পর্ব-৪.
বিভিন্ন ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে চন্দনার দিন পার হয়ে গেলেও রাত এলে যেন ফারুক তাকে পুরোটা দখল করে নেয়। ফারুক, কিভাবে যে কী হলো বুঝিনি। আমাকে এভাবে হারতে হবে, আমাকে কেউ এভাবে স্পর্শ করে ফেলবে, কল্পনাও করিনি। জানি জীবন চলার পথ আরো বহু বাকি। আমি নিজেও হয়তো নিজেকে ধরেও রাখতে পারবো না। আমার বয়স; সমাজ-সময় এসবের কাছে একসময় আমাকে সমর্পিত হতেই হবে। এই বাস্তবতাটুকু আমি বুঝি। কিন্তু সেটা তো এভাবে নয়, সেটা তো অনেক সুন্দরভাবে; সমাজ আচার মেনে হতে হবে। সেটা তো পিনুর সঙ্গেও হতে পারে। ও এখন ছোট হয়তো। কিন্তু পূর্ণ যুবক হয়ে উঠলে তখন তো এসব সম্পর্কে কোনো সমস্যা থাকে না।
আমি কয় বছরের বড়; ও কয় বছরের ছোট; ওসব গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। আমি ওটুকুও বুঝি। পড়ালেখা শিখেছি। আবার মন বলে যে সত্তা আছে, তাও তো অস্বীকার করতে পারি নে। শুদ্ধ পথ ধরে জীবন কি এগোয়! একটা জীবনের পুরোটা কি শুদ্ধতায় পার হয়! আমিও তো মানুষ। আমার যেমন পরিবার সমাজ আছে, যেখানে সম্মান দামি; আবার আমার মন সসময় কি তা মেনে চলবে! সবার মন কি তা সম্পূর্ণ মেনে চলে! আমারও তো ওর কাছে হেরে যেতে ইচ্ছে করে। নানা কিছুর কারণে হয়তো বিবেক তাতে সায় দেয় না। কিন্তু মন তো পছন্দের কোন পুরুষের সান্নিধ্যতা চায়। ফারুককে যতোই ভালোবাসি, যতই ওর স্মৃতি আঁকড়ে থাকি, একদিন আমার এই আমিকে যে কোনো এক পুরুষের প্রশস্ত বুকে সমর্পণ করবো, এই সত্যটুকু তো খুব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারি।
পিনুর যে ডাগর কাঁচা হাত রাত্রির আঁধারে আমার বুকে, আমার মন তো তাতে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু পরিবার-সম্পর্ক-সমাজ-বয়স এসবের বাস্তবতায় নিজেকে নিজের ভেতর দমিয়ে রেখেছি। তাতে তো মনের খুবএকটা শক্তি ছিল না। মন তো গ্রহণই করতেই চাইছিল। গ্রহণই করেছিল।
এ সময় রানুর একটা মেসেজ আছে। স্ত্রী মীমের সঙ্গে তার চলছে না। সব সময় অশান্তি। বনিবনা হচ্ছে না কিছুতেই। বীনা নিজেই সেপারেশন চায়। রানু অশান্তির ভয়াবহ আগুনে জ্বলছে। রানু চায় চন্দনা তার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করুক। চন্দনা রাজি হলেই রানু সেপারেশনে চলে যাবে। প্রতিদিন ফোনে মেসেজে এই একই কথা। চন্দনা কোনো সাড়া দেয় না। ভাই হিসেবেই মেনে চলে এবং সেটা নানাভাবে বুঝিয়েও বলে। ভাবে, এ বাড়িতে যদি কারও সঙ্গে কিছু করতে হয়, তা পিনুর সঙ্গেই হবে। এই বাড়িতে কাউকে যদি নিজেকে সমর্পণ করি, পিনুকেই করবো। কিন্তু পিনুর ভেতর কি এরকম কোনো ভাবনা আছে!
মনের ভেতর জ্বলে যায়। বড় ভাইয়ের ওপর তার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। চন্দনার প্রতিও রাগে ক্ষোভে শরীরে যেন আগুন ধরে যায়। তারপরও সে কোনো কিছুই না দেখার মতো করে থাকে, কাউকে কিছুই বলে না।
রানুকে নিয়ে এক অশান্তি তৈরি হয় চন্দনার। যখন তখন ফোন করে, সময় অসময় বাড়িতে এসে চন্দনার সঙ্গে কথা বলে। চন্দনা ইচ্ছে করলেও সব সময় এড়িয়ে যেতে পারে না। রানু একেবারে গায়ে-পড়ে কথা বলে। সারাক্ষণ নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলে। তার সঙ্গে সবসময় অশান্তি । চন্দনার কাছে একই কথা, তার স্ত্রী পরকীয়ায় মগ্ন। সেসব নিয়ে কথা বললেই তার সঙ্গে যে আচরণ করে, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। বাড়ির মালিকের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক। ওর নাম সফি। বাবার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করে। মাস্তানিও করে। সবাই তাকে একরকম ভয় পায়। বাসা বদলানোর চেষ্টা অনেকবার করেও রানু সফল হয়নি। তার স্ত্রী এ বাসা ছেড়ে যাবে না। সফির নির্দেশ আছে অন্য কোনো বাসায় যাওয়া যাবে না। মীম নিজেও এ বাসাতেই থাকতে পছন্দ করে। বাসাটা নিজের মনে হয়। যেন মনের ভেতর একটা অধিকারবোধ অনুভব করে।
সফি তো আমারই; রানু জীবনে থাকলেই কী, না থাকলেই কী! সফি থাকলে এ পৃথিবীতে আর কিছু লাগে না। রানু নিজেও জানে মামের সঙ্গে তার যে জীবন, এ জীবন অসহনীয় যন্ত্রণার। বাইরে থেকে লোক দেখানো একটা সম্পর্ক। মীম আর সফির সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো অবাধ। সফি তাকে অনেক দামি দামি উপহার দেয়। মীম তাতে খুব খুশি হয়। এ সব নিয়ে রানু আর সফির মধ্যে বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। সফি তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ব্যাটা বেশি কথা কস না। য্যাম্বা চুপচাপ আছিস, স্যাম্বাই থাক। কথা কইলে গড়াই নদীর পানিতে রাতের আঁধারে চুবিয়ে মারবো। বউ তো থাকতেই হারাইছিস, জীবনডাও হারাবি।
প্রফেসর মানুষ, সব দেখেশুনেও চুপ কইরা জীবনডা পার করে দে। পারলে অন্য আর একটা মেয়েকে আবার বিয়ে কর। এই বউডারে আপাতত পাইবি না। ছাইড়া দিতে যখন মন চাইবো, তখন ছাইড়া দেবো। তখন আবার নিস। এখন তোর এই বউডারে ভুইলা থাক, ব্যাটা।
সফিকে কী বলবে বুঝতে পারে না রানু। কিছু বললে যে চরম অপমান হতে হবে, তা সে জানে। এর আগে যে প্রতিবাদ করেনি, তা নয়। করেছে। সেজন্য কম অপমান হতে হয়নি তাকে। গলা ধাক্কা দিয়ে একবার ফেলেও দিয়েছে। সেসব কাউকে বলেনি সে। লজ্জায় অপমানে নিজের ভেতর চেপে রেখেছে। মীমের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক কোনো সম্পর্ক নেই তার। যা আছে তা লোক দেখানো। মীমের স্বামী-স্ত্রীর যে সম্পর্ক তা সফির সঙ্গেই। সেটা আর গোপন নেই রানুর কাছে। রানুকে সে স্পষ্ট করে অনেক আগে বলেও দিয়েছে, আমি সফির কাছে শুই। সফিই আমার ভাতার। তুই অন্য কোনো মাগিকে নিয়ে শুগা, আমার আপত্তি নেই। তোর বাড়িতে তো একটা আছেই। কাঁচা বয়সেই তো ভাতার খ্যায়া আছে। তুই তো এখন যখন যখন দৌড়া খাতি যাস। ওরকম না খ্যায়া ভাতার হগা। আমি ঠেকাতে যাবো নানে। আমার ভাতার সফি। ওর সঙ্গেই আমি থাকি, ওর সঙ্গেই সারাজীবন থাকবো।
মীমের ওপর রানুর বিন্দুমাত্র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে চন্দনার কাছে। চন্দনার খারাপ লাগে রানুর জন্য। কিন্তু সেই অসহায়ত্বে তার পাশে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি নেই তার। সে মনে মনে পিনুর হয়ে গেছে আরও আগেই। যদিও বয়স অনুসারে রানুর সঙ্গেই তার সম্পর্কটা মানায়। তার থেকে মাত্র দু বছরের বড় রানু। সম্পর্ক গড়ার জন্য বয়সের মিলটা একদম ঠিক। কিন্তু অমিলটাকেই নিজের মনের সঙ্গে মিল করে নিয়েছে সে। সে নিজেও আগে কখনো বোঝেনি অঙ্কটা তার এরকম মিলবে। পিনুকে ইচ্ছে করলে সরিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু সেই ইচ্ছেটা তার কাছে শক্তি হয়ে ওঠেনি। বরং তাকে না সরিয়ে মন থেকে আপন করে ভেবে নিয়েছে। তার ইচ্ছেতে নিজেকেও অনেকটা পাপড়ির মতো প্রস্ফুটিত করেছে। এ তো মরুতৃষ্ণায় অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি-ফোঁটার মতোই।
রানু কিভাবে সেখানে সহানুভূতি পাবে! কিভাবে তার অসহায়ত্বে পাশে দাঁড়াবে! সে তো চায় তাকে প্রেমিকার মতো, সে তো চায় মীমকে ছেড়ে তাকে বিয়ে করতে। চন্দনা তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যানও করতে পারে না, গ্রহণও করতে পারে না। বাড়িতে যত সময় রানু থাকে, প্রায় সারাটা সময় কোনো না কোনো উসিলায় চন্দনার কাছে থাকার চেষ্টা করে, নিজের সংসারের যন্ত্রণার কথা কয়, তাকে জীবনে পাবার বাসনার কথা কয়। রানু আর চন্দনার এত ঘেঁষাঘেঁষি করে চলা, সারাক্ষণ কথা বলা পিনুর ভালো লাগে না। মনের ভেতর জ্বলে যায়। বড় ভাইয়ের ওপর তার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। চন্দনার প্রতিও রাগে ক্ষোভে শরীরে যেন আগুন ধরে যায়। তারপরও সে কোনো কিছুই না দেখার মতো করে থাকে, কাউকে কিছুই বলে না। পড়ালেখায় ভীষণ বস্ততা দেখিয়ে বই নিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকে। কখনো কখনো চন্দনা কোনো কাজে তার ঘরে এলেও সে কোনো কিছুই না বোঝার মতো করে পড়ায় ব্যস্ততা দেখায়।
বইয়ের দিকে মুখ রেখেই বললো পিনু, তুমি এখন যাও তো, এসব পচা কথা ভাল্লাগে না আমার। মেজাজ খারাপ হয়া যাচ্ছে। কয়দিন পরে পরীক্ষা। তোমার জন্য আমার কোনো পড়াই হচ্ছে না।
চন্দনা তার পড়ার টেবিলে ডিম আর কলা রেখে বললো, এটা খাও। এত পড়। ঠিক মতো খেতে হবে। খাবার দিয়ে গেলেও তো খাও না। টেবিলে অমনি পড়ে থাকে। পিনু হুট করে বললো, আচ্ছা তোমার সঙ্গে ভাইয়ার সারাক্ষণ কিসের এত প্যানপ্যানানি? কিসের এত মাখামাখি? সারাক্ষণ তো একসঙ্গেই লাগি থাকো দুজনে। কিসের এত কথা কও মাথামুণ্ডু কিছু বুঝিনে। চন্দনা এই প্রথম অনুধাবন করে, রানুর সঙ্গে তার কথাবার্তা পিনু পছন্দ করে না। এটা তার ভালোও লাগলো। তাকে যে পিনু ভেতরে ভেতরে ভালোবাসে তা বুঝতেও আর বাকি থাকে না চন্দনার।
নিজের বুঝ নিজের ভেতর চেপে চন্দনা বললো, ভাবির সাথে রানু ভাইয়ের ঝামেলা যাচ্ছে, সেসব কথা, অন্য কিছু না। তাতে তুমি কী করবা? অবশ্য একটা ভালো পথ আছে। পারলে ভাইয়াকে বলো, ভাবিকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করুক। দুজনের মিল থাকলে বিয়েরই বা কী দরকার! অ্যাম্বাই চালা যাও। রাগে গদগদ করতে করতে বইয়ের দিকে মুখ করে থাকে।
পিনুর এরকম কথা শুনে চন্দনার একটু রাগ হলো। আবার কোথায় যেন ভালোও লাগলো। রানুর সঙ্গে কথা বলায় তার ভেতর যে রাগ হয় ক্ষোভ হয়, মাত্রা ছেড়ে কথা বলে। এতে যে পুরোটাই ভালোবাসা লুকানো, তা তার বুঝতে বাকি থাকে না। বুঝে নেয়, পিনু প্রকাশ না করলেও সে ভেতরে ভেতরে তাকে ভালোবাসে, বয়সের বড়ত্ব আর ছোটত্ব যে ভেঙেচুরে মনের স্রোতে কখনো কখনো এক হয়ে যায় তা সে আজ বুঝতে পারে।
চন্দনা ইচ্ছে করেই পিনুকে রাগানোর জন্য বললো, রানু ভাই তো সারাক্ষণ আমার কাছে ঘুরঘুর করে, ঘ্যানঘ্যান করে। আমার তো ভালোই লাগে একটা টাটকা পুরুষ মানুষ বউ রেখে আমার পিছে পড়ে থাকে, মন্দ কী!
বইয়ের দিকে মুখ রেখেই বললো পিনু, তুমি এখন যাও তো, এসব পচা কথা ভাল্লাগে না আমার। মেজাজ খারাপ হয়া যাচ্ছে। কয়দিন পরে পরীক্ষা। তোমার জন্য আমার কোনো পড়াই হচ্ছে না।
ভীষণ একটা ভালো লাগা কাজ করে চন্দনার। কিন্তু তা একটুও পিনুকে বুঝতে না দিয়ে এমনভাবে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, যেন সে পিনুর কথায় বহুত কষ্ট পেয়েছে।
পিনুও তাই-ই বুঝলো। ভাবলো, রাগের মাথায় কেন যে ওসব বলতে গেলাম! অনুশোচনা পেয়ে বসে তাকে। আবার ভাবে, থাক, এখন আর কিছু না বলি। পড়ায় মন বসাতে চেষ্টা করে পিনু।
চলবে…