঁকড়ে ধরি, সে-ই ঠেলে দেয় যেন মহাশূন্যে। একটুপরই মনে হলো, নাক দেবে গেছে মাটিতে। তাতেই ব্রহ্মতালুতে লবণাক্ত একটা স্বাদ অনুভব করলাম। চোখের দুই পাশে যেন কোটি কোটি তারা জ্বলে উঠলো। তারাগুলো জোনাকির মতো চারদিকে ঘুরছে।
আমার যেন মাথা দুলে উঠেছে। শরীরটাও দুলছে। কার যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে—সেই দূর পৃথিবীর প্রান্ত থেকে। এই মহাশূন্যে মানুষের কান্নার আওয়াজ! আমি বিস্মিত। আমার ঘুম আসছে। কিন্তু জিহ্বায় যেন তরল কিছু একটা লাগলো। স্বাদটা লবণাক্ত। কে যেন ডাকছে, খুব মিহি সুরে—‘ভাই। ভাই। ও ভাই। ভাইয়া। চোখ খোল।’ আমিও ধীরে ধীরে চোখ খুলি। দেখে কাছারিতে খাটে শুয়ে আছি। নাকে হাত দিয়ে দেখি, ভেজা। ব্যান্ডেজ লাগানো। আমার দক্ষিণ পাশে ডাক্তার বঙ্কিমচন্দ্র রায়। তার পাশে টেবিলের ওপর ডেটলের বোতল-তুলা। মাথার বাম পাশে বসে বসে কাঁদছে বাসন্তি; ডান পাশে হাজেরা আপা। তার পেছনে রাসেল ও ইসমাইল। বঙ্কিম বাবুর পেছনে আমার মা। বঙ্কিম বাবু ছাড়া সবার চোখে জল। এতক্ষণ যিনি দরদমাখানো সুরে ডাকছিলেন, তিনি হাজেরা আপা। এখনো ডেকেই চলেছেন। কিন্তু চোখ খুলতেই তার জেরা শুরু—‘তোরে কে কইছে এই সাঁইঝের বেলায় গাছে উঠতে?’
চলবে…