গুচ্ছগ্রামের চেয়ে তোরাব আলীর বাড়ি-ঘর বেশি ঘন। গুচ্ছগ্রামে যে দূরত্বে মাত্র দুটি বাড়ি পড়তো, তোরাবআলীতে সেখানে অন্তত ৫টি বাড়ি। গাছপালা আরও নিবিড়। এখানে বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে গেলে গাছের শাখা-প্রশাখায় আকাশ ঢেকে যায়। প্রায় বাড়িতেই নারিকেল-সুপারি গাছ। আরও আছে আম-জাম-কলা গাছও। তবে, একটি জিনিস চোখে পড়ার মতো, শিশু-কিশোরদের জন্য সব বাড়ির সব ঘর উন্মুক্ত। জেনা-জানা হলেই হলো। এই বাড়ির বাচ্চারা ওই বাড়িতে খায়। ঘুমায় এই বাড়িতে এসে। মা-বাবারা খোঁজ-খবর রাখেন বটে, তবে কোনো কড়া শাসন নেই।
ক্লাস ফাইভে থাকতেই পরিচয় হলো আরও একজনের সঙ্গে। তার নাম আজাদ। তারা তিন ভাই। হেলাল, আজাদ ও ফারুক। আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আজাদের সঙ্গে। আজাদ ক্লাসমেট হলেও বয়সে অনেক বড় হবে। কারণ, আমরা তখনো সেভ করা কাকে বলে জানতাম না। সে কিন্তু প্রায় নাপিতের দোকানে সেভ করতো। একদিন স্কুল ছুটির পর আজাদ বলে, ‘চল আমাদের বাড়ি।’ বলি, ‘আজ না। আরেক দিন।’ আজাদ কিছুতেই শুনবে না। একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলো।
ঘরে ঢুকেই দেখি, কেউ নেই। সবাই বেড়াতে গেছেন চরবাটা। আজাদের নানার বাড়িতে। আজাদ একা। জানতে চায়, ‘কী খাইবি?’ বলি, ‘এখন কী খা-খা-খাবো? ভাতই তো খাবো!’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘তাহলে তুই বোস। আমি রান্না করি। আপাতত নারিকেল-গুড় দিয়ে চালভাজা খা।’ আমাকে সামনের রুমে বসতে বলে চলে গেলো রান্না ঘরে। আমিও পেছন পেছন গেলাম। দেখি তাদের রান্নাঘর আমাদের মতো সাধারণ ছনের না। টিনের। চুলাও আমাদের মতো না। কেরোসিনের স্টোভ। দেখা শেষ হলেই সামনের রুমে ফিরে আসি। নারিকেল-গুড় দিয়ে চালভাজা চিবুতে থাকি। আর ঘরের চারদিকে তাকাই। হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি বুকসেল্ফ। বেশিরভাগই মোটা মোটা বই। বইগুলো হয়তো লাল কাপড়ে বাঁধা, না হয় র্যাকসিনে। মোটা বইগুলোর সবই ইংরেজি। বাংলা লেখা একটিও পেলাম না। হঠাৎ মোটা একটি বই টান দিতেই ছোট্ট একটি বই মাটিতে পড়ে গেলো। তুলে দেখি, প্রচ্ছদ নেই। তবে প্রথম পাতায় লেখা ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। লেখক আল মাহমুদ। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এমন লেখকের নাম তো শুনিনি। নামটা বেশ অদ্ভুত। শেষ পাতায় ধাবমান ট্রেনের প্রতীকী ছবি। প্রথম এক-দুই পাতা নেড়ে-চেড়ে দেখি। কেমন যেন জাদুমাখা ভাষা। এমন ভাষায় তো এর আগে কোনো বই পড়িনি! মীর মশারফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু পড়েছি। পড়েছি ডেল কার্নেগির ‘বড় যদি হতে চান’, ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুত্ব লাভ’। আরও পড়েছি নাম না জানা লেখকের ‘ভাঙাপাঁজর’, ‘মন কেন কাঁদে’। কিন্তু সে সব বইয়ের ভাষা তো এমন নয়।
আমার ক্লাসের বইগুলো রুমাল দিয়ে বাঁধা ছিল। বাঁধন খুলে ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ রাখলাম পাঠ্যবই ও খাতার ঠিক মাঝখানে। যেন কোনোদিক থেকেই দেখা না যায়, বোঝাও না। আবার শক্ত করে বাঁধলাম। একবার ভাবি, চলে যাবো। আবার মনে মনে বলি, ‘আজাদ কী ভাববে?’ নাহ! সে রান্না করতেছে। রান্না হোক। খেয়ে-দেয়ে বের হবো।
ঝির-ঝির করে দখিনা বাতাস বয়ে চলেছে। দক্ষিণ তল্লাট থেকে প্রায় এভাবে বাতাস আসে। আর চয়ে চলে যায় কোন সে উত্তরের মুল্লুকে। কিন্তু কোথায় যায়, কেউ জানে না।
আজাদ রান্না করেছে ভাত। ঘন মসুর ডাল। সঙ্গে ডিম ভাজি। সামনের রুমে নিয়ে এলো। বললো, ‘কল থেকে হাতমুখ ধুয়ে আয়।’ খেতে বসেছি। আজাদ তার রান্না কেমন হয়েছে জানতে চায়। বলি, ‘চ-চ-চমৎকার। প্রসঙ্গক্রমে জানাতে ভুলি না—আমিও রাঁধতে জানি। রান্না শেখার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরি। সেও তারটা। দেখি দুজনের রান্না শেখার কারণ একই। খুব ছোট বেলায় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, ঘরে রান্না করার কেউ নেই। মা ডেকে নিয়ে রান্নার কায়দা-কানুন শিখিয়েছেন। সেই থেকে শুরু। বলি, ‘তবে, তো-তো-তোর রান্না অনেক টে-টে-টেস্টি। আমারটা অতটা না।’ সে আস্তে করে ধন্যবাদ দেয়। বলে, ‘একদিন রান্না করে খাওয়াবি কিন্তু।’ বলি, ‘আচ্ছা।’
আমাদের দুজনের আরেক জায়গায় অদ্ভুত মিল। গ্রামের সবাই মাকে, ‘মা’ ডাকে। আমাদের দুই পরিবারেই ডাকে ‘আম্মা’। মিলটা কাকতালীয় কি না, ভেবে দেখিনি।
যাই হোক, আমাকে সেল্ফের দিকে বারবার তাকাতে দেখে বলে, ‘কী দেখছস?’ বলি, ‘কার বই এগুলো?’ জবাবে জানায়, এগুলো তার বাবার। সবই আইনের বই। তারা বাবা মুনসেফ ছিলেন। দীর্ঘদিন বিচারক থাকার পর কোনো এক কারণে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন। চলে যান মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে। বলতে বলতে আজাদের চোখ ছলছল করে ওঠে। আজাদের উচ্চারণ বিশুদ্ধ। অন্যদের মতো অশুদ্ধ উচ্চারণ করে না সে। আঞ্চলিক ভাষায় কথা তো বলেই না।
খাওয়া-দাওয়া শেষে দাবা নিয়ে বসি। খেলতে খেলতে হঠাৎ আজাদ বলে, ‘চা খাবি?’ কী বলবো, বুঝতে পারি না। কারণ ছোটদের ‘চা’ খাওয়া বারণ। যখনই চা-দোকানে গেছি, তখনই বাবা আমার জন্য মিকচার অর্ডার করতেন। কখনোই চা খাওয়ার অনুমতি দিতেন না। বলতেন, ‘চা খাইলে বুদ্ধি কমে যাবে।’ অথচ কত শত বার যে চা খাওয়ার চেষ্টা করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। আর আজ একজন যখন খাইতে বললো, তখনই আমি দ্বিধান্বিত। আজাদ আমার অভিমত জানার অপেক্ষা করে না। চলে যায় রান্না ঘরে। ফিরেও আসে। কিন্তু কিছু বলে না। দাবায় মন দেয়। প্রায় দশ মিনিট পর একলাফে উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘হায় আল্লাহ! চা তো শেষ মনে হয়।’ বলেই দৌড় দেয় রান্না করে। কী করবো, বুঝতে না পেরে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর একটা ট্রেতে বড় দুই কাপ চা, তিন-চারটি বিস্কুট নিয়ে হাজির সে। এমন বিস্কুটা ইতোপূর্বে দেখিনি। এতবড় চায়ের কাপ? তাও না। জীবনের প্রথম চা খাওয়ার সুযোগ মিললো, তাও ইয়া বড় কাপে।
আজাদের দেখাদেখি আমিও বিস্কু ভেঙে টুকরো করে চায়ে চুবিয়ে নেই। এরপর চালান করে দেই মুখে। চা-পর্ব শেষ হতে-হতে মাগরিবের আজান পড়ে। বলি, ‘গে-গেলাম। বে-বে-বেশি দেরি হলে খবর আছে।’ আজাদ আর কিছু বলে না। আমাকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এই গোধূলিলগ্নে আর রাস্তায় উঠি না। দক্ষিণ দিকের আলপথ ধরি। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর মোড় নেই পূর্বদিকে। আরও মিনিট দশেক হাঁটলে তবে রাস্তা। রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়ি। কিন্তু তার আগে পূর্বদিকে মোড় নিতেই পেছন থেকে কার যেন গলা ভেসে এলো, ‘নূরুল হ…ক।’ ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, নুর আলম মুন্সী। তার সঙ্গে আরও আগে পরিচয় হয়েছিল। চমৎকার গলা—যেমন আজানে, তেমনি গানেও। কাছে আসতেই বললেন, ‘রিকশাঅলাগো বাড়িতে মিলাদ ছিল। সেখান থেকে ফিরতেছি। চলো হাঁটি। বাজারে যেতে হবে।’ আমি ঘাড় কাৎ করে সাই দেই।
নুর আলম মুন্সী সামনে, পেছনে আমি। আমার বাম হাতে বই। ধানগাছে ধান আসি আসি করছে। থোড় এসে গেছে। দুই-একদিনের মধ্যেই ফেটে বের হবে কচি কচি ধানের শিষ। কোনো কেনো ধানগাছে এখনই বের হচ্ছে। রেনু লেগে আছে। ঝির-ঝির করে দখিনা বাতাস বয়ে চলেছে। দক্ষিণ তল্লাট থেকে প্রায় এভাবে বাতাস আসে। আর চয়ে চলে যায় কোন সে উত্তরের মুল্লুকে। কিন্তু কোথায় যায়, কেউ জানে না। যাকেই বলি, সে-ই বলে, ‘এসব জেনে কী হবে? পড়াশোনা করো। বড় হলে নিজেই জানবে।’
এরপরই গভীর চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে কবিতা লিখতে হবে। তার আগে শিখতে হবে ছন্দ। আর ছন্দ শিখতে লাগবে একজন মাহফুজউল্লাহ। কিন্তু এই অজপাড়াগাঁয়ে সেই মাহফুজউল্লাহ কই?
আর গান-কবিতা নিয়ে কিছু জানতে চাইলে বড়রা তো বটেই, স্যাররা পর্যন্ত এমনভাবে তাকান, যেন আমি ভিনগ্রহের প্রাণী। লজ্জা পেয়ে চুপসে যাই। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারি না। কিন্তু এই অজপাড়াগাঁয়েও যে গানের সমঝদার আছেন, ভালো গাইতেও পারেন, এটা জানা ছিল না। জানা হলো নুর আলম মুন্সীকে দেখে। তিনি যেমন ভালো নজরুলগীতি গাইতে পারেন, তেমনি রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কে জানেনও অনেক। যেসব কথা পাঠ্যবইয়ে পাইনি, স্যাররা বলতে পারেননি, সেই সব কথা শোনান তিনি। তো আজ যখন গুনগুন করছি, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা/ আমাদের এই বসুন্ধরা’, ঠিক তখনই তিনি ধরলেন অন্য গান। না কোনো হামদ-নাত নয়, দেশের গানও না। একেবারেই ভিন্ন গান। নজরুলের গান, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল…।’ আমি তো বিস্মিত। হুজুর মানুষ এমন গান গায়? আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। পেছন পেছন হাঁটি। ডান হাতে ধানগাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই। বাম হাতে বই। যতই রাস্তা ঘনিয়ে আসে, ততই তার কণ্ঠস্বর নিচু হতে থাকে। একসময় শুধু মৃদু গুনগুন সুর শোনা যায়। বাণী বোঝা যায় না। বলি, ‘এত আস্তে ক্যান?’ তিনি মৃদৃ হেসে বলেন, ‘সাদা কাপড়ে ময়লা লাগলে বেশি দেখা যায়। হুজুরগো হাজার দোষ। কেউ যদি শোনে, তাইলে আর মুয়াজ্জিনের চাকরিটা থাকবো না। তুমি আবার বলে দিও না যেন কাউকে।’ আমি তার কথা কিছুটা বুঝি, কিছুটা না বুঝেই মাথা নাড়ি। তিনি বাজারের দিকে চলে যান। আমি ঢুকে পড়ে কাছারিতে।
কাকা বাড়ি নেই। আজ আসাদ নিজেদের বাড়ি। পরদিন শুক্রবার। তাই হোমওয়ার্কের তাড়া নেই। রাতের খাওয়া শেষে ইসমাইল ঘুমিয়ে পড়ে। আমার আর ঘুম আসে না। হারিকেনের চিমনির একপাশে মোটা কাগজ দিয়ে ঢেকে দেই। যেন ইসমাইলের চোখে আলো না পড়ে। এরপর টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়া শুরু করি, ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। পড়তে পড়তে টের পাই—আল মাহমুদ একজন কবি। কিন্তু কেমন কবি? রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মতো? না জসীমউদ্দীন-বন্দে আলী মিয়ার মতো? না কি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিনের সমান? আবার ভাবি, তাদের মতো হবেন কেন? আল মাহমুদের তো কোনো কবিতাই বইতে নেই। যার কোনো কবিতা নেই বইয়ে, তিনি কেমন কবি? প্রশ্নটা নিজেকে করি, উত্তরের আশা না করেই। পড়তে পড়তে জানা হয়ে যায়, তার জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। জেনে যাই—পূর্বপূরুষের পরিচয়, ছোটবেলার দূরন্তপনা। আরও জানি, ভাষা আন্দোলনের ছড়া লেখা, পুলিশ তাকে খুঁজতে যাওয়ার বর্ণনাও। জেনে যাই পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়ার প্রসঙ্গ। বাদ যায় না ফুপাতো বোনকে পুকুর ঘাটে ধাক্কা দেওয়া কিংবা চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ধারালো অস্ত্র হাতে কোনো কিশোরী তাকে ধাওয়া দেওয়ার কাহিনীও। জানতে জানতে ভোর হয়ে গেছে। আমার ঘুম আসে না। চোখ জ্বালাপোড়া করে। পুরো বইয়ের দুটি বিষয় মনে গেঁথে চায়। একটি কবিতার ছন্দ, অন্যটি একজন কবির পরিচয়। তিনি আল মাহমুদের গুরু। কিন্তু কে তিনি?
সে কথাও বলছি।
আল মাহমুদ বলছেন, তিনি অনেক দিন ধরে কবিতা লিখছেন, কিন্তু সেগুলো কিছু হয়েছে কি না, দেখানোর মতো কাউকে পান না। একদিন তিনি খবর পেলে পাশের গ্রামে সিনিয়র একজন কবি এসেছেন। তিনি মাহফুজউল্লাহ। আল মাহমুদ কবিতার খাতা নিয়ে সেই সিনিয়র কবির বাড়িতে হাজির। কবিতার খাতা উল্টেপাল্টে দেখে আল মাহমুদকে কিছু নিয়ম বাতলে দিলেন মাহফুজ উল্লাহ। আর শেখালেন ছন্দ। ছন্দ মানে স্বরবৃত্ত-অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত।
বইটি বন্ধ করে ড্রয়ারে রাখি। এরপরই গভীর চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমাকে কবিতা লিখতে হবে। তার আগে শিখতে হবে ছন্দ। আর ছন্দ শিখতে লাগবে একজন মাহফুজউল্লাহ। কিন্তু এই অজপাড়াগাঁয়ে সেই মাহফুজউল্লাহ কই—‘আমি কোথায় পাবো তারে’?
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১৭॥ মোহাম্মদ নূরুল হক