[পর্ব-১০: মুক্তবিহঙ্গ অথবা রাখাল পর্ব]
অনেক দিন হয়ে গেলো। মাদ্রাসা পর্ব শেষ। আবারও স্কুলে পড়তে চাই। সবচেয়ে বড় কথা হলো—আমার চাচাও চান, আমি যেন স্কুলে পড়ি। ততদিনে বর্ষা এসে গেলো। বাবা আমাকে একদিন বাংলাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু বছরের মাঝামাঝি হওয়ায় হেড স্যার আমাকে ভর্তি করালেন না। ভর্তি হতে না পারায় অবশ্যই সামান্য মন খারাপ হলেও তা দূরস্থায়ী হলো না। কারণ এবার আমি মুক্তবিহঙ্গ। উড়তে পারবো। যখন যেখানে খুশি।
বর্ষা মানে বর্ষা। সারাদিন-সারারাত ঝমঝম বৃষ্টি। পথঘাট ডুবে গেছে। গ্রামের বয়স্করা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। ফুটো বন্ধ করার কেউ নাই। তাই এমন অবিরাম ঝরছে।’ তাদের ক্ষোভের কারণ আছে। বেশিরভাগই শ্রমজীবী। হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বাকিরা মূলত বর্গাচাষি। পাশের বাড়ির চেয়ারম্যান কাকাও বর্গচাষি। তাকে চেয়ারম্যান কাকা বলি। কিন্তু তিনি কোনোদিন চেয়ারম্যান ছিলেন না। খেলাচ্ছলে আমাদের মতোই কিশোর বেলায় চেয়ারম্যান পদে লড়েছিলেন। সেই থেকে তার আসল নাম ডুবে গেছে চেয়ারম্যানের আড়ালে। তিনি আমাদের খেলার সঙ্গী লালি-কালি ও ফাতেমার বাবা। লালি-কালি যমজ বোন। একজন ফর্সা, আরেকজন কালো। গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সন্তানের নাম রেখেছেন তাদের বাবা-মা। ফাতেমা এই দুজনের অনেক ছোট। কিন্তু কত ছোট—তা পঞ্জিকা মিলিয়ে বলতে পারবো না।
তাই দোকানের ঝাঁপ পুরোটা তুললেন না। অর্ধেক তুললেন। তাতে বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢুকতে না পেরে গুলিবিদ্ধ বাঘের মতো অক্ষম আক্রোশে বাইরে আছড়ে পড়ছে।
তো এই বর্গাচাষি চেয়ারম্যান কাকার সুখ-দুঃখ একটু অন্যরকম। বছরের যে সময়টায় অন্য চাষিরা কষ্ট করে, সে সময়ে তার কোনো কষ্ট নেই। বাজার থেকে বস্তায় বস্তায় চাল-আটা কিনে আনেন। হালি ধরে ইলিশ কিনে আনেন। এক থেকে দেড় সের ওজনের ইলিশের হালি ১৫ থেকে ১৬ টাকা। এক হালি মাছ একদিনেই শেষ। অথচ ওই টাকার বাজারে তিন-চার সদস্যের একটি পরিবারের দিব্যি দুই দিন চলে যায়। কারণ চালের সের ২ থেকে আড়াই টাকা। মাছের সের বড়জোর তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা।
সে যাই হোক, বাজার হিসাবের কথা এখানে বাহুল্য। মূল প্রসঙ্গে আসি। চেয়ারম্যান কাকা পুরো বর্ষায় মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। সেই টাকায় দিব্যি চলতেন। ধান চাষ করতেন। ধান কাটার মৌসুম শুরু হলে তার চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করতো। কারণ এই সোনালি ধান দেখে তার চোখ জুড়ালেও পেটে পড়তো না। ধান তার ঘরে উঠতো না। ধান মাড়াইয়ের দিনই একদিকে জমির মালিক, অন্যদিকে মহাজন পানের বাটা নিয়ে বসতো। ঘন ঘন পান খেতো আর পিক ফেরতো। হাইয়া (বাঁশের তৈরি একধরনের মাপার পাত্র। ১৮ সেরে এক হাইয়া) মেপে মেপে মহাজন ও জমির মালিক যখন ধান নিয়ে যেতো, তখন কেবল চেয়ারম্যান কাকার উঠোনে পড়ে থাকতো কিছু ভূষি-চিটা ধান। সেগুলো লালি-কালি পরম যত্নে কুড়িয়ে তুলতো। তাদের মা আঁচলে চোখের পানি মুছতেন আর উঠোন ঝাড়ু দিতেন।
বলছিলাম বর্ষা এসে গেছে। বছরের মাঝখানে হেড স্যার আমাকে ভর্তি করেননি। তাই স্কুল থেকে ফিরে বাংলাবাজারে বাবা আমাকে আমাদের মুদি দোকানে নিয়ে গেলেন। দোকানের পাশে ছোট্ট চা দোকানও আছে। সেখানে চা, গরুর দুধ, লোপ, বেলা বিস্কুট, পপুলার বিস্কুট, মুড়ি পাওয়া যেতো। বড়রা সবাই লম্বা কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খায়। কেউ কেউ কাপে চুমুক দিয়ে চা খায়। কেউ কেউ কাপকে প্লেটের ওপর উপুড় করে ধরে, এরপর প্লেটের নিচে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফুরুত ফুরুত করে টান দেয়। ওই ফুরুত ফুরুত শব্দে আমার কেমন যেন লাগে। আমারও চা খাইতে মন চায়। কিন্তু আমাকে কেউ চা দেয় না।
যখন বড়রা চা খেতো, আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমাকে দিতো একগ্লাস দুধ। সঙ্গে হয় দুই-তিনটে বেলা বিস্কুট, না হয় লোপ। বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ার পরও দুধ কিছুটা থাকতো। সেটা পরে খেতাম। কিন্তু লোপ চুবিয়ে খেতে গেলে দুধ শেষ হয়ে যেতো, লোপ শেষ হতো না।
তো সেদিন দোকান খুলে বাবা তার বাটা কোম্পানির রাবারের জুতা খুলে গদিতে উঠে বসলেন। বাইরে বৃষ্টি। তাই দোকানের ঝাঁপ পুরোটা তুললেন না। অর্ধেক তুললেন। তাতে বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢুকতে না পেরে গুলিবিদ্ধ বাঘের মতো অক্ষম আক্রোশে বাইরে আছড়ে পড়ছে। আর বাতাসের তোড়ে কখনো শোঁ-শোঁ, কখনো ঝমঝম শব্দে যেন মহাপ্রলঙ্কর শুরু হয়ে গেছে। চা-দোকানিকে ডেকে বাবা বললেন, ‘ও মামু। এক কাপ চা দিয়া যা। লগে বেলা বিস্কুট-লোপ আনিছ।’ কিছুক্ষণ পর চোকানি ভেজা জামাকাপড়ে জবুথবু হয়ে আমাদের দোকানে ঢুকলেন। বাবাকে চা-বেলা বিস্কুট দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাইরে আনলেন ক্যান এই ঝই (বৃষ্টি)-তুফানের ভিত্তে?’ আমার আসার কারণ জানিয়ে বাবা বললেন, যান মামু, ‘সুলতানরে মিকচার দে।’ বাবা আমার নাম ধরে ডাকতেন না। বলতেন সুলতান।
আর ঘরের ভেতর জ্বলতো রাতা মোরগ মার্কা কয়েল। আমাদের দুই ভাইয়ের লোভ ছিল কয়েলের বাক্সের দিকে। কবে কয়েল শেষ হবে, কে কার আগে বাক্সটা হস্তগত করবো, সেই প্রতিযোগিতা চলতো দুজনেরই।
এখানে বলে রাখি, আগেও বলেছি আমাদের ছোটবেলায় চা দেওয়া হতো না। চা চাইলেই দুধ বা মিকচার দেওয়া হতো। ছোটবেলা এককাপ রঙ চা ছিল চার আনা, এককাপ দুধ চা আট আনা। মিকচারও আট আনা। আর এক গ্লাস দুধ একটাকা। মিকচার হলো কাপের অর্ধেক দুধ, অর্ধেক গরম পানি। সঙ্গে চিনি।
আমরা বাপ-বেটা যখন চা-মিকচার খাওয়ায় ব্যস্ত, তখন কারও কারও মুখে পান। কারও কারও হাতে বিড়ি। এক প্যাকেটে ২৫ টি সরু বিড়ি থাকতো। দুই কোম্পানির বিড়ি ছিল আমাদের এলাকায়। একটি আবুল বিড়ি, অন্যটি শাহজাহান বিড়ি। প্যাকেটের দাম একটা টাকা। তবে একটি কিনলে ৫ পয়সা।
এই বিড়ি খাওয়ার একটা আদব ছিল। ছোট-বড় সবাই একসঙ্গে থাকলে অপেক্ষাকৃত বড়দের সামনে ছোটরা বিড়ি টানতেন না। কেবল বড়রাই টানতেন। অপেক্ষাকৃত ছোটরা বিড়িতে অগ্নিসংযোগ করার পর যদি বড়রা সামনে এসে পড়তেন, সঙ্গে সঙ্গে ছোটরা বাকি বিড়িটুকু পায়ের তলায় পিষে ফেলতেন। তাদের সবারই থাকতো খালি পা। কেউ জুতা পরতো না।
মজার ব্যাপার হলো, আমার বাবা, স্কুলের স্যারেরা, আমার ফুপাতো ভাই হালিম মাস্টার ছাড়া কারও পায়ে সময় স্যান্ডেল কি রাবারের জুতা—কোনোটাই দেখিনি। আমার বাবা পরতেন কালো রঙের জুতা। বাটা কোম্পানির। রাবারের জুতাগুলো সাধারণত শক্ত হতো। কিন্তু বাটা কোম্পানির কালো জুড়াগুলো কেমন যেন নরম হতো। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা—বারোমাস বাবা ওই জুতাই পরতেন।
বর্ষায় জুতার ভেতর পানি ঢুকে যেতো। হাঁটার সময় একধরনের চপ-চপ শব্দ হতো। পানি ঢুকতো আর বের হতো। বাড়িতে বাবা ভালো করে পা ধুয়ে পায়ের পাতায় কখনো কেরোসিন মাঝতেন, কখনো পিটকিরি ঘষতেন। এই জুতাগুলো যখন ছিঁড়ে যেতো, ফেলে দিতাম না। আমরা ঘরে জমিয়ে রাখতাম। যখন মশার খুব উৎপাত হতো, কয়েলেও কাজ হতো না, তখন আমরা ছেঁড়া জুতাগুলো পোড়াতাম। উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতো। তবু মশার উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য সারাবাড়িতে জুড়া পোড়ার ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতাম। আর ঘরের ভেতর জ্বলতো রাতা মোরগ মার্কা কয়েল। আমাদের দুই ভাইয়ের লোভ ছিল কয়েলের বাক্সের দিকে। কবে কয়েল শেষ হবে, কে কার আগে বাক্সটা হস্তগত করবো, সেই প্রতিযোগিতা চলতো দুজনেরই।
তার সামনে প্রচণ্ড ছোবল তুলে আসছে ঝড়, ফোঁস-ফোঁস করছে বৃষ্টি। আকাশে মেঘের গর্জন। চোখ রাঙাছে বিজলি। চলছে কানে তালা লাগানো বজ্রপাত। আছে রাস্তার খানাখন্দ। তবু কোনো কিছুই বাবাকে দমাতে পারছে না।
তো সেদিন ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে গেলো। বাবা সন্ধ্যার পরপর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করলেন। বের হলাম বাড়ির উদ্দেশে। বাজার পার হয়েছি মাত্র। খোলা রাস্তায়। দক্ষিণ দিক থেকে হুহু করে বাতাস তেড়ে আসছে। তখন বাংলাবাজার পার হয়ে পূর্বদিকে নদী পর্যন্ত গেলে রাস্তার উত্তর পাশে কাছাকাছি আমাদের বাড়িসহ বাড়ির দেখা মিলতো ৪টি। বাজার লাগোয়া ভাইস চেয়ারম্যানদের বাড়ি। এরপর পূর্ব দিকে রাস্তার উত্তর পাশে কাছাকাছি ছিল আমাদের বাড়িসহ তিনটি। আর রাস্তার দক্ষিণ দিকে মাত্র দুটি। একটি ঝন্টু মিস্ত্রিদের বাড়ি, অন্যটি একটি নাপিত বাড়ি। তো আমরা বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসের রাতে বাজার পার হয়েই পড়লাম বিপাকে। ঝড়ো হাওয়া তো আমাকে প্রায় উড়িয়েই নিয়ে যায়। আমি রাস্তায় দাঁড়াতে পারি না। বাবার সারাশরীর পলিথিনে মোড়ানো। কেবল চোখ দুটি দেখা যায়। আমারও।
কেবল যে মুষলধারায় বৃষ্টি ও বাতাস তাই নয়, বাজার পাওয়ার পর দেখা দিলো আরেক ঝক্কি। পুরো রাস্তা পানিতে ঢুবে গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তা ধসে গেছে। ফলে একদিকে বাতাস আমাকে পেঁজা তুলোর মতো উড়িয়ে নিতে চায়, অন্যদিকে পানির তলার খানাখন্দে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ি। একবার এমনভাবে পড়েছি যে, নামে মুখে পানি-মাটি সবই ঢুকে গেছে।
আমাকে পড়ে যেতে দেখেই বাবা যেন আঁতকে উঠলেন। মনে হলো গুমরে উঠলেন। ঠিক তখনই আমাদের পেছন থেকে টিনের চোঙায় রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীর কণ্ঠ ভেসে এলো—একটি ঘোষণা। ‘একটি ঘোষণা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে….’। বাবার গুমরে ওঠার সঙ্গে টিনের চোঙার শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। আর তখনই ঘটে গেলো অভাবনীয় ঘটনা। বাবা এক ঝটকায় আমাকে টেনে দাঁড়া করালেন। তারপর রাস্তার পানিতে কোমর ডুবিয়ে বসলেন। বললেন, ‘নে আঁর কান্ধে উড়ি বয়।’ আমি হাফেজ মানুষ। দেখতে ছয়-সাত বছর বয়সী মনে হলে কী হবে, বয়স কিন্তু কম না। নয়-দশ হবে। এই বয়সী ছেলে বাবার কান্ধে কিভাবে উঠি? ইতস্তত করি। কিন্তু বাবা এবার তার কাঁধ আরও নিচু করেন। আমি উঠি না। বাবা আবারও বলেন। আমি ঠক ঠক করে কাঁপি। যেখানে বাবার পায়ের সঙ্গে পা লাগলে তিন বার সালাম করি, চুমো খাই, সেখানে তার কাঁধে চড়ে বসবো? মনে মনে বলি—এটা হয় না!
এবার বাবা আমার পেছনে চলে যান। তারপর আমার দুই বাহু ধরে, ওপরের দিকে তুলে ধরলেন। এরপর আমার দুই পা তার বুকের দুই পাশে রেখে বসিয়ে দিলেন কাঁধে। আর আমার দুই হাতের কবজি শক্ত করে ধরলেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তখন আমার মাথা যেন একটু খানি ঝিমঝিম করে উঠলো। নানির মুখে গল্প শুনেছি, পৃথিবীটা নাকি আকাশের চেয়ে কয়েক কোটি গুণ বড় এক মহিষের শিঙের ওপর বসে আছে। মহিষ বছরে একাধিকবার পৃথিবীকে এক শিঙ থেকে আরেক শিঙে নেয়। আর তখনই ভূমিকম্প হয়। আজ বাবার কাঁধে ওঠার পর মনে হলো, মহিষের শিঙবদলের সময় পৃথিবী যেভাবে একটু দুলে ওঠে, আমার মাথায় তেমন দুলুনি লেগেছে। আস্ত পৃথিবীকে যেভাবে আহার-নিদ্রাশূন্য একটি মহিষ যুগ-যুগ ধরে তার দুই শিঙে বহন করে চলেছে, তেমনিভাবে বাবাও তার বিশাল কাঁধে আমাকে তুলে নিয়েছেন। এই কাঁধে সন্তান যতদিন থাকে, ততদিন বিশ্বভুবনের কোনো অসুর-অশুভ শক্তি তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। পৃথিবীর চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বিশাল সেই কাঁধে আমাকে নিয়ে চলেছেন বাবা। তার সামনে প্রচণ্ড ছোবল তুলে আসছে ঝড়, ফোঁস-ফোঁস করছে বৃষ্টি। আকাশে মেঘের গর্জন। চোখ রাঙাছে বিজলি। চলছে কানে তালা লাগানো বজ্রপাত। আছে রাস্তার খানাখন্দ। তবু কোনো কিছুই বাবাকে দমাতে পারছে না। বাবা ছুটে চলেছেন গ্রিক দেবতা হারকিউলিসের মতো। না, কম বলা হলো। তারও চেয়ে বেশি তিনি দীপ্র-দৃপ্ত-উজ্জ্বল পুরুষোত্তম!
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৯ ॥ মোহাম্মদ নূরুল হক